শিল্পবান্ধব’ ভাবমূর্তি গড়তে দেশের বড় বড় শিল্পপতিদের ডেকে বছর বছর সভা করেছে তৃণমূল সরকার। দেশবিদেশের কত সংস্থা লগ্নি করতে আসছে বাংলায়, তার প্রচারে বারবার মুখর হয়েছে মিডিয়া। অথচ, বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সঙ্কট নিয়ে সবাই নীরব। স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (‘সেল’) একটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত দুর্গাপুর এবং বার্নপুরের ইস্পাত কারখানার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কলকাতায় সেল-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ দফতর— কাঁচামাল সরবরাহ বিভাগ (‘র মেটিরিয়াল ডিভিশন’, সংক্ষেপে আরএমডি) উঠিয়ে দেওয়া হল। তার ফলে বহু কর্মী কর্মহীন হবেন বলে আশঙ্কা। এ নিয়ে রাজ্যে কোনও প্রচার, বিক্ষোভ, মিছিল নেই। এমনকি, এই সিদ্ধান্ত ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কী ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলেননি। যেন এই প্রশ্নগুলির সঙ্গে জনস্বার্থের সংযোগ নেই।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘সেল’ ঘোষণা করেছে, কাঁচামাল সরবরাহের বিভাগকে ভেঙে ফেলে সরিয়ে দেবে কলকাতা থেকে। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র প্রতিবাদ করে লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দফতর নরেন্দ্র মোদী সরকার ইতিপূর্বে অন্যত্র সরিয়েছে। তিনি আশ্বাস চেয়েছেন, সেল-এর ‘আরএমডি’ দফতর যেন না সরে। কেন্দ্রের ইস্পাতমন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান নীরব। এই ক্ষরণ রুখতে শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিরোধ প্রয়োজন, যার অভাব দেখা যাচ্ছে। সকলের মনোভাবটা এমন যেন, এতে কী আর এমন ক্ষতি হবে? পশ্চিমবঙ্গবাসী দেশভাগের ক্ষতি সহ্য করে নিল, সামান্য একটি দফতর বন্ধ হওয়ার কষ্ট দু’দিনেই ভুলে যাবে।
বাস্তব অত সহজ নয়। দেশভাগের বিষময় ফল আজও আমরা ভোগ করছি। তেমনই, ভারতের সর্ববৃহৎ (মহারত্ন) সরকারি ইস্পাত সংস্থার কলকাতার দফতরটি বন্ধ করার ফলও হতে পারে সুদূরপ্রসারী। অনেকেই এতে ইস্পাতশিল্পে দুর্দশার অশনিসঙ্কেত দেখছেন। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ভেঙে ফেলে বিক্রি করে দেওয়ার ধারা অনেক আগেই শুরু হয়েছে। জওহরলাল নেহরুর প্রচেষ্টায় নির্মিত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর পিছনে দেশবাসীর অনেক ত্যাগ স্বীকার আছে। মানুষ জমি দিয়েছিল, শ্রম দিয়েছিল। সর্বোপরি, এই সংস্থাগুলো জনগণের করের টাকায় তৈরি হয়েছিল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণের দিকে যাচ্ছে কি না, গেলে সেটা কার স্বার্থে, সে প্রশ্নটা বার বার তোলা দরকার।
কাঁচামাল সরবরাহ বিভাগ তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে সর্বাধিক ঝুঁকির মুখে পড়ল দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানা আর বার্নপুরের ইস্কো ইস্পাত কারখানা। রাজ্যের বৃহৎ শিল্পের চিত্রে যা শিবরাত্রির সলতে। কী সেই ঝুঁকি, তা বুঝতে চাইলে ফিরে তাকাতে হবে অতীতের দিকে। ইস্পাত তৈরির প্রধান উপকরণ আকরিক লোহা। আশির দশক অবধি প্রতিটি ইস্পাত কারখানার অধীনে একটি কি দু’টি স্বায়ত্ত খনি (‘ক্যাপটিভ মাইন’) ছিল। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট এক বা একাধিক খনি থেকেই একটি কারখানা তার কাঁচামাল পেত। এর ফলে সমস্যা হত সেই সব কারখানার, যার সঙ্গে সংযুক্ত খনির আকরিক লোহার মান যথেষ্ট ভাল নয়। ওই সব কারখানার ইস্পাতের মানও ভাল হত না।
এই সমস্যা এড়াতে সেল একটি বিভাগ শুরু করে, যা পূর্ব ভারতের দশটি খনি থেকে লোহা-সহ অন্যান্য খনিজ দ্রব্য কিনবে, এবং সেল-এর ছ’টি ইস্পাত কারখানায় সেগুলি সুষম বণ্টন করবে। ইস্পাত মন্ত্রকও সেই সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছিল। অবস্থানগত সুবিধের জন্য কলকাতায় তার প্রধান দফতর তৈরি হয়। ১৯৮৯ সালে কাঁচামাল সরবরাহ বিভাগ (‘র মেটিরিয়াল ডিভিশন’) কাজ শুরু করে। দক্ষ মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়োগ করা হয়, যার ফলে ক্রমশ আকরিক লোহার উৎপাদন ও মান বাড়ে। আজ সেল বাজারদরের পাঁচ থেকে ছয়গুণ কম দামে আকরিক লোহা পাচ্ছে, তাই ইস্পাত বিক্রি করে তার মুনাফা বাড়ছে।
তিন দশক পরে সেল সিদ্ধান্ত নিল, ফিরে যাওয়া হবে আগের ব্যবস্থায়। ফের খনিগুলি আসবে ইস্পাত কারখানার পরিচালকদের অধীনে। কলকাতায় স্বতন্ত্র বিভাগ থাকবে না, ঝাড়খণ্ডের খনিগুলি বোকারো ইস্পাত কারখানা, এবং ওড়িশার খনিগুলি রৌরকেলার ইস্পাত কারখানা পরিচালনা করবে। এর কারণ কী, তা সেল-এর কোনও কর্তা প্রকাশ্যে ব্যাখ্যা করেননি। সংবাদমাধ্যমে শিল্পমহলের খবরে জানা গিয়েছে, কলকাতায় একটি বড়সড় দফতর চালানোর খরচ বাঁচাতেই নাকি এমন সিদ্ধান্ত। যে সমস্যার জন্য কলকাতায় পৃথক দফতর তৈরি হয়েছিল, তার নিরসন কী করে হবে? ব্যাখ্যা নেই।
আরও প্রশ্ন উঠেছে, সেল-এর প্রধান দফতর রাঁচীতে ছিল, কারণ অধিকাংশ লোহার খনি আর স্টিল কারখানা পূর্ব ভারতে। তা সরানো হয় দিল্লিতে। কলকাতার দফতর সরানো হলে, দিল্লির দফতর রাঁচীতে ফিরছে না কেন? আবারও ব্যাখ্যা নেই।
এর ফলে ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বার্নপুর, দুর্গাপুরের কারখানার, কারণ তাদের ‘ক্যাপটিভ মাইন’ রইল না। ২০০৬-এ সেল-এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার আগে বার্নপুর ইস্কো কারখানার অধীনে ছিল দু’টি খনি, গুয়া আর চিড়িয়া। ঝাড়খণ্ডের এই খনি দু’টিতে প্রচুর পরিমাণে উন্নত মানের আকরিক লোহা পাওয়া যায়। এগুলির মালিকানা প্রাপ্তি ছিল সেল কর্তৃপক্ষের কাছে ইস্কো অধিগ্রহণের অন্যতম কারণ। এত দিন বাংলার দু’টি কারখানার সমস্যা হয়নি, কারণ সেল-এর স্বতন্ত্র বণ্টন বিভাগের কাছে সব ইস্পাত কারখানার গুরুত্ব সমান ছিল। কিন্তু বোকারো অথবা রৌরকেলার পরিচালকেরা কি নিজেদের কারখানার সমান গুরুত্ব দেবেন পশ্চিমবঙ্গের কারখানাকে?
কেন্দ্রীয় ইস্পাতমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন যে, বাংলার আকরিক লোহার জোগানে সমস্যা হবে না। কিন্তু অভিজ্ঞমহল জানেন, কেবল সদিচ্ছার ভিত্তিতে কোনও বাণিজ্যিক ব্যবস্থা চলে না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই হোক, অথবা স্রেফ অবহেলার জন্য, দুর্গাপুর আর বার্নপুর কারখানার জন্য আকরিকের জোগান কমার সম্ভাবনা যথেষ্ট। এর ফলে তাদের উৎপাদন হ্রাস পাবে। তখন ওই দু’টি কারখানাকে ‘অলাভজনক সংস্থা’ বলে চিহ্নিত করা সহজ হবে। এই ভাবে বাংলার ইস্পাত কারখানা বিক্রি করার প্রক্রিয়ার সূচনা হল কি না, সেই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে আসানসোল থেকে বর্ধমান, সর্বত্র। তেমন ঘটলে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে।
সেল তিন দশক একটা ব্যবস্থা চালিয়ে, যথেষ্ট লাভ করেও ফের পুরনো ব্যবস্থায় ফিরছে। অনেকে মনে করেন, এই আপাত-অর্থহীন, ব্যাখ্যাহীন সিদ্ধান্তের পিছনে কাজ করছে গূঢ় উদ্দেশ্য— বেসরকারিকরণ। পূর্ব ভারতে দশ-এগারোটি খনি, ছয়টি ইস্পাত কারখানার মালিক ‘সেল’ এত বৃহৎ এক সংস্থা যে, তা এক জন মাত্র শিল্পপতির পক্ষে কিনে ফেলা সম্ভব নয়। বিক্রি করতে হলে প্রথমে টুকরো করতে হবে। খনির সঙ্গে কারখানাকে ফের জুড়ে দেওয়া কি তবে শেষের শুরু? কারণ, নিজস্ব খনি না থাকলে ইস্পাত উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন না অধিকাংশ শিল্পপতি। এর পিছনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাও দেখছেন অনেকে। প্রশ্ন করছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি হেরে না গেলে কি সেল-এর কলকাতার দফতর সরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হত? সর্বোপরি, ইস্কো-র থেকে তার খনিকে বিযুক্ত করা কি প্রতারণা নয়? রাজেন মুখোপাধ্যায়-বীরেন মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত ‘ইস্কো’ পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-ঐতিহ্যের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ। তার সঙ্গে জড়িয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা। কী তার ভবিষ্যৎ, সে প্রশ্নটা ক্রমশই বড় হয়ে উঠছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy