সংগ্রাম: আর জি কর-কাণ্ডে ন্যায়বিচারের দাবিতে নাগরিক মিছিল। ২৯ অগস্ট, কলকাতা। ছবি: সুমন বল্লভ।
সময়টা খুব অন্য রকম। এক নৃশংস ঘটনার পর তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত, তদন্ত শ্লথ, বিচার সুদূর: হতাশার ঘন মেঘে ডুবে আছি অনেকেই। এক সঙ্কট না কাটতেই আর এক বিপদ, অত্যাচারের পাশে আক্রমণ। তবু, এই সবই শেষ নয়। বড় সঙ্কট আর বড় সম্ভাবনা কী ভাবে পাশাপাশি আসতে পারে তাও দেখছি আমরা। চোখের সামনে তৈরি হয়ে উঠছে একটা বিরাট কিছু, নতুন কিছু, যেমনটা আমরা খুব একটা দেখিনি। এ কি একটা জনজাগরণ? নবজাগরণও কি?
‘জাগরণ’ নিয়ে ইতিমধ্যেই নানা আলোচনা, তর্ক ভাসমান। এর মধ্যে কতটা রাজনৈতিক, কতটা অরাজনৈতিক, তা নিয়ে মতান্তর, মনান্তর। প্রশ্ন উঠেছে যে, এই দু’কূল ভাসানো প্রতিবাদ যখন রাজ্যের শাসকেরই বিরুদ্ধে, কেবল একটা অপরাধের বিরুদ্ধে নয়, অপরাধ চাপা দিয়ে অপরাধীকে আড়াল করার নির্লজ্জ সরকারি স্পর্ধার বিরুদ্ধে— তখন কি আদৌ আর প্রতিবাদকে অরাজনৈতিক রাখা যায়?
প্রশ্নটা ভাবানোর মতো। কোনটাকে বলে রাজনীতি, কোনটা অরাজনীতি, সেটা ফিরে ভাবার মতো। আমরা বুঝতে পারছি, রাজনীতি-অরাজনীতির ফাঁদে আমাদের ফেলে দিয়েছে আমাদেরই চার পাশের শাসক ও বিরোধী বৃত্তেরা, যার দু’পক্ষেই রয়েছে বড় মাপের সব সুযোগসন্ধানী, দুরাচারী।
আমাদের এক দিকে শাসকের অসহনীয় দুঃসাহস ও দুঃশাসন। এত বড় অন্যায়কে ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত তাঁরা (না হলে প্রথমেই ‘আত্মহত্যা’ বলা হল কেন); অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলার পথে এগোতে তাঁরা নারাজ (না হলে সন্দীপ ঘোষকে রাতারাতি অন্য হাসপাতালের শীর্ষ পদে পুনর্বহালের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল কেন); অন্যায়ের তদন্তে বাধা তৈরি করতে উদ্যত কর্তৃপক্ষ (না হলে পরের দিনই অকুস্থলে ঘর ভাঙচুরের অনুমতি মেলে কী করে)। এর পরেও আরও একটা কথা। রাজ্যের শাসকরা নিশ্চয়ই বুঝেছেন, কী ভাবে আমাদের মধ্যে তাঁরা ক্রোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। বুঝেছেন যে এই জনক্ষোভের বিস্ফোরণ শুধু একটি ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় নয়, একের পর এক প্রবল দুর্নীতি ও অন্যায় চালিয়ে যাওয়ার যে দুঃসহ স্পর্ধা, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ আজ উদ্গীর্ণ গলিত লাভার মতো তাঁদের পুড়িয়ে ফেলার উপক্রম করেছে। কিন্তু তবু— শাসকরা ক্ষমা চাননি। কেননা তাঁরা বিচরণ করছেন স্পর্ধার এক অন্য মাত্রায়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উচিত ছিল রাজ্যবাসীর সামনে হাত জোড় করে এসে দাঁড়ানো, অন্যায় ও মিথ্যের জাল কেটে বেরিয়ে এসে এক বার, অন্তত এক বার, দৃষ্টান্তমূলক প্রশাসনিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। দুর্নীতি দমনের সরকারি সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতির প্রতি মানুষের সমস্ত আস্থা আজ শেষ। সেই আস্থা আর কোনও দিন ফিরবে কি না জানা নেই, কিন্তু তা ফেরানোর চেষ্টাও যদি করতে হয়, মুখ্যমন্ত্রীর আজ নত হওয়ার কথা ছিল। প্রত্যাশিত ভাবেই, তিনি ও তাঁরা তা করেননি। বরং বুঝিয়ে দিয়েছেন, জনতার এত বড় ক্ষোভও তাঁদের গলার স্বর নামিয়ে কথা বলতে শেখাতে পারে না।
অন্য দিকে, বিরাট সুযোগ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছে প্রধান বিরোধী দল। অথচ অন্যায়, দুর্নীতি, নারীনিষ্পেষণ, নাগরিক নির্যাতন, সমস্ত কিছুতে তাদের রেকর্ড ইতিমধ্যেই গোটা দেশে ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় এসে সেই দুর্নীতি-দুরাচারের জটিলকুটিল জটা খুলে তাঁরা সুশাসনের প্রবাহিণী বইয়ে দেবেন বুঝি? অবাধে নারীবিরোধী, বাক্স্বাধীনতা বিরোধী অকথা-কুকথায় গা ভাসিয়ে অন্যদের তাঁরা হুমকি দিচ্ছেন সেই একই নির্যাতন ও ধর্ষণের ভাষায়— ঠিক যে কাজের বিরোধিতা করতেই নাকি তাঁরা এসেছেন! ফলে বিরোধী রাজনীতির ফাঁদটাও আজ রাজ্যবাসীর সামনে ভয়ানক আকারের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-শাসিত রাজ্য আজ ফুঁসে উঠে নেত্রীকে কতটা কোণঠাসা করেছে, সে আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু একই ধরনের অন্যায় যে অন্যান্য প্রদেশে ঘটে চলেছে, সেখানে কি এর একাংশ প্রতিবাদও দেখা গিয়েছে— নাগরিক? প্রশাসনিক? রাজনৈতিক? এত বড় সুবিধাবাদ আর মিথ্যাচার কি সহ্য করতে পারি আমরা, যখন অন্যায়ের প্রতিকারের দাবিটিকে জ্বালিয়ে রাখাটাই আমাদের কাজ?
তাই, গণতন্ত্র ফেরানোর নামে ভয়ানকতর স্বৈরতন্ত্র, রাজ্যের বিপন্ন স্বাধীনতার নিরাময়ের নামে কেন্দ্রের বিষমতর পরাধীনতা— এই সবের মধ্যে আমাদের, প্রতিকারকামী প্রতিবাদীদের, পরিস্থিতি কঠিন থেকে কঠিনতর। বিজেপি রাজনীতির ঘোলাটে বিষ ডুবিয়ে দিচ্ছে তৃণমূল শাসকের বিষাক্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে নাগরিক বিরোধিতাকে। বাম দল, কংগ্রেস দলও কি পারছে তেমন কর্মসূচি সামনে রাখতে, জনমনকে আশ্বাস দিতে? এর মধ্যে, যে জন আছেন মাঝখানে, সেই নাগরিক বিভ্রান্ত বোধ করছেন, কী ভাবে দেখব আমরা আজ, আমাদের প্রতিবাদকে? নিজেদের দায়কে? তাকে কি আমরা অরাজনৈতিক রাখতে চাইব, সে কি আদৌ সম্ভব? না কি বলব যে রাজনৈতিক ছাড়া এর কোনও চরিত্র থাকতেই পারে না? তা হলে কেমন হবে সে রাজনীতির চেহারা? এই পরিস্থিতিতে শোনা যাচ্ছে আগামী নাগরিক মিছিলের বড় লক্ষ্য ‘পলিটিসাইজ়েশন’ না হতে দেওয়া, কেননা তা ‘ডাইলিউট’ করে দিচ্ছে প্রতিবাদের জোরকে। উল্টো দিকে, আর এক দল বলছেন, ‘পলিটিসাইজ়েশন’ ছাড়া এগোনোই সম্ভব নয়, যাঁরা সে চেষ্টা করছেন তাঁরা আসলে শাসকের হাত শক্ত করছেন।
এই সব সঙ্কট এখন সচেতন, সতর্ক রাজ্যবাসীর প্রতি মুহূর্তের উদ্বেগ। উদ্বেগে দগ্ধ হতে হতে হঠাৎ যেন একটা আলো পেলাম। হাওড়ার তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের সেই শিক্ষিকা স্কুলের ছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে যে বক্তৃতা দিয়েছেন, আজ তা সমাজমাধ্যমে ভাইরাল। বিপন্ন কৈশোরকে তিনি বলেছেন, কী ভাবে বয়সে ছোট হয়েও তাদের সচেতন হতে হবে, অন্যের দুঃখকে নিজের বলে মনে করতে হবে, তা নিয়ে যতটুকু সাধ্য কিছু করতে হবে। ‘নিজের গলাটা ছাড়তে হবে।’ বুঝতে হবে, মেয়েদের জন্য যদি কিছু করতে হয়, তা হলে মেয়েদের আটকে রেখে তা করা যায় না, সমাজটাকে পাল্টাতে হয়। এই কথাগুলি তিনি নিশ্চয়ই রোজ বলেন না, এই ঘটনাই তা ছাত্রীদের সামনে বলার সুযোগ করে দিয়েছে। এই যে কথাগুলি ভাবা, বলা, শেখানো— এই কাজটাই কি এক অর্থে রাজনীতি নয়? এই যে এত সাধারণ মানুষ একটা অন্যায়ের প্রতিকার চাই বলে পথে নেমে আসছেন, যাঁরা কোনও দিনও মিছিলে মিটিংয়ে পা মেলাননি তাঁরাও বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কিছু না করে পারছেন না— এ যদি অরাজনীতি হয়, রাজনীতি ঠিক কী?
রাজনীতি ঠিক কী— এর উত্তর খুঁজলে দেখব, আজ কোনও একটি দলের সঙ্গে পা-মেলানো রাজনীতি ছাড়া বাকি সব আমরা ভুলে গিয়েছি। এটাই আমাদের আজকের গণতান্ত্রিক ভোট-ব্যবস্থার তৈরি করা বিকার, যার গ্রাসে পড়ে সমাজমনে রাজনীতি শব্দের অর্থটাই পাল্টে গিয়েছে। অর্থটা হয়ে গিয়েছে বড্ড ছোট, সঙ্কীর্ণ, কোনও না কোনও ঠুলির মধ্যে পোরা, দলের চিহ্নে ঠাসা। কবিতায় পড়েছিলাম: “কী কাজ কী কথা সেটা তত বড় কথা নয়/ আগে বলো তুমি কোন দল/... বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও/ প্রশ্ন করো তুমি কোন দল” (শঙ্খ ঘোষ)। আর এখন আমরা নিজেরাই কোনও কাজ করার আগে নিজেদের প্রশ্ন করতে শুরু করে দিই— আমি কোন দল, আমি কোন দল।
এই শিক্ষিকার ছাত্রী হতে পারলে হয়তো শিখতাম, সামাজিক অপরাধ বিষয়ে সচেতন হয়ে কিছু ভাবা, অন্যের যন্ত্রণা পেয়ে কিছু করা, শাসকের কাছে ন্যায় দাবি করা— এটাই একটা বড় কাজ। এটাই রাজনীতি। সেই রাজনীতির বোধের কাছে ছোট-বড় নেই। এ-দল ও-দল নেই। রবীন্দ্রনাথ পড়লে জানতাম, ‘সামাজিক সাধ্য’-কে কাজে লাগিয়ে কিছু করাটাই রাজনীতির পথ, কারণ সে কাজ নিরাময়ের লক্ষ্যে, প্রতিকারের লক্ষ্যে। আসলে, রাজনীতিকে কেবল দলের কাজ না ভেবে ব্যক্তির নিজের কাজ ভাবলে হয়তো একটা দিশা মেলে। দলের সঙ্গে ব্যক্তি-আমি যদি নিজেকে না মেলাই, নিজের মতো চলি, আর দল যদি নিজেকে ব্যক্তির সঙ্গে মেলাতে আসে কষ্ট করে, তবেই হয়তো ঠিক হয়।
তেমন অনেককে দেখছি আজ চার পাশে। এই মুহূর্তটা তাই খুব অন্য রকমের। রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা, গোটা দেশেই— কিন্তু এ ভাবে তো স্বতঃস্ফূর্ত দলবিহীন মানুষকে সর্বত্র এগিয়ে আসতে দেখি না! পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ লক্ষ মানুষ ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের মতো চলার রাজনীতিটা তাঁরা অনেকের চেয়ে ভাল জানেন। দল বুঝে নিক তারা কী করবে। শাসক, বিরোধী, সবাই দেখে নিক— মানুষের কত জোর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy