সুদিনসন্ধান: উচ্ছেদ করতে উদ্যত বুলডোজ়ারের সামনে প্রতিবাদে শামিল জনতা, জহাঙ্গিরপুরী, দিল্লি, ২০ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই।
২০১৪ থেকে কত না স্লোগান, কত না গুঞ্জনের কলরব। নতুন ভারত, কংগ্রেস-উত্তর ভারত, ধর্মোত্তর ভারত, কর্মমুখর উন্নয়নশীল ভারত, বিশ্বায়িত ভারত। বলা বাহুল্য, ‘নেহরু’র ভারত থেকে সেই ‘মহা’ভারতে উত্তরণের প্রচেষ্টায় নিবেদিতপ্রাণ এক জনই; এক জনই এই নিরবছিন্ন কর্মযজ্ঞের প্রতিভূ-পুরুষ; তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী তথা ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’-এর মতো মহা মহা আরও অনেক কিছু; নরেন্দ্র মোদী।
সেই স্লোগান যদি উপাত্তে রূপান্তরিত হত তা হলে তো এই ক’বছরে ভারতবাসীর জীবনে উন্নয়নের প্লাবন আসার কথা। যে কোনও উন্নয়ন সূচকে ভারতের উঠে আসা উচিত ছিল উপরের দিকে। দেশের মানুষ চাকরি করে, খেয়ে পরে, মাথার উপরে ছাদ নিয়ে ভাল ভাবে বেঁচে থাকবে এ রকমই কথা ছিল। অথচ গত আট বছরে ‘ভাল আছি’ কথাটা প্রায় অবলুপ্তির পথে। অতিমারির ভয়াবহ প্রকোপ ছাড়াও দারিদ্র বেড়েছে, বেড়েছে ক্ষুধা, হুহু করে বেড়েছে বেকারত্ব, প্রকৃত আয় কমেছে সর্বত্র, সুদে-আসলে ঋণজর্জর মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্তের অবস্থা শোচনীয়, তার চেয়েও দরিদ্রদের জন্য ভয়াবহ। শিক্ষায় শুধু অরাজকতা, স্বাস্থ্যে শুধুই সঙ্কট, যে কোনও সরকারি কাজে শুধুই নজরদারি। এই তালিকা দীর্ঘ।
শেষেরটা বাদে এই অবস্থা ভারতের স্বাধীন ইতিহাসে একেবারে নতুন নয়। কিন্তু পঞ্চাশের বা ষাটের দশকের প্রেক্ষাপট স্বভাবতই ছিল অনেকটা আলাদা, সমাধানের প্রেক্ষিতও ছিল ভিন্ন। গত সিকি শতাব্দীতে খোলা বাজারের হাত ধরে আপেক্ষিক দারিদ্র কমার ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট। মধ্যবিত্তের আকাশছোঁয়া আকাঙ্ক্ষা আর তার জোগানও ছিল পর্যাপ্ত। সেই স্বাচ্ছন্দ্যের সূর্য অস্তমিত। আর যারা এর বাইরে, সর্ব কালেই প্রান্তিক, তাদের হাল হকিকত তো বলা বাহুল্য। বৃদ্ধি, বিকাশ, সমৃদ্ধি কী রকম অন্য ভাষার শব্দ মনে হয় এখন। সত্যি বলতে কী, ক্ষুধাক্লিষ্ট, আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে নুইয়ে পড়া, জগৎসভার পঙ্ক্তিভোজনে ব্রাত্য, উচ্চজাতের আধিপত্য-নির্ভর ‘নেহরু’র ভারতের থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করতেই না কুম্ভীর নিধনকারী শ্রী মোদীর এই দেশের আকাশে আবির্ভাব। তা হলে? মোদীর ভারত ‘নেহরু’র ভারতের চেয়েও খারাপ দেখতে লাগছে কী করে? আরও কুৎসিত কী করে?
আরএসএস-এর স্বল্পশিক্ষিত প্রচারকের হাতে একবিংশ শতকেও যে দেশে গোঁড়া হিন্দুত্বের এক ধরনের উন্মেষ ঘটবে— এটা একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল না। বাবরি-নিধন কাণ্ডে এর ইঙ্গিত ছিল, আর ছিল মোদী-রাজ্য গুজরাতে, যা বার বার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কী হতে পারে। কিন্তু গুজরাত একটা অঙ্গরাজ্য যেখানে হিন্দুত্বের প্রভাব বরাবরই বেশি। কাজেই অনেকেরই ধারণা ছিল ভারতের মতো দেশে, যেখানে ১০০ মাইলের ব্যবধানে বদলে যায় ভাষা, রীতি বা খাদ্যাভ্যাস, সেখানে সঙ্কীর্ণ, হিন্দি-নির্ভর, নারীবিদ্বেষী, উগ্র, মূর্খবৎ, ইতিহাসবিমুখ, পুরাণপন্থী হিন্দুত্ব বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না।
কিন্তু সে ভুল শুধু ভাঙছেই না, অবস্থাটা ঠিক তার বিপরীত। কিছুমাত্র উন্নয়নের প্রচেষ্টা না করে, শুধুমাত্র ৫৬ ইঞ্চির ভোজবাজি, সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যাভাষণ, টেলিভিশন মিডিয়ার নিরলস ইতরামি আর প্রচারের চাকচিক্যে বিজেপি জিতে চলেছে আসমুদ্রহিমাচল। বিক্রি করে চলেছে নতুন ভারত নামে এক ভোগ্যপণ্য! কিন্তু এতেই যেন শেষ নয় হিন্দুত্বের অশ্বমেধ যজ্ঞ। অশ্বমেধকে সংখ্যালঘুমেধ যজ্ঞে পরিণত না করে তাদের আবার পেটের নিরামিষাশী ভাত হজম হয় না। তাই এখন আরও নতুন নতুন পন্থা ভাবা হচ্ছে সংখ্যালঘুদের জীবন বিপন্ন করে তুলতে। গুজরাত থেকে মণিপুর, কাশ্মীর থেকে কেরল, দিল্লির জহাঙ্গিরপুরী থেকে মধ্যপ্রদেশের খরগোনে, কর্নাটকের উদুপি, সর্বত্রই দেশের সংখ্যালঘুদের ধনেপ্রাণে মারতে চাওয়া হিন্দুত্ববাদীদের দাপট। যাঁদের দমানো সম্ভব নয়, উমর খালিদ যেমন, তাঁদের আইনের মারপ্যাঁচে ফেলে রাখা হচ্ছে জেলে। আর যাঁরা দরিদ্র, অঘোষ, জীবনভারে জব্দ, তাঁদের স্রেফ অদৃশ্য করে দেওয়া হচ্ছে। কোথাও দাঙ্গা করে, কোথাও বুলডোজ়ার চালিয়ে। একের পর এক চলছে বাণ— কখনও হিজাব, কখনও গোমাংস, কখনও পাথর ছোড়ার অভিযোগে গণ-উচ্ছেদ।
প্রশ্ন এটা নয় যে, এর কারণ কী? কারণ স্পষ্ট। আরএসএস বা গোলওয়ালকর প্রণীত অখণ্ড ভারত নামক প্রহসনকে আক্ষরিক অর্থে নেওয়া। প্রশ্ন এও নয় যে, এর জন্য আর কী কী খেসারত দিয়ে হবে সংখ্যালঘু মানুষকে। সেই ভারতে আমার আপনার কী স্থান, সেই প্রশ্নও থাক। কারণ এই ধরনের প্রহসনের কোনও তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ হয় না। কিন্তু ভারতের বহুত্বের নিরিখে এই বোধহীন, প্রতিরোধহীন, রক্তাক্ত সময়ের আক্রমণ যে সামাজিক, আর্থিক, রাজনৈতিক ক্ষতকে গভীর থেকে গভীরতর করবে, সংবিধানকে বিপন্ন থেকে বিপন্নতর করবে, জাতিবিদ্বেষ রাস্তার গুন্ডামি ছেড়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে, এগুলো এখন আর কোনও ভাবী কালের কষ্টকল্পিত ডিস্টোপিয়ার অংশ মনে হয় না। এগুলো ভারতের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
সেই সূত্র ধরে দুটো প্রশ্নের সম্মুখীন আমরা।
এক ভাবে ভাবলে, দেশের সামগ্রিক অধঃপতনের যে প্রামাণ্য আখ্যান, তার বিপরীত অক্ষে বয়েছে বিজেপির ধারা। অর্থাৎ দেশ যতটা নেমেছে, ধনে, প্রভাবে, প্রতিপত্তিতে বিজেপি বেড়েছে ঠিক ততটাই। আর যত বারই এই পতনের কারণ হিসাবে বিজেপির দিকে আঙুল উঠেছে, তত বারই বিজেপি দেখিয়েছে কংগ্রেসের জুজু, বা নকশাল, সংখ্যালঘু, বা কিছু জনগোষ্ঠী। কিন্তু এখন সে প্রয়োজনও ফুরিয়েছে। এখন বিজেপি আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছে যে মানুষ এটাই চায়। ডিমনিটাইজ়েশন থেকে অতিমারি, পেট্রল-গ্যাসের দাম থেকে সর্বাঙ্গীণ মূল্যবৃদ্ধি, আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানো, দাঙ্গা, অস্থিরতা, ধর্মের নামে ভণ্ডামি, কিছুতেই কিছু আর আসে যায় না মানুষের। তারা শুধু এক কাল্পনিক রাক্ষসকে মনে রেখে ভেবে নিতে চায়, ভাবতে চায় যে, দুয়ারে মোদী থাকলে বাড়ির ভিতরে আমি পরিতুষ্ট। তা সেই বাড়ির দেওয়ালে যতই ফুটো থাক, আর যত কষ্টই হোক, দু’মুঠো অন্ন জোগাড় করলেই হবে। যত খারাপ হয়েছে অবস্থা, তত যেন এক কল্পিত আগামীর আশায় আরও বেশি করে বিজেপি-নির্ভর হয়েছে দেশবাসী। তাই দেশের ক্ষতি করেই যে বিজেপির লাভের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, এটা তো উত্তরোত্তর পরিষ্কার।
দ্বিতীয় প্রশ্নটা সেই নিয়েই। দেশের নাগরিক কি সত্যিই এতটা বালখিল্যবিলাসী, এতটা ডেলিউশনাল? এ তো আমাদেরই দেশ। গোটা কয়েক বিরোধী নেতার হাতে প্রতিরোধের ভার ছেড়ে দিয়ে আমি-আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারি? এটা কি হয়? এ রাষ্ট্রের সঙ্গে তার নাগরিকের, সংবিধানের সঙ্গে জনজাতির, মানুষের সঙ্গে মানুষের যদি অসেতুসম্ভব দূরত্ব তৈরি হয়, সেই ক্ষতের ভার তো আমাকে-আপনাকেই বইতে হবে! আর বইতে হবে দেশের ভবিষ্যৎকে। কাল বিজেপি থাকবে না। দেশটা থাকবে তো?
পাবলিক নিয়ে অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের অসূয়া আমাদের অজানা নয়। সেই সূত্র ধরেই হয়তো জীবনের শেষের দিকে এক লেখায় উত্তমকুমার বলেছিলেন, পাবলিক একটা প্যারাডক্স। আজ সে হয়তো সবচেয়ে বড় সম্পদ, আর ঠিক কালই নেমেসিস। সেই পাবলিককে নিজস্ব সম্পদ হিসাবে অনেক দিন হিন্দুত্বের আফিম খাইয়ে রেখেছে গেরুয়া কারবারিরা। পাবলিক কবে তাদের নেমেসিস হবে সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আরও বড় প্রশ্ন, সেখানে আমার-আপনার ভূমিকা থাকবে তো? নয়তো ধরে নিতে হবে মহাভারতের আর এক নাম জড়ভরত, থুড়ি জড়ভারত।
আম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy