ভারত এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ, দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি কর্মক্ষম লোকের বসবাস এ দেশে। প্রতীকী চিত্র।
ভারতের জনসংখ্যা সম্ভবত চিনের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছে— ভারত এখন পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ, দুনিয়ার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি কর্মক্ষম (১৫-৬৪ বছর বয়সি) লোকের বসবাস এ দেশে। ‘সম্ভবত’, কারণ ভারত যে সত্যিই চিনের জনসংখ্যাকে ছাপিয়ে গিয়েছে, তার কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই। রাষ্ট্রপুঞ্জের এই প্রোজেকশন বা অভিক্ষেপ ২০১১-র জনশুমারির ভিত্তিতে। আমেরিকার সেনসাস দফতর ও ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’ নামক একটি স্বাধীন ডিজিটাল তথ্য সংস্থা প্রদত্ত পরিসংখ্যানের সঙ্গে রাষ্ট্রপুঞ্জের এই অভিক্ষেপের মিল নেই। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ২০২১ সালের জনশুমারি হলেও ভারতে হয়নি।
তবে ‘ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ড’-এর তাৎপর্য গোটা দুনিয়াতেই ক্রমবর্ধমান। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশে জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ৮০টিরও বেশি দেশে খুব কম জন্মহারের কারণে জনসংখ্যা কমে গিয়েছে, ৫৫টি দেশে সরকার দম্পতিদের সন্তানধারণের জন্য প্রণোদনা দিচ্ছে, কিন্তু ছবিটি বিশেষ পাল্টাচ্ছে না। ভারতেও সামগ্রিক ভাবে এবং ১৮টি রাজ্যেজন্মহার মহিলাপিছু ২.১-এর নীচে— অর্থাৎ রিপ্লেসমেন্ট রেট-এর নীচে— নেমে গিয়েছে। একমাত্র বিহার ছাড়া বাকি রাজ্যগুলোতেও জন্মহার কমার প্রবণতা চোখে পড়ছে। অভিক্ষেপ হল, ভারতে ২০৬৪ সালের মধ্যে জনসংখ্যা বাড়বে আরও ৩০ কোটি। তার পরে জনসংখ্যার দ্রুত পতন ঘটবে। বর্তমানে ভারতের কর্মক্ষম লোকসংখ্যা ৫৪.২ কোটি— ২০৫০ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা আরও ১৮.৩ কোটি বাড়বে বলে আশা। অর্থাৎ, বিশ্বের প্রতি চার জন কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে এক জন হবেন ভারতীয়।
প্রশ্ন হল, এই জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে কি ভারত নিজের কাজে লাগাতে পারবে? এক দিকে, জনসংখ্যা বাড়লে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়বে। ভোগ্যপণ্যের বাজারের আয়তনের নিরিখে ভারত এখন বিশ্বে চতুর্থ বৃহত্তম— ২০৪৭ সালের মধ্যে এই বাজারের আয়তন আজকের দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা, ভারতের চেয়েও এগিয়ে থাকবে শুধু আমেরিকা আর চিন। ভারতে যে-হেতু মজুরির হার তুলনামূলক ভাবে কম, তাই এ দেশের পক্ষে বৈশ্বিক উৎপাদন-কেন্দ্র হয়ে ওঠাও সম্ভব। তথ্যপ্রযুক্তি ও ফার্মাসিউটিক্যাল ক্ষেত্রে ভারত ইতিমধ্যেই অগ্রগণ্য। অতীতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে, কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যা এক শতাংশ বাড়লে অর্থব্যবস্থায় মাথাপিছু আয় বাড়ে পাঁচ শতাংশ অবধি— জনসংখ্যার বৃদ্ধিজনিত সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারলে ২০৬১ সাল নাগাদ ভারতে মাথাপিছু জিডিপি-তে অতিরিক্ত ৪৩% বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
অন্য দিকে, ২০৪৭ সাল নাগাদ ভারতে কর্মক্ষম বয়স-বন্ধনীতে ১১০ কোটি লোক থাকবে, যা ইউরোপের সমগ্র জনসংখ্যার ১.৬ গুণ। বিশাল কর্মক্ষম জনসংখ্যা মানে কিন্তু বিপুল সংখ্যক শ্রমিক নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন, বা আইএলও) সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুসারে, ভারতে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট, বা সংক্ষেপে এলএফপিআর (অর্থাৎ, কর্মক্ষম বয়স-বন্ধনীতে থাকা জনসংখ্যার যত শতাংশ কাজ খুঁজছেন) ভারতে মাত্র ৫২%, যেখানে আমেরিকায় এই হার ৭৩%, চিনে ৭৬% এবং ইংল্যান্ডে ৭৮%। ভারতে পুরুষদের মধ্যে এলএফপিআর এই দেশগুলির সঙ্গে সমান হলেও, মহিলাদের মধ্যে এলএফপিআর ভারতে মাত্র ২২%, যেখানে উল্লিখিত দেশগুলিতে এটা গড়ে ৭০%। গত ১৫ বছরে মহিলাদের মধ্যে শ্রমশক্তিতে যোগদান প্রায় ১৫ শতাংশ-বিন্দু কমেছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আগামী ১০ বছরে ভারতে মহিলাদের জন্য ৪.৫ কোটি চাকরি তৈরি করতে হবে। আবার, ভারতে মোট কর্মসংস্থানের ৪৩% হয় কৃষিক্ষেত্রে; চিনে এই অনুপাত ২৫%, উন্নত দেশগুলিতে সাধারণত দুই শতাংশেরও কম। ভারতে যদি কৃষিক্ষেত্রের উপর এই অতিনির্ভরতা কমিয়ে ১৫ শতাংশে আনতে হয়, তা হলে আগামী ২৫ বছরে প্রায় সাড়ে ন’কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে শুধুমাত্র শ্রমশক্তির একটি অংশকে কৃষি থেকে অ-কৃষি কাজে রূপান্তর করতে। সব মিলিয়ে, আগামী ২৫ বছরে ভারতে আনুমানিক ২৩.১ কোটি কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।
এর জন্য প্রয়োজন গুণমান-সম্পন্ন স্কুলশিক্ষা, সম্পৃক্ত উচ্চশিক্ষা, শিল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ দক্ষতার উন্নয়ন, এবং সুস্বাস্থ্য। ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগানোর এগুলোই মৌলিক শর্ত। অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (এএসইআর)-২০২২ অনুযায়ী, অতিমারি-পরবর্তী সময়ে শিশুদের মৌলিক সাক্ষরতার স্তর এবং প্রাথমিক গাণিতিক দক্ষতা ২০১২-র আগের স্তরে নেমে গিয়েছে। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে একটি জাতীয় মিশন স্থাপন করে ২০২৫ সালের মধ্যে সমস্ত ছাত্রের ন্যূনতম সাক্ষরতা এবং প্রাথমিক গাণিতিক দক্ষতা অর্জনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে, ও রাজ্যগুলোকেও নিজেদের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে বলা হয়েছে। বলা হয়েছিল যে, ২০২৫ সালের মধ্যে স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০% শিক্ষার্থী বৃত্তিমূলক শিক্ষার সংস্পর্শে আসবে। ২০২৩ সালের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এই নীতির বাস্তবায়নের কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে কি?
ভারতে দক্ষতার ঘাটতি এবং দক্ষতার অমিল উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকে প্রভাবিত করতে পারে। মোট শ্রমশক্তির শতাংশ হিসাবে দক্ষ শ্রমিকের অনুপাত চিনে ২৪, আমেরিকায় ৫২, ইংল্যান্ডে ৬৮, জাপানে ৮০ হলেও ভারতে মাত্র তিন। কৃত্রিম মেধার দ্রুত অগ্রগতি বলছে যে, পরিষেবা-উপভোগ ক্ষেত্রে চাকরির বাজার ভবিষ্যতে ক্রমাগত সঙ্কুচিত হবে। ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের কম-বেশি ৩০% আসে শ্রমনিবিড় অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্র থেকে। এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগের উপর জোর দিলে তা ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি ভাল বিকল্প হতে পারে।
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে যে, বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোর্সগুলি শুধু স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের জন্যই নয়, চার বছরের সমস্ত মাল্টিডিসিপ্লিনারি স্নাতক কোর্সে নথিভুক্ত ছাত্রছাত্রীরাও তাতে ভর্তি হতে পারবে। সে খরচ কে জোগাবে, সে বিষয়ে অবশ্য শিক্ষানীতি সম্পূর্ণ নীরব। ভারতে শিক্ষাখাতে ব্যয় হয় জিডিপি-র তিন শতাংশেরও কম। অবিলম্বে এই খরচের পরিমাণ দ্বিগুণ করা বিধেয়। দেশের পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি বয়সের তুলনায় উচ্চতায় কম, এবং প্রায় এক-পঞ্চমাংশের উচ্চতার তুলনায় ওজন কম। এই অপুষ্ট শিশুরা কী ভাবে ভবিষ্যতে দক্ষ শ্রমিক হয়ে উঠবে?
১৯৯২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ভারতে প্রতি এক শতাংশ-বিন্দু জিডিপি বৃদ্ধি ঘটায় ১৩ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে। এই লেখায় আমরা দেখেছি যে, ভারতে এখন নতুন ২৩.১ কোটি কর্মসংস্থান প্রয়োজন। আয়বৃদ্ধির সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানের এই হারটি যদি অপরিবর্তিত থাকে, তা হলে ২৩.১ কোটি কর্মসংস্থান করতে প্রকৃত জিডিপি ২০৩০ সাল পর্যন্ত বার্ষিক গড়ে ১০.৪%, ২০৩১ এবং ২০৪০-এর মধ্যে ৬.৫% এবং ২০৪১ এবং ২০৪৭-এর মধ্যে ৪.২% বৃদ্ধি করতে হবে। এই বৃদ্ধির হার বজায় রাখতে পারলে ২০৪৭ সালের মধ্যে ভারত ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার আয়তনের অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে, এবং সেই সময়ের মধ্যে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি দাঁড়াবে ১৮৬০০ ডলার, যা ২০২২-এর তুলনায় প্রায় আট গুণ। এই বৃদ্ধি আদৌ সম্ভব কি না, আপাতত যদি সে প্রশ্ন বাদও দিই, প্রশ্ন হল যে, ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্যের কী হবে?
অক্সফ্যাম-এর রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতে মোট সম্পদের সিংহভাগ জনসংখ্যার একটা ছোট অংশের কুক্ষিগত, এবং অতিমারির সময়ে এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। অতিমারির প্রভাবে ভারতের জনসংখ্যার নীচের ৫০ শতাংশের সম্পদের পরিমাণ আরও কমেছে। অন্য দিকে, শীর্ষ ৩০% জনগণ ভারতের ৯০ শতাংশের বেশি সম্পদের মালিক। তাদের মধ্যেও ফারাক রয়েছে— জনসংখ্যার শীর্ষ ১০ শতাংশের হাতে রয়েছে ৭২ শতাংশ সম্পদ; শীর্ষ পাঁচ শতাংশের হাতেই রয়েছে ৬২ শতাংশ সম্পদ। এই অসাম্য অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পরিপন্থী।
আশঙ্কা যে, ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের আগে জনশুমারির কাজ শেষ হবে না। অথচ ডেমোগ্র্যাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে গেলে চাই সুনিৰ্দিষ্ট ও বহুমুখী পরিকল্পনা, আর তার জন্য চাই সাম্প্রতিকতম তথ্য— জনশুমারির ফলাফল ছাড়া যা পাওয়া অসম্ভব। চাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং সর্বোপরি পরিকল্পনা তৈরি ও তার রূপায়ণে শিক্ষাবিদ ও আমলাতন্ত্রের মেলবন্ধন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy