ঝোলা থেকে দুটো টিফিনবাক্স বার করে টেবিলের উপর রাখল তপেশ। লক্ষ্মীপুজোর প্রসাদ পাঠিয়েছেন পিসিমা। একটা বাক্সে ফল, অন্য বাক্সে মিষ্টি। মিষ্টির বাক্সটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ফলের বাটি থেকে শসার টুকরো তুলে নিলেন শিবুদা।
“মিষ্টি ফেলে শসা খাচ্ছেন, এ বার কি বানপ্রস্থ?” এক বারে একটা সন্দেশ মুখে পুরে খেতে খেতেই বলল শিশির।
“উঁহু, সংযম।” গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন শিবুদা। “শুগারটা যে রকম বেড়েছে, একটু সাবধান হওয়া ভাল।”
“ডায়েট করছেন? আমার আবার ডায়েট করলেই ভয়ানক ডিপ্রেশন হয়।” তপেশও মিষ্টির বাক্সে হাত চালাল। তার পর গলা তুলে হাঁক ছাড়ল, “গোপালদা, পিসিমা প্রসাদ পাঠিয়েছে, নিয়ে যাও।”
“একেবারে চা-টা নিয়েই আয়, গোপাল। আমারটায় চিনি দিস না,” শিবুদাও সাড়া দেন। “তবে তোপসে, কথাটা তুই নেহাত ভুল বলিসনি। ডায়েটিংয়ের সঙ্গে মনের সুগভীর সম্পর্ক আছে। অকারণে বসের কাছে ঝাড় খেলে যা হয়, তিন-চার পেগ হুইস্কি খেয়ে ফেললে যা হয়, মরা গরিব হলে যা হয়, ডায়েটিংয়েও তা-ই হয়। মন তোর বশে থাকে না।” বিরস মুখে আর একটা শসা তুললেন শিবুদা। জুলজুল করে মিষ্টির বাক্সটার দিকে তাকালেন।
“বৌয়ের ঝাড়ের আর আপনি কী জানেন!” মিয়োনো গলায় বলে শিশির।
“বৌ বলিনি যদিও, বস বলেছিলাম, কিন্তু তোর মনোবেদনা বুঝতে পারছি,” শিশিরের মিসপাসকে সোজা গোলে পাঠিয়ে দিলেন শিবুদা। “বৌ হোক বা বস, সমস্যা হল, সমস্ত ধমক খেয়েও হাসিমুখে সয়ে যেতে হয়। আর, তাতেই চাপ পড়ে মগজের ব্যান্ডউইডথ-এর উপর।”
গোপাল এসে টেবিলের উপর চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে। কার্তিক মাসেও বৃষ্টি হয়েই চলেছে, গোপালের দোকানে অন্য লোক নেই আজ। শিবুদা চায়ের কাপে চুমুক দেন, তার পর শিশিরের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরান।
“মগজের ব্যান্ডউইডথ? ইন্টারনেট নাকি মশাই?” সূর্য প্রশ্ন করে।
“সেন্ধিল মুলাইনাথন আর এল্ডার শাফির যখন কথাটা ব্যবহার করেছিল, তখন ইন্টারনেটের কথাই ভেবেছিল। তবে, আজকের ইন্টারনেট নয়, বছর দশ-বারো আগেকার। যখন এক এমবিপিএস স্পিডকেও কল্পবিজ্ঞানের গল্প মনে হত,” চা শেষ করে কাপটা নামিয়ে রাখেন শিবুদা। “এ বার নিজের মগজকে সেই কম ব্যান্ডউইডথ-এর ইন্টারনেটের সঙ্গে তুলনা করে দেখ। আমাদের মাথাকে, থিয়োরেটিক্যালি, দু’ভাগে ভাঙার কথা বলেছিলেন ড্যানিয়েল কানেম্যান— সিস্টেম ওয়ান আর সিস্টেম টু। প্রথমটা কাজ করে নিজে থেকেই। দুই দু’গুণে কত, জানতে চাইলে তোকে নামতা পড়তে হবে না, তোর মন আপনাসেই উত্তর দিয়ে দেবে। কিন্তু পাঁচশো বাহাত্তরকে তিনশো আটষট্টি দিয়ে গুণ করলে কত হবে, তোর মন জানে না। তার জন্য সিস্টেম টু-কে কাজে লাগাতে হবে। শুধু অঙ্ক করাই নয়, যে সব কাজের জন্য আমাদের সচেতন ভাবে ভাবতে হয়, সেগুলো সিস্টেম টু-র আওতায় পড়ে।
“এ দিকে, তার ধারণক্ষমতা সীমিত— পুরনো ইন্টারনেট কানেকশনের মতো। তার উপর বেশি চাপ পড়লেই সিস্টেম টু গড়বড় করতে আরম্ভ করে। ধর, তোকে একটা অচেনা ফোন নম্বর বললাম— পাঁচ মিনিট পরে স্মৃতি থেকে সেই নম্বরটা তুই আমায় বলবি। এই মনে রাখার কাজটা করবে সিস্টেম টু। এ বার তোকে বললাম, ফোন নম্বর বলার আগে মুখে মুখে আমায় সাঁইত্রিশের নামতা বল। এতে তোর ব্যান্ডউইডথ-এর উপর চাপ বাড়ল। এই অবস্থায় যদি তোকে একটা অজানা ফরাসি শব্দ শুনিয়ে বলি যে, ফোন নম্বরের সঙ্গে এই শব্দটাও আমায় বলতে হবে, তা হলে তোর সিস্টেম টু হাল ছেড়ে দেবে। তিনটের মধ্যে একটা কাজও পারবি না ঠিক করে।” একটানা কথা বলে ফলের বাক্স থেকে একটা আঙুর তুলে মুখে দিলেন শিবুদা। তার পরই শিউরে উঠলেন। আঙুরগুলো বিষ টক।
“কিন্তু শিবুদা, এর মধ্যে নতুন কথা কোনটা? এক সঙ্গে অনেকগুলো জিনিস মাথায় রাখতে হলে সব গোলমাল হয়ে যায়, এটা তো নিতান্ত কমনসেন্স।” শিবুদার কথায় আশ্চর্য হয়ে আপত্তি করে সূর্য।
“যে কথা নিতান্ত কমনসেন্স, শিবু সেন সেটা নিয়ে বাগ্বিস্তার করেন না, কমরেড। একটু ধৈর্য ধরো,” মুচকি হেসে সূর্যকে উত্তর দেয় তপেশ।
“আসলে কী জানিস, সিস্টেম টু-র উপর বেশি চাপ পড়লে এই কমনসেন্স জিনিসটাও ঘেঁটে যায়।” শিবুদা আবার কথার সূত্র ধরে নেন। “যে সব কাজ করতে মনের জোর লাগে— মানে, নিজের তাৎক্ষণিক ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে যে সব কাজ করতে হয়— তার প্রতিটাতেই সিস্টেম টু-র উপর চাপ পড়ে। যেমন ধর বসের কাছে অন্যায় কারণে বকুনি খাওয়া। ইচ্ছে করছে পাল্টা চিৎকার করে তার ভুলটা ধরিয়ে দিতে, এ দিকে তুই ‘আই অ্যাম সরি স্যর’ বলে চলেছিস— এটা যে মনের উপর কতখানি চাপ তৈরি করে, সে তো জানিসই। দীর্ঘ ক্ষণ ধরে সেই চাপ সহ্য করলে যা ঘটে, তার নাম ‘ইগো ডিপ্লিশন’— যাকে বলতে পারিস ইচ্ছাশক্তির ক্ষয়। কারও ইচ্ছাশক্তি যদি সিস্টেম টু-র উপর কোনও দীর্ঘমেয়াদি চাপের ফলে যথেষ্ট ক্ষয়ে যায়, সেই মুহূর্তে তার সিস্টেম টু ভুল সিদ্ধান্ত করবে। ধর, তুই ডায়েটিং করছিস। খুব সম্ভাবনা আছে যে, বসের কাছে প্রবল বকুনি খাওয়ার পর খেতে গেলে তুই স্যালাডের বদলে কেক খেয়ে ফেলবি, অথবা ফ্রায়েড চিকেন।
সমস্যাটা যদিও স্ট্রেস ইটিংয়ের চেয়ে গভীরতর। মুলাইনাথন আর শাফির তামিলনাড়ুর এক বাজারের কিছু গরিব খুচরো বিক্রেতাকে নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিল। সেই বিক্রেতাদের সবারই সমস্যা এক— তাঁরা প্রত্যেকেই বেজায় গরিব; প্রতি দিনের ব্যবসার জন্য যেটুকু পুঁজি লাগে, তাঁদের কারও সেটুকুও ছিল না। ফলে, প্রতি দিন সকালে তাঁরা ধার করতেন; দিনের বেচাকেনা শেষ করে প্রাত্যহিক পাঁচ শতাংশ সুদসমেত টাকা ফেরত দিয়ে বাড়ি যেতেন; পরের দিন আবার ধার, আবার ধার শোধ। এই বিক্রেতাদের মধ্যে কিছু লোককে র্যান্ডমাইজ়ড ট্রায়ালের মাধ্যমে বেছে নিয়ে সেই পুঁজিটুকু তাঁদের দেওয়া হল— লটারি পাওয়ার মতো। অন্যরা যেমন ছিলেন, তেমন থাকলেন। দেখ, যেখানে হাজার টাকা ধার করলে প্রতি দিন পঞ্চাশ টাকা সুদ দিতে হয়— দিনের লাভের প্রায় অর্ধেকটা— সেখানে কমন সেন্স তো বলবে, যে ভাবেই হোক এই গবেষকদের দেওয়া পড়ে পাওয়া মূলধনটুকু বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। কিন্তু, দেখা গেল, বছর ঘুরতে ঘুরতে প্রত্যেক ‘লটারিজয়ী’ বিক্রেতা ফিরে গেলেন দৈনিক ধারের চক্করে। মুলাইনাথনরা কিন্তু কাণ্ডজ্ঞানের অভাবের দোহাই দেননি। বরং বলেছেন, দারিদ্র তাঁদের সিস্টেম টু-র উপর নিরন্তর যে চাপ তৈরি করে, তাতে তাঁদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের কথা মাথায় রেখে চলার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।”
“দারিদ্র সে সুকঠিন, তা তো বুঝলাম। কিন্তু, সিস্টেম টু-র উপর চাপ তৈরি করবে কেন?” প্রশ্ন করল সূর্য।
“করবে, কারণ দারিদ্র প্রতি মুহূর্তে মানুষকে খুব জটিল সব সিদ্ধান্ত করতে বাধ্য করে,” ডান হাত দিয়ে টেবিলের উপর একটা চাপড় মেরে বললেন শিবুদা। “বাবার ওষুধ কিনতে গেলে ছেলের স্কুলের মাইনে বাকি পড়ে যাবে, ভেঙে যাওয়া টালির চাল সারাতে গেলে হাত পড়বেই দু’মাস পরে মেয়ের বিয়ের জন্য জমিয়ে রাখা টাকায়। মুলাইনাথন লিখেছিল, গরিব মানুষ প্রতি মুহূর্তে অনেকগুলো সমস্যার বল নিয়ে জাগলিং করছে। যে বলটা যখন নেমে আসছে, শুধুমাত্র সেটার দিকে মন দেওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। ফলে, অন্য অনেক সমস্যা থেকে যাচ্ছে— সেগুলোর যেটা যখন নেমে আসবে, তখন সে দিকে মন দিতে হবে। মাঝেমধ্যেই হাত ফস্কায়, সমস্যার বল মাটিতে পড়ে কেলেঙ্কারি হয়— তার পর আবার আরম্ভ হয় একই খেলা। সিস্টেম টু-র উপর এই নিরন্তর চাপ তাদের ‘বোকা’ করে তোলে। এটা কিন্তু কথার কথা নয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, সিস্টেম টু-র উপর প্রবল চাপ পড়লে মানুষের বুদ্ধ্যঙ্ক ১৫ পয়েন্ট অবধি কমে যেতে পারে। শুধু টাকার অভাবই নয় কিন্তু, যে কোনও অভাবই মগজকে এই ভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। সময়ের অভাবও পারে। ইচ্ছাশক্তি বস্তুটা যথেষ্ট শক্তপোক্ত নয়, বুঝলি।” কথা শেষ করে মিষ্টির বাক্সে পড়ে থাকা শেষ সন্দেশটা তুলে নিলেন শিবুদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy