অনেক দিন যাবৎ আমরা প্রধানত দর্শকের ভূমিকায় নিক্ষিপ্ত হয়েছি। ঘরের দেওয়ালে সাঁটা টেলিভিশনের পর্দা থেকে হাতের তালুতে সংস্থাপিত মোবাইল টেলিফোন— অবিরাম বিশ্বরূপ দর্শনের বন্দোবস্ত হয়েছে। আমরা পরম আনন্দে সাব্যস্ত করে নিয়েছি যে আমাদের মাথার চারিপাশে, চোখের চারিপাশে কেবলই দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের জন্ম হয়ে চলবে, আমাদের কাজ শুধু দেখে নেওয়া, শুধু ভুলে যাওয়া। কিন্তু কখনও সময় আসে, এই আলস্য, এই ঔদাসীন্য, এই বিস্মরণপ্রবণতা, ঝড়ের আঘাতে সব ভেঙে চুরমার হয়ে যায়, সহসা আমরা আবিষ্কার করি যে ভুলে যাওয়ার আর জো নেই।
গত দু’মাস ধরে শহরের, কেবল কলকাতা নয়, রাজ্যের নানান শহরের বুক থেকে যে অজস্র দৃশ্য অবিরত উঠে এসেছে, তার অনেক কিছুই তো অবিস্মরণীয়। সেই সব ছবির পরতে পরতে ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিবাদ, প্রতিস্পর্ধা, ভরসা, শ্রদ্ধা, ভালবাসা... আর কত যে মায়া! যেমন ধরা যাক স্বাস্থ্য ভবনের সামনে জুনিয়র চিকিৎসকদের অবস্থানের শেষ প্রহরের সেই দৃশ্যগুলি। ক্ষমতার নির্দেশে ডেকরেটরের লোক এসে মঞ্চের সাজসজ্জা খুলে নিয়ে গিয়েছেন, ফ্যানগুলোও উধাও। ভাদ্র মাসের অসহনীয় গরমে প্রতিবাদী মানুষগুলোর কী কষ্ট হবে, সে-কথা ভাববার দায় ক্ষমতাবানদের নেই। কিন্তু না ভাবলে যাঁদের চলে না? অবস্থান-মঞ্চের আশপাশ থেকে সেই প্রতিবেশীরা অচিরেই পেডেস্টাল ফ্যান জোগাড় করে নিয়ে এলেন। তেমনই এক জনকে টেলিভিশনের সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন: কেন এই উদ্যোগ? প্রবীণ মানুষটি নিতান্ত আটপৌরে ভঙ্গিতে জবাব দিলেন, ‘ওরা তো আমাদের সকলের হয়েই অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে, ন্যায়বিচার চাইছে, ওরা গরমে কষ্ট পাবে, আমরা পাশে দাঁড়াব না?’ বলতে বলতে গলা বুজে আসে তাঁর। ও-দিকে তখন সারি সারি হাতপাখা সচল হয়েছে অবস্থানরত ছেলেমেয়েদের সামনে— অনেকে সেই আদি অকৃত্রিম সরঞ্জামটি হাতে করে নিয়ে চলে এসেছেন, ওদের হাওয়া করছেন, এই গুমোটে একটু বাতাস না পেলে চলে? শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কিছু মায়া রয়ে গেলো’ কবিতাটির শেষটুকু মনে পড়ে: জীবনযাপনে আজ যত ক্লান্তি থাক, বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।
এ-সব শুনে অনেকেই বলবেন: আদিখ্যেতা। হবে! কেউ হয়তো ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি রেখে প্রশ্ন করবেন: টেলিভিশনে ছবি উঠবে জেনেই হাতপাখার এমন সমবেত আন্দোলন নয় তো? হবেও বা! প্রতিবাদী তরুণতরুণীদের পাশে দাঁড়ানো নাগরিকদের আবেগ এবং সহমর্মিতাকে কেউ যদি পাটোয়ারি বুদ্ধির কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবে তার দাম ঠিক করতে চান, কোনও তর্ক করব না। কিন্তু, অতি অবশ্যই, খেয়াল করব যে এমন দৃশ্য আমরা সচরাচর দেখি না। এবং, অস্তগামী রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণের প্রতিধ্বনি করেই বলব: ওই দৃশ্যাবলিতে যে দুর্মর মানুষী মায়া রয়ে গেল, তার উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। আর সেই প্রত্যয়ের কারণেই, দিনের পর দিন পথে হেঁটে চলা, হাতে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, পায়ে পা এবং কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে জাস্টিসের দাবি জানিয়ে যাওয়া বহু মানুষের মুখে ও চোখে যে রুদ্ধশ্বাস আবেগের গভীর ছায়া পড়তে দেখেছি, তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে অভিবাদন জানাব নির্দ্বিধায়, নিঃসংশয়ে। যদি তা না করি, সেটা কেবল শুভনাস্তিকতার পরিচায়ক হবে না, নির্বুদ্ধিতারও প্রমাণ হবে। তার কারণ, অন্যায়, দুরাচার এবং দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ওই আবেগ কেবল সামাজিক প্রতিবাদের সমিধ নয়, প্রতিস্পর্ধার হাতিয়ারও বটে। রাজনৈতিক হাতিয়ার।
এই আবেগ সুযোগসন্ধানী রাজনীতির কারবারিদের তৈরি করা কদর্য বিদ্বেষী বিভাজনী আবেগ নয়, দৈনন্দিন জীবনের নিত্যসঙ্গী অমর্যাদা আর অবিচার দূর করে বেঁচে থাকার, বেঁচে ওঠার তাগিদে বহুজনের অন্তরে সঞ্জাত আবেগ। স্বতঃস্ফূর্ত সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই আবেগ কী ভাবে প্রতিস্পর্ধার হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে, সম্পূর্ণ অহিংস এবং গণতান্ত্রিক সেই হাতিয়ার ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে কতটা আঘাত হানতে পারে, তা আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি। দেখেছি, তার অভিঘাত পথে নামিয়ে আনে মহাশক্তিধর মন্ত্রী সান্ত্রি আমলাতন্ত্রীদের, একতরফা আদেশ ঘোষণা কিংবা মেকি আবেদন বিতরণের ছল বল ও কৌশলগুলিকে সাময়িক ভাবে শিকেয় তুলে প্রতিবাদীদের সঙ্গে আলোচনার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখে তাঁদের, রাষ্ট্রযন্ত্রের শিখর থেকে ‘এটাই শেষ সুযোগ’ মার্কা দাম্ভিক চরমপত্র জারি হওয়ার পরেও বারংবার ক্ষমতার অধীশ্বর-অধীশ্বরীদের বৈঠকে বসায় এবং আন্দোলনের দাবিদাওয়া মেনে নিতে, অন্তত— অভিযুক্ত কেষ্টবিষ্টুদের এ-ঘাট থেকে সে-ঘাটে ঠাঁইনাড়া করে— মেনে নেওয়ার চিত্রনাট্য সাজাতে বাধ্য করে।
রাষ্ট্রশক্তি কেন আগেই নমনীয় হল না, কেন বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রথম থেকেই আলোচনার পথে না-নেমে ক্ষুব্ধ প্রতিবাদকে এতটা ব্যাপক এবং গভীর হয়ে উঠতে দিল, তা নিয়ে বিস্তর সওয়াল-জবাব শুনেছি। কী জানি, এ ব্যাপারে আদৌ কোনও রহস্য আছে কি? বরং শক্তিমান-শক্তিমতীদের পূর্ব-ইতিহাস থেকে এ-কথাই তো মনে হয় যে, তাঁরা প্রথমটায় প্রতিবাদের এই বিপুল আবেগটিকে ধরতেই পারেননি, খেলা অনেকখানি এগোনোর পরে টের পেয়েছেন যে নাগরিক সমাজের নতুন নতুন মহল থেকে, আক্ষরিক অর্থেই শহরের অলিগলি থেকে ক্রমাগত উঠে আসা প্রতিবাদের এই ঢেউ কী করে সামলাতে হয়, সে-বিদ্যে তাঁদের সিলেবাসের বাইরে। বিলক্ষণ জানি যে ওঁদের খেলার প্রতিভা বিপুল, তাই শেষ অবধি ‘ঠিকঠাক’ চাল চেলে রাশ ধরে নিলে বিস্মিত হব না। কিন্তু অন্তত এখনও পর্যন্ত যে ওঁরা চাপে আছেন, সেই সুস্পষ্ট সত্যটিই জানিয়ে দেয়, সম্মিলিত সামাজিক আবেগের প্রতিস্পর্ধী শক্তি কতখানি। একতান্ত্রিক রাষ্ট্রক্ষমতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বহুস্বর সমাজের এই লাগাতার ‘বিচার চাই’ নির্ঘোষই এখন গণতন্ত্রের একটি বড় ভরসা।
কিন্তু ভরসামাত্র। তাকে চরিতার্থ করতে হলে বিস্তর কাজ বাকি। সামাজিক সংযুক্তির কাজ। এই মুহূর্তে নাগরিক সমাজের— এবং অনেকাংশেই নগর-সমাজের— নানান বর্গের প্রতিবাদীদের মহামিছিলের যে প্রস্তুতি চলছে, তার গুরুত্ব পঞ্চমুখে স্বীকার করতে হবে। কিন্তু এক নিঃশ্বাসেই এ-কথাও বলতে হবে যে, এই প্রতিবাদের সঙ্গে আরও অনেক বড় জনসমাজের সংযোগ সাধন করা দরকার, সেই সমাজের সহস্রবিধ সুযোগ-বঞ্চনা এবং অধিকার-হরণের দাবিকে সংযুক্ত করা দরকার ‘জাস্টিস’-এর দাবির সঙ্গে। জাস্টিস শব্দটিতে একই সঙ্গে দু’টি অর্থ নিহিত আছে। জাস্টিস মানে বিচার, আবার জাস্টিস মানে ন্যায় বা ন্যায্যতা। দু’টি অর্থই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু প্রথম অর্থটি দ্বিতীয় অর্থের এক বিশেষ প্রয়োগ। ‘বিশেষ’ মানে কখনওই গৌণ বা ছোট নয়: আইন-আদালতের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অপরাধের যোগ্য বিচার চাই— এই দাবি অবশ্যই লাগাতার জারি রাখা দরকার, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবতীরা যাতে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধামা নিয়ে এসেও অপরাধকে চাপা দিতে না পারেন। কিন্তু একই সঙ্গে, সমাজজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে অবিচার এবং অপ্রাপ্তির অন্যায় ঘটে চলেছে, তার স্বরূপকেও লাগাতার উন্মোচিত করা দরকার, সেই সব অন্যায়ের পিছনে পরাক্রমী নায়কনায়িকাদের প্রত্যক্ষ এবং প্রচ্ছন্ন ভূমিকার ভয়ঙ্কর মূর্তিগুলিকে হাটের মাঝে নিরাবরণ করে কৈফিয়ত চাওয়া দরকার, অন্যায়ের প্রতিকারে সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁদের বাধ্য করা দরকার। শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, পুষ্টিতে, কর্মসংস্থানে, দিনযাপনের প্রাকৃতিক ও মানসিক পরিবেশে, নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার এবং কাজ করার পরিসরে— জীবন এবং জীবিকার সর্বস্তরে শ্রমজীবী মানুষের উপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান প্রভুবর্গের যে প্রচণ্ড পীড়ন চলেছে, সামাজিক আন্দোলনের এই নবজাগ্রত প্রতিস্পর্ধাকে তার বিরুদ্ধে একই সঙ্গে বিস্তৃত এবং সংহত করে বলা দরকার: বিচার চাই।
সত্য এই যে, একটি পৈশাচিক ঘটনার সূত্র ধরে সমাজের সামনে এক বিরাট সুযোগ উপস্থিত হয়েছে। ‘জাস্টিস’কে তার বিশেষ অর্থ থেকে সাধারণ বা প্রসারিত অর্থে উত্তীর্ণ করার সুযোগ। তার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার যদি করা যায়, তা হলে জনজীবনের সর্বস্তর থেকে আরও অনেক অনেক মানুষ এই প্রতিস্পর্ধায় শামিল হবেন, নিজের নিজের ন্যায়বিচারের দাবি আর অধিকারের দাবি নিয়েই পরস্পরের পাশে দাঁড়াবেন, হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। জীবনযাপনের কঠোর বাস্তব থেকে প্রাণরস সংগ্রহ করে নেওয়া আবেগের অগণন দৃশ্যরচনা দেখতে পাব আমরা। আত্মশক্তিতে জাগ্রত সমাজের সেই ছবিগুলিকে আমাদের মন থেকে সরিয়ে দেওয়ার, ভুলিয়ে রাখার সাধ্য কোনও শাসকের নেই।
কিন্তু, সামাজিক সংযুক্তির ওই কাজটিতে ফাঁকি পড়লে দু’মাসের এই ভরসা, শহরের টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের লেজের মতো, দু’দণ্ডেই উধাও হয়ে যেতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy