দেশের বৃদ্ধি নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে।
ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তরপূর্তির বছরটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত হোন নাগরিক, সরকারের এমনই বাসনা ছিল। উদ্যাপন করার মতো সাফল্য আমাদের অনেক আছে (যদিও তার অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রী মোদীর পূর্বসূরিদের অধীনে)। ভারত এখন খাদ্যশস্যে স্বনির্ভর। গড় আয়ু এখন সত্তর বছর, স্বাধীনতার সময়ের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি। তথ্যপ্রযুক্তি, পেট্রো-কেমিক্যাল, গাড়ির মতো বৃহৎ শিল্প তৈরি হয়েছে ভারতে। তবু দেশের বৃদ্ধি নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ আছে। কারণ, আমাদের নীতি-প্রণয়নকারীরা যে ভাবে অবহেলা করছেন তরুণ প্রজন্মকে, তা প্রায় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
ভারতীয় জনগণনার শেষ রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকে ভারতের তারুণ্যের সম্পদ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। অধিকাংশ উন্নত দেশ যেখানে বয়স্কদের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি, এবং তাঁদের ভার বহন করার মতো তরুণদের সংখ্যা কমতে থাকায় উদ্বিগ্ন, ভারতের জনসংখ্যায় সেখানে তরুণদের সংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু তারুণ্যের সম্পদকে যদি সত্যিই কাজে লাগাতে হয়, তা হলে তরুণ কর্মীর সংখ্যা বেশি থাকলেই হবে না, তাঁদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে শক্তিশালী হতে হবে, আধুনিক প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত হতে হবে। সে দিকটি বড়ই উপেক্ষিত। যেমন ভাবে আমরা আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদকে অবহেলা করছি, সে ভাবেই আমাদের জনসম্পদকেও— শিক্ষাহীন, দক্ষতাহীন, শিশুশ্রমিককে পাঠাচ্ছি শ্রমের বাজারে। মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছি নাবালিকা বিবাহ, অকাল মাতৃত্বে।
জীবনের প্রথম পাঁচ বছরে যথাযথ এবং যথেষ্ট পুষ্টি শিশুর দেহ-মনের বৃদ্ধির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। শৈশবে অপুষ্টির জন্য দৈর্ঘ্য কম থেকে গেলে তার ছাপ থাকে পরিণত বয়সেও, দেহের দুর্বলতার মতো মানসিক বৃদ্ধিও ব্যাহত হতে পারে। সেই সঙ্গে রয়েছে শিক্ষার প্রতি আমাদের নীতি-নির্ধারকদের অবহেলা, ‘যেমন হোক হলেই হল’ মনোভাব, শিক্ষাব্যবস্থায় রাজনীতির অনুপ্রবেশ। এর পরেও কি ভরসা হয় যে, তীব্র প্রতিযোগিতার মোকাবিলা করে ভারতের উন্নয়ন করার মতো শ্রমশক্তি আমাদের আছে?
১৯৯২-৯৩ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ভারতে চার বছরের কম বয়সি অর্ধেক শিশুর ওজন স্বাভাবিকের তুলনায় কম। ২০১৭-১৮ সালের সমীক্ষা বলছে, এই অনুপাত দাঁড়িয়েছে ৪৪%। ২০২০ সালের রাষ্ট্রপুঞ্জের আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা পাঁচ বছর ও তার কম বয়সি শিশুদের অপুষ্টির নিরিখে ভারতকে রেখেছে ১০৭টি দেশের মধ্যে ৯৪তম স্থানে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার-সহ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলি এ বিষয়ে ভারতের চাইতে ভাল অবস্থানে রয়েছে।
ভারত সরকারের এ বিষয়ে যে দু’টি প্রধান প্রকল্প রয়েছে, সেগুলি হল ‘সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি’ এবং ‘মিশন পোষণ ২’। কিন্তু, ২০২১-২২ সালে এই দুটো প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ০.৫৭%। নতুন পদ্ধতিতে শিশু ও মায়েদের পক্ষে প্রকল্পের সুবিধেগুলির নাগাল পাওয়াও কঠিন হয়ে উঠেছে। আর নিরামিষাশী হিন্দুত্বের ভ্রুকুটিতে মা কালীর পক্ষে তাঁর প্রসাদি মাংস পাওয়াও যখন কঠিন হয়ে উঠেছে, তখন শিশুদের মিড-ডে মিল-এ মাঝেসাঝে একটা ডিম পাওয়ার আশা কতটুকু?
শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও লজ্জার কারণ রয়েছে। পঁচাত্তর বছরে আমরা কখনও সব শিশুকে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার যথেষ্ট চেষ্টা করিনি। সংবিধান সংশোধন করে শিক্ষাকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার পরেও নয়। ২০১৭-১৮ সালের পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা দেখিয়েছিল, ছয় থেকে সতেরো বছরের মধ্যে তিন কোটি বাইশ লক্ষ ছেলেমেয়ে কোনও দিন স্কুলেই যায়নি। শিক্ষার প্রতি আমাদের উদাসীনতা সবচেয়ে স্পষ্ট দেখিয়ে দিয়েছে কোভিড অতিমারি। প্রধানমন্ত্রী থেকে নীচের স্তরের কর্মী পর্যন্ত সকলে ডিজিটাল দুনিয়ার ধারণা নিয়ে এতই মেতে উঠলেন যে, তাঁরা খেয়াল করতেই ভুলে গেলেন সব শিশুর কাছে বিদ্যুৎসংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগ, এবং প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিন যন্ত্র আছে কি না— এমনকি সব শিশুর বসার জায়গা আছে কি না। শিক্ষকরাও বাড়ি বসে মাইনে পাওয়ার ব্যবস্থায় এতই আহ্লাদিত হলেন যে, মল রেস্তরাঁ পুজো মেলা খুলে গেলেও স্কুল খোলার চেষ্টাই করলেন না। কিছু শিক্ষক আজও বিশ্বাস করেন, নিম্নবর্ণের প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের শিক্ষা গ্রহণ করার মানসিক ক্ষমতা নেই। তাদের কাছে অনলাইন শিক্ষা পৌঁছল কি না, তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়?
সব শিশুর জন্য যথেষ্ট পুষ্টি এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা সমগ্র সমাজের জন্য বিপুল সম্পদ বহন করে আনে। অধিকাংশ দেশই একে গুরুত্বপূর্ণ ‘পাবলিক গুড’ বলে মনে করে— সেই জনসম্পদ, যা পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ করতেও পিছপা হয় না দেশ। কিন্তু এ দেশে বৈষম্য যত বেড়ে চলেছে, ততই অন্য কোনও জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। তারা সহজেই বৈষম্যের শিকার হয়, কারণ অধিকাংশই জন্মেছে দরিদ্র, নিম্নবর্ণ পরিবারে, স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের কোলে। নিম্নমানের পরিষেবা সেবিত প্রান্তিক গ্রামে তারা বড় হচ্ছে। অনেকের মা অতি অল্পবয়সি, অতি দুর্বল, কারণ সে তার নিজের শৈশবে ছিল অপুষ্ট। এই শিশুদের কোনও রাজনৈতিক কণ্ঠ নেই। এই সমাজ, যা ক্রমাগত আরও উচ্চকিত, বিভ্রান্ত, সংবেদনহীন হয়ে উঠছে, শিশুদের করুণ স্বর শুনবে কখন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy