শেষ পর্যন্ত প্রখর উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথের বাধাগুলো দ্রুত অপসারিত হচ্ছে তবে। উন্নয়নের সেই অ-সাধারণ পথে একটা বড় বাধা কাটানো গেল— জঙ্গল কেটে ফেলতে হলে আর জঙ্গলবাসী মানুষদের থেকে অনুমতি নিতে হবে না। খোদ প্রধানমন্ত্রী জানালেন, কারখানা কিংবা রাস্তা, বা শহর বানানোর, বা শিল্প স্থাপনের প্রয়োজনে জঙ্গল কাটতে হলে সেখানে বসবাসকারীদের অনুমতি নেওয়ার কোনও দরকার হবে না। তাঁদের কেবল কিছু মূল্য ধরে দিলেই হবে— যাতে সেই সব ‘অনুন্নত’ লোকজন বিনা আপত্তিতে ওই টাকা নিয়ে দেশের উন্নয়নের পথ থেকে অন্য কোথাও সরে যান।
এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট, মানে একটা বড়সড় উন্নয়নের কাজ করতে গেলেই ‘পরিবেশের উপর তার ফলাফল বিচার করা’-র যে অনর্থক জটিলতা এত দিন বাধ্যতামূলক ছিল, বা এলাকার লোকেদের ‘জনমত নেওয়া’— সে সব বাধা অতিমারির মধ্যেই দূর করা গিয়েছে। অর্থাৎ, ‘পরিবেশ সুরক্ষা’ বিষয়ে যে সব কাজকে ক্ষতিকারক ও বে-আইনি করে রাখা হয়েছিল, গত কয়েক বছরে তার প্রত্যেকটিকে আইনি করে নেওয়া গেল। দু’-একটা বড় বাধা এখনও আছে— খোলামুখ খনি, নদীতে বড় বাঁধ দেওয়া, জঙ্গল কেটে নেওয়া, এ রকম অত্যন্ত জরুরি কাজ করার বিরুদ্ধে কিছু অনুচিত রক্ষণশীলতার বাধা। এগুলোও ক্রমশ সরিয়ে ফেলা হচ্ছে— আশা করা যায়, কিছু দিনের মধ্যেই এই সব বালাইও ঘুচবে।
‘শুভনাস্তিক’রা অবশ্য কিছু প্রশ্ন তুলতে পারে। ২০০৬ সালে অরণ্য অধিকার আইনে আদিবাসী আর বনবাসীদের তাঁদের জমির উপর অধিকারের পাট্টা দেওয়া হয়। আইন হয় যে, গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া বনের জমি অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না। ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট ওড়িশার কালাহান্ডি রায়গড় নিয়মগিরিতে বেদান্ত কোম্পানির জমি নেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু ২০১২, ২০১৩, ২০১৭ এমনকি ২০১৯ সালেও কেন্দ্রীয় সরকার বারে বারে সেই অধিকার ছেঁটে ফেলার ব্যবস্থা করতে থাকে। একটা কথা অবশ্য ভেবে দেখার মতো— যে আদিবাসী বা জঙ্গলে থাকা লোকজন জঙ্গলেই থেকেছেন বরাবর, কোনও দিনই নিজেদের ইচ্ছায় শহরে থাকতে, জীবন কাটাতে আসেননি, তাঁদের হঠাৎ ‘জঙ্গলে থাকার, এবং জঙ্গলের দামি কাঠ ছাড়া অন্যান্য গাছপালার জিনিস ব্যবহারের অধিকার’ দেওয়া হল। আইন করে বলা হল যে, তাঁদের ‘গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া জঙ্গলে কোনও পরিবর্তন করা যাবে না’। আলাদা করে হঠাৎ এমন স্বীকৃতি দেওয়া হল কেন? কারও মনে প্রশ্ন আসতে পারে যে, তার মানে কি রাষ্ট্রের মনে সংশয় ছিল, প্রকৃতির এই সম্পদের উপর এই মানুষদের অধিকার ‘বৈধ’ নয়? তবে, সে প্রশ্ন থাক। এক বার যখন সরকারি আইন হয়েছিল, তখন সংসদে সংশোধনী পেশ না করে, কোনও প্রকাশ্য আলোচনায় না গিয়ে এ রকম একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় কি না, আপাতত এই প্রশ্ন করা প্রয়োজন।
কিন্তু, রাষ্ট্রকে তো এগিয়ে চলতে হবে, উন্নয়নের পথে। তাতে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় বুঝি? আমার দেশে প্রাকৃতিক কাঁচামালের এত প্রাচুর্য, নিজেদের কাজে লাগিয়ে তার থেকে কিছু লাভ করতে হবে না? আমাদের হাতে হিমালয়ের মতো বিরাট পাহাড় আছে, ঘন জঙ্গল, এই প্রকাণ্ড সব নদী, মাটির নীচে কত না আকরিক সম্পত্তি— এ সব ব্যবহার করা হবে না? তা হলে সম্পত্তি থেকে লাভ কী? এগুলো আমাদের সম্পত্তি নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ, পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর, এমনকি খোদ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার জন্য এগুলো যথাযথ রাখা দরকার— এ সব অর্থহীন কথা বলে রাষ্ট্রের জয়রথ থামানো যায় না।
ইদানীং কিছু ছেলেছোকরাকে নিয়ে সমস্যা। এরা লেখাপড়া করুক না-করুক, পরিবেশবাদীদের কথা বিশ্বাস করে। বলে, ও সব কথার প্রমাণ নাকি হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে— পরিবর্তিত পরিবেশ সেই প্রমাণ দিচ্ছে রোজ। ‘আমরা তা হলে কী ভাবে বাঁচব’, এই চিন্তা তাদের মাথায় ঢুকছে। এই কমবয়সিরা আর এদের পিছনে থাকা লোকেরা বেশ কিছু দিন ধরে বলতে শুরু করেছে, আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত থাকতেই হবে, কারণ পৃথিবীর অনেক দেশই মনে করছে যে, প্রকৃতিকে রক্ষা করেও নিজেদের জীবন কাটানোর উপায় আদিবাসীদেরই জানা আছে। তার চেয়েও বড় কথা— মানুষের, অন্যান্য প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য নাকি জঙ্গল থাকতেই হবে। অরণ্য না থাকলে তাপ বাড়বে; বৃষ্টিপাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে, যেমন এখন হতে শুরু করেছে; ভূমিক্ষয় এত বেশি হবে যে, ফসলখেত, নদীর খাত, কিছুই আর থাকবে না; জঙ্গল নাকি বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শুষে নেয়, জঙ্গল কমে এলে বাতাসে সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড আরও বেড়ে যাবে। এক জায়গায় জঙ্গল কেটে শিল্প করতে গেলে যা অরণ্যছেদন হবে, তার প্রভাব সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরে পর্যন্ত যাবে।
এ সমস্ত কথা মেনে চলতে হলে তো যা আছে তা নিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকাই পথ। তা হলে পুঁজি খাটানোর কী হবে? কিছু শিল্প-উন্নয়ন করার জন্য খানিকটা জঙ্গল কাটলে কি জঙ্গল ফুরোয় কখনও? হিসাব দেওয়া হচ্ছে যে, ভারতে যতখানি জঙ্গল থাকা উচিত, ইতিমধ্যেই কেটে কেটে তা বিপজ্জনক রকম ভাবে কমে গিয়েছে। এই যে এত গাছ লাগানোর উৎসব করা হচ্ছে, তা নাকি কোনও কাজেরই নয়, যদি না পুরনো গাছ বাঁচানো হয়।
ওদের কথা কি সত্যি? কাটতে কাটতে এক দিন সব সবুজ শেষ হয়ে যাবে? সূর্যের খরতাপ মাটিকে পুড়িয়ে দেবে, আর গাছ বাঁচতে পারবে না এখানে? না, এ সব ভাবা অযথা দুর্বলতা। কাল যা-ই হোক না কেন, আজকের মুনাফাই উন্নয়ন। কাল কী হবে কে জানে? আমরা তো দেখতে আসব না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy