আকাশে মেঘ ছিল, বজ্রপাতের আগাম সতর্কবার্তাও ছিল। কিন্তু অনেকেই সেই বজ্রের ব্যাপকতা এবং ভয়াবহতা আগাম আঁচ করতে পারেননি। দেশের শীর্ষ আদালতের সাম্প্রতিক রায়ে ২০১৬ সালের এসএসসি-র গোটা প্যানেল বাতিল হওয়ায় এক দিকে যেমন ২৫৭৫৩ জন শিক্ষক এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবনে চরম আঁধার নেমে এসেছে, তেমনই রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাও যে গভীর সঙ্কটে পড়েছে, সংশয়ের অবকাশ নেই।
কিন্তু তার চেয়েও বড় চমক সৃষ্টি হয়েছে এই রায়-পরবর্তী ঘটনাক্রমে। এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের নেপথ্য কারিগররা সকলেই দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মীকি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। শিক্ষক নিয়োগে লাগামহীন দুর্নীতিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যাঁরা লাভবান হয়েছিলেন, তাঁরা যে এই বিপর্যয়ের দায় নেবেন না, সেটা জানাই ছিল। কিন্তু তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই কিছু মানুষকে দোষী চিহ্নিত করতে পারলেও বাকিরা যে ক্লেদমুক্ত, তেমন প্রমাণ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ যোগ্যদের চাকরি হারানোর দুর্ভোগের দায় তাঁদের উপর কেন বর্তাল না, সেটা এক গভীর রহস্য। ওএমআর শিট নষ্ট করা এবং সেগুলির মিরর ইমেজ সংরক্ষণ না করার অভিযোগে বিদ্ধ এসএসসি-ও দায় নিতে নারাজ। যদিও আদালতে একাধিক বার দাখিল করা হলফনামায় চিহ্নিত দোষীদের বাইরে বাকিরা যে নিষ্কলুষ, এমন দাবি জানাতেও তাঁরা সমর্থ হননি। এমনকি যাঁদের প্রচ্ছন্ন মদতে বছরের পর বছর মানুষ গড়ার কারিগরদের চাকরি বিক্রি হল, যাঁরা দুর্নীতি আড়াল করতে সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টি করে প্যানেলে নাম না-থাকা মানুষদের চাকরি দিয়ে শিক্ষক সমাজের মুখে অনপনেয় কালি লেপন করলেন, তাঁরা নিজেদের কেবলমাত্র সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেই ক্ষান্ত হচ্ছেন না, বরং বঞ্চিত চাকরি প্রার্থীদের হয়ে সওয়াল করা রাজ্যের কতিপয় আইনজীবী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর উপরে যাবতীয় দায় চাপাতে গলা ফাটাচ্ছেন।
এই জটিল এবং ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে যাঁদের কোনও ভূমিকাই ছিল না, সেই সৎ এবং যথার্থ মেধাসম্পন্ন শিক্ষকদের ঘাড়ে চরম শাস্তির খাঁড়া নেমে আসার পরেও আজ পর্যন্ত এঁদের কারও কণ্ঠে অনুশোচনার লেশমাত্র শোনা যায়নি। উল্টে আদালতের রায়ে একই সঙ্গে সৎ এবং অসদুপায়ে চাকরি পাওয়া সকল শিক্ষকের চাকরি বাতিল হওয়ার পর দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে সবাইকে বাপ-বাপান্ত করতে নেমে পড়েছেন অনেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের নিষ্ঠুর ট্রোল যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
তবে আদালতের রায়ের মধ্যে একটা স্ববিরোধ রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। শীর্ষ আদালত সিবিআইয়ের পেশ করা নথির ভিত্তিতে সংশয়াতীত ভাবে চিহ্নিত দোষীদের বেতন বাবদ প্রাপ্ত টাকা ফেরত দেওয়ার আদেশের সঙ্গে পুনরায় পরীক্ষায় বসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সুতরাং, শীর্ষ আদালত যে সিবিআইয়ের তদন্তে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণকে মান্যতা দিয়েছে, তাতে কোনও দ্বিমত থাকার কথা নয়। অতএব ধরে নেওয়া যায়, চিহ্নিত দোষীদের বাইরে থাকা হাজার হাজার শিক্ষকের বিরুদ্ধে অন্তত দুর্নীতির কোনও প্রমাণ নেই। যদি এঁদের মধ্যে কিছু দোষী থেকেও থাকেন, তা প্রমাণ করার দায় সিবিআই এবং এসএসসির, যাঁরা শাস্তি পেলেন, তাঁদের নয়। অনেকে ক্রিমিনাল ট্রায়ালের সেই গোড়ার আপ্তবাক্য “লেট আ হান্ড্রেড গিলটি বি অ্যাকুইটেড বাট ওয়ান ইনোসেন্ট নট বি কনভিক্টেড” মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু তার পরেও শীর্ষ আদালতের এই রায় যে-হেতু অলঙ্ঘ্য, তাই এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল এতগুলো মানুষের বাঁচার প্রশ্ন। আদালত যে পথটি উন্মুক্ত রেখেছে, সেটি হল নতুন করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ। সময়সীমা মাত্র তিন মাস। কিন্তু ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার জন্যে যে প্রস্তুতি প্রয়োজন, তিন মাস তার জন্যে যথেষ্ট নয়। দীর্ঘ সাত-আট বছর শিক্ষকতা করার ফলে অধিকাংশ শিক্ষক নিজের পাঠদানের বিষয় ব্যতিরেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যে জ্ঞাতব্য অন্যান্য বিষয়ের চর্চা থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত। সকলেরই বয়স বেড়েছে, ফলে নতুন নতুন বিষয় আয়ত্ত করার ক্ষমতাও হ্রাস পেয়েছে। মাথার উপরে চাকরি হারানোর খাঁড়া নিয়ে এঁদের যদি চাকরির জন্যে নিয়মিত প্রস্তুতি নেওয়া প্রার্থীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়, তা হলে সেটা হবে এক চরম প্রহসন।
তা হলে উত্তরণের উপায় কি একেবারেই নেই? গত শতাব্দীর আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন দফতরে কর্মরত অপেক্ষাকৃত অবর পদমর্যাদার আধিকারিকদের উচ্চ পদে যোগদানের সুযোগ সৃষ্টির জন্যে একাধিক বার ‘লিমিটেড’ ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করা হয়েছিল। নির্দিষ্ট ন্যূনতম অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকদের সঙ্গে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে কর্মরত কানুনগো পদমর্যাদার অনেক আধিকারিকই এই ‘লিমিটেড’ ডব্লিউবিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে ডব্লিউবিসিএস (এগজ়িকিউটিভ) পদে উন্নীত হতে সমর্থ হয়েছিলেন। বর্তমান সময়েও ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস’-এ যোগদানের জন্যে সকল প্রার্থীর জন্যে উন্মুক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি চাকরিরত অপেক্ষাকৃত অবর পদমর্যাদার আধিকারিকদের জন্যে নির্দিষ্ট হারে কিছু শূন্যপদ সংরক্ষিত রাখা হয়। ওই সংরক্ষিত শূন্যপদগুলি ‘লিমিটেড’ ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস সার্ভিস’ পরীক্ষার মাধ্যমে পূরণ করা হয়। অন্যূন ২৮৯০০ টাকা মূল বেতন, এমন পদে যোগদান করার কিংবা ওই মূল বেতনে পৌঁছবার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকরিতে ছেদহীন ভাবে আট বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আধিকারিকরা এই ‘লিমিটেড’ পরীক্ষায় বসার যোগ্য বলে বিবেচিত হন। সকলের জন্যে উন্মুক্ত পরীক্ষাই হোক কিংবা ‘লিমিটেড’, দু’টি পরীক্ষাই পশ্চিমবঙ্গ লোকসেবা আয়োগ গ্রহণ করলেও অপেক্ষা রাখে না, সম্পূর্ণ পৃথক ভাবে দু’টি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়।
যে-হেতু সদ্য চাকরি হারানো শিক্ষকরা প্রায় সাত থেকে আট বছর শিক্ষকতা করছেন, তাই তাঁদের জন্যেও (অবশ্যই যাঁরা চিহ্নিত দোষীদের বাইরে আছেন) এমন কোনও ‘লিমিটেড’ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যায় কি না, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা খতিয়ে দেখতে পারে। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কাট-অফ মার্কও রাখা যেতে পারে। তবে পরীক্ষাটি অবশ্যই বিষয়ভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন। যাঁরা উত্তীর্ণ হবেন, তাঁরা চাকরিতে বহাল থাকবেন। যে-হেতু এ রাজ্যের স্কুলগুলিতে প্যারা-টিচার নিয়োগের তেমন কিছু ধরাবাঁধা নিয়ম বা পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই, তাই যাঁরা ব্যর্থ হবেন, তাঁদের প্যারা-টিচার হিসেবে বহাল রাখাটা কিছু দুরূহ হবে না। এতে হয়তো পাশ করতে অসমর্থ শিক্ষকরা আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, কিন্তু পুরোপুরি চাকরি খোয়ানোর চাইতে এই ব্যবস্থা তাঁদের পক্ষে মঙ্গলজনকই হবে।
অধিকন্তু, চিহ্নিত দোষীদের বাইরেও যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষকের যোগ্যতা নিয়ে আদালত কিংবা এসএসসি নিঃসংশয় হতে পারেনি, এই পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁদের অগ্নিশুদ্ধি হলে এক দিকে যেমন তাঁরা হৃত সম্মান এবং চাকরি ফিরে পেতে পারেন, তেমনই স্কুলগুলিও শিক্ষকহীনতার এই সঙ্কট থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে পারে। এই ‘লিমিটেড’ পরীক্ষার জন্যে যদি নতুন করে আদালতের অনুমতির দরকার হয়, আইনজ্ঞদের পরামর্শ সাপেক্ষে সে ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে আশু উদ্যোগ বাঞ্ছনীয়। বিনা দোষে কেউ যাতে শাস্তি না পান, তার জন্যে বিকল্প পথের সন্ধান এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বারংবার চাকরিহারাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সুতরাং যোগ্য এবং সৎ শিক্ষকদের চাকরি রক্ষা করাটা যে প্রকৃতপক্ষে তাঁর সম্মান রক্ষার সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা বুঝি বলার অপেক্ষা রাখে না।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)