যাই বল, এই রিলগুলো দেখতে কিন্তু দারুণ লাগে, জীবনের ফিলসফি পাল্টে দেয় পুরো,” ফোনটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে বলল শিশির। একটা মেসেজ দেখবে বলে ফোন হাতে নিয়েছিল, তার পরের আধঘণ্টা ধরে একের পর এক রিল দেখে গিয়েছে। তপেশের ধমক খেয়ে দেখা বন্ধ করল।
“যে সব ছেলেছোকরা এই রিলগুলো বানায়, খোঁজ নিয়ে দেখ গে যা, এদের এখনও জীবন শুরুই হয়নি— আর তুই ওদের জ্ঞান শুনে নিজের জীবনদর্শন পাল্টাতে চললি!” খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসে তপেশ। তার পর বলে, “তা, আজ কী শিখলি?”
“আরে, বাচ্চা হোক আর যা-ই হোক, ঠিকই বলছে, বুঝলি,” তপেশের ইয়ার্কিতে কান দেয় না শিশির, “বলছে, যখন বুড়ো হয়ে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে গোটা জীবনটার কথা ভাববি, তখন যা করেছিস তা নিয়ে যতখানি আফসোস করবি, তার চেয়ে বেশি আফসোস করবি যেগুলো করিসনি, তা নিয়ে।”
“ওরা এ সব বলছে, আর তুই বিশ্বাস করছিস?” এ বার ফুট কাটে সূর্য। “তুই তো শেয়ারে টাকা খাটাস— তা হলে আমার এই প্রশ্নটার উত্তর দে দেখি। ধর, একটা কোম্পানির শেয়ারে তোর এক লাখ টাকা আছে— তুই সেই শেয়ার বেচে অন্য কোম্পানির শেয়ার কিনলি, সেই লাখ টাকারই। আর, আমার সেই দ্বিতীয় কোম্পানির শেয়ারে লাখ টাকা ছিল, আমি ভেবেছিলাম ওটা বেচে প্রথম কোম্পানির শেয়ারে টাকাটা লাগাব, কিন্তু আজ করব-কাল করব করে আর কাজটা করে উঠতে পারিনি। এক বছর পরে দেখা গেল, প্রথম কোম্পানির— মানে আগে যেটায় তোর টাকা ছিল, আমি যেটা কিনব ভেবেছিলাম— তার শেয়ারের দাম বেড়েছে ১৫%, আর দ্বিতীয় কোম্পানির— মানে, যেটায় আমার টাকা আছে, আমি তুলব ভেবেও তুলিনি, আর তুই যেটায় টাকা লাগালি— তার শেয়ারের দাম কমেছে ১০%। বল দেখি, আমার আর তোর মধ্যে কে বেশি আফসোস করবে?”
“শাবাশ! একেবারে মোক্ষম জায়গায় ধরেছিস!” সূর্যর পিঠ চাপড়ে দিলেন শিবুদা। প্রশংসা যে আসছে, সেটা অবশ্য বোঝা গিয়েছিল সূর্যর কথার মাঝপথেই শিবুদার মুখের মুচকি হাসিতে। শিশিরের দিকে তাকিয়ে দাদা বললেন, “উত্তর দে।”
“এ আর বলার কী আছে, আমিই বেশি আফসোস করব। যেখানে ছিল, টাকাটা সেখানে রেখে দিলেই আমার চলত,” উত্তর দেয় শিশির। বলতে বলতেই বোঝে, প্যাঁচে পড়েছে। শিবুদা বললেন, “তা হলে এই যে জীবনদর্শন পাল্টে ফেলছিলি— না-করার চেয়ে করায় আফসোস কম হবে— তার কী হল?”
অনেক দিন পরে আড্ডা জমেছে আজ। শিবুদা মাঝে আবার বিদেশে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে ফিরে দিনকয়েক পিঠের ব্যথায় কাবু। শিশির আর ঋতুপর্ণাও বেড়াতে গিয়েছিল। তপেশ আর সূর্য গোপালের দোকানে এসেছে নিয়মিত— শিবুদা না থাকলে যে আড্ডায় মন বসে না, সেটা আরও এক বার টের পেয়েছে। আজ শিবুদা ফিরতে গোপালও খুশি, স্পেশাল দার্জিলিং চা বানিয়ে দিয়েছে। এক চুমুকে কাপের তলানিটুকু খেয়ে শিবুদা বললেন, “আফসোস বস্তুটার চরিত্রই হল, যখন তুই তোর ‘স্বাভাবিক’ কাজের বদলে অন্য কিছু করবি, সেটায় ভুল হলে আফসোস বেশি হবেই। খালি মনে হবে, কেন করতে গেলাম! দু’জন লোকের কথা ধর— দু’জনই ড্রাইভ করে। এক জন নিয়মিত পথচলতি লোককে লিফট দেয়; অন্য জন সাধারণত দেয় না, কিন্তু এক দিন দিল। সে দিন এই দু’জনেরই গাড়িতে ছিনতাই হল। যদি জিজ্ঞাসা করি যে, অচেনা লোককে গাড়িতে তোলার জন্য কে বেশি আফসোস করবে, উত্তর নিয়ে তোকে সম্ভবত ভাবতে হবে না— নিশ্চিত ভাবেই দ্বিতীয় জন। সে ভাববে, কোনও দিন কাউকে লিফট দিই না, আজই কেন দিতে গেলাম! কিন্তু, যদি দোষ দিতে হয়, কাকে বেশি দোষ দিবি? প্রথম জনকেই তো, নিয়মিত এই ঝুঁকি নেয় বলে?”
কথা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন শিবুদা। শিশিরের প্যাকেট থেকেই, তবে সেটা শিবুদাই উপহার দিয়েছেন, এয়ারপোর্টের ডিউটি-ফ্রি দোকান থেকে কেনা বিলিতি ব্র্যান্ডের সিগারেট।
“আফসোস হতে পারে, সে ভেবে তা হলে কাজ করব না?” প্রশ্ন করল তপেশ।
“গবেষণা তো তেমনটাই বলছে,” প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা ছাইটা সন্তর্পণে অ্যাশট্রেতে ফেলে উত্তর দিলেন শিবুদা। “তোদের তো ড্যানিয়েল গিলবার্টের কথা বলছিলাম আগে— ‘হ্যাপিনেস’-বিশেষজ্ঞ। গিলবার্ট লিখেছেন যে, ‘স্বাভাবিক’ আচরণ থেকে বিচ্যুত হয়ে কোনও কাজ করার আগে মানুষ সেই কাজে ভুল হলে কতখানি আফসোস করবে সে কথা ভাবে, এবং বহু ক্ষেত্রেই কাজটা করার থেকে পিছিয়ে যায়। কার্যক্ষেত্রে যতখানি আফসোস হয়, তার চেয়ে বেশিই আশঙ্কা করে লোকে। এবং, বুঝতেই পারছিস, এই আশঙ্কাকে বিলক্ষণ কাজে লাগায় বাজার।
“ধর, এক জন লোক তার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে একটা ভ্যাকসিন দিতে। ডাক্তারবাবু বললেন, যেটা প্রচলিত ভ্যাকসিন, তার দাম পড়বে ১৫০০ টাকা; কিন্তু একটা নতুন ভ্যাকসিন বাজারে এসেছে, যাতে এই রোগের ভাইরাসের আরও তিনটে বিরল কিন্তু অতি বিপজ্জনক স্ট্রেনকে ঠেকানো যাবে— সেই ভ্যাকসিনটার দাম ৬৫০০ টাকা। দাম জানানোর পর ডাক্তারবাবু এটাও মনে করিয়ে দিলেন যে, এখন না দিলে আর কখনও এই ভ্যাকসিন দেওয়া যাবে না— পরে সেই বিরল ভাইরাসের স্ট্রেন আক্রমণ করলে আফসোস করা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। এ বার বল, যে বাবার ওই বাড়তি ৫০০০ টাকা খরচ করার সামর্থ্য আছে, সে কী করব?
“ঠান্ডা মাথায় ভাবলে বুঝবি, প্রথম প্রশ্ন করা উচিত যে, ওই তিনটে বিরল স্ট্রেন কতখানি বিরল— ওতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কত? সেই উত্তরের উপর ভিত্তি করে ভাবা উচিত, সেই বাড়তি ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ৫০০০ টাকা অতিরিক্ত খরচ করা উচিত কি? কিন্তু, এমন এক জন লোককেও চিনিস, যে ডাক্তারের সামনে বসে এই হিসাবগুলো করবে? এমনকি, করার কথা ভাববে? কেন ভাববে না, তার একটা বড় কারণ হল, সন্তানের সুস্বাস্থ্যের আর্থিক মূল্য কত, সে হিসাব আমাদের জানা থাকার কথা নয়— ফলে, ওই অতি সামান্য বাড়তি ঝুঁকি এড়ানোর জন্য সর্বোচ্চ কত টাকা দেওয়া উচিত হবে, কোনও মা-বাবাই জানেন না। অন্য কারণটা হল আফসোসের সম্ভাবনা— ভ্যাকসিন দিলাম না, তার পর সত্যিই এই ভাইরাস আক্রমণ করল, তখন নিজেকে ক্ষমা করব কী ভাবে?”
“সত্যিই তো, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা এই সামান্য ৫০০০ টাকা খরচ নিয়ে ভাববে কেন, যেখানে প্রশ্নটা সন্তানের সুস্বাস্থ্যের, তার ভবিষ্যতের?” প্রশ্ন করে তপেশ। বাকি দু’জনের ঘাড় নাড়া দেখে বোঝা যায়, তাদের মনেও প্রশ্নটা ছিল।
শিবুদা এক মুহূর্ত থমকান। হাতে ধরা দেশলাই বাক্সটাকে টেবিলের উপর ঠুকলেন আনমনে, তার পর বললেন, “যার ৫০০০ টাকা খরচের সামর্থ্য আছে, তার সামর্থ্যও তো অসীম নয়, তাই না? সন্তানের জন্য সে মোট কত টাকা খরচ করতে পারে, তার একটা লিমিট আছে। আর সেই কারণেই প্রতিটি সিদ্ধান্ত একটা ট্রেড অফ— মানে, সন্তানের জন্যই একটা জিনিসে খরচ করলে অন্য কোনও একটা জিনিস বাদ দিতে হবে। তা হলে, যে কোনও দুটো খরচের সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হল, ওই দুটোর মধ্যে যে খরচে সন্তানের বেশি উপকার হবে, তাতে খরচ করা। তিনটে বিরল ভাইরাস ঠেকাতে ৫০০০ টাকা খরচ করার চেয়ে অন্য কোনও কাজে তা খরচ করলে সন্তানের বেশি উপকার হবে কি না, আমি জানি না। কিন্তু কথাটা হল, সেই মা-বাবাও জানেন না। জানার চেষ্টাও করেন না। কারণ, আফসোসের সম্ভাবনা তাঁদের মনে এতটাই বড় যে, এই হিসাবটা তাঁদের কাছে ঘোর অনৈতিক বলে মনে হয়। ড্যানিয়েল কানেম্যান এর নাম দিয়েছেন ‘ট্যাবু ট্রেড অফ’— একেবারে নিষিদ্ধ।
“এই যে পুরো ছবিটা দেখতে না-পাওয়া— ভ্যাকসিন দেওয়া না-দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সন্তানের গোটা জীবনের জন্য নেওয়া সব আর্থিক সিদ্ধান্তের অঙ্গ হিসাবে না দেখে শুধুমাত্র ভ্যাকসিনটুকু দেওয়া না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হিসাবেই দেখা, এর নাম ‘ন্যারো ফ্রেমিং’। এ কাজ লোকে আকছার করছে— গোড়ায় সূর্য শেয়ার বাজারের কথা তুলেছিল, সেখানে সারা ক্ষণ করছে। ধর, দুটো আলাদা কোম্পানির শেয়ার আছে— তার মধ্যে একটা লাভে আছে, অন্যটা ক্ষতিতে, কিন্তু দুটোতেই থাকা টাকার পরিমাণ সমান। তোর যদি সেই পরিমাণ টাকার প্রয়োজন থাকে, তা হলে কোন শেয়ারটা বেচবি? খুব অভিজ্ঞ এবং নিজের আবেগের উপরে কঠোর নিয়ন্ত্রণওয়ালা লোক না হলেই বলবে, যেটা লাভে আছে, সেটা। কারণ, ওতে লাভ উঠে গিয়েছে। অথচ, তুই-আমি সবাই জানি, যে শেয়ার এখন চড়ছে, অদূর ভবিষ্যতে সেটা আরও চড়ার সম্ভাবনা বেশি; যেটা পড়ছে, তার পড়ার সম্ভাবনাও বেশি। অর্থাৎ, চড়তি শেয়ারটা ধরে রাখলে বেশি লাভের সম্ভাবনা। তবুও লোকে ক্ষতিতে থাকা শেয়ারটা ধরে রাখতে চায় কেন?
তার উত্তর হল ন্যারো ফ্রেমিং। সব শেয়ারকে এক সঙ্গে দেখার বদলে আমরা প্রত্যেকটাকে আলাদা আলাদা খোপে— আলাদা অ্যাকাউন্ট হিসাবে— দেখি; আর স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসারে, প্রতিটি অ্যাকাউন্টেই খেলা শেষ করতে চাই লাভে থেকে। যাতে লাভ উঠে গিয়েছে, তার খেলা শেষ করতে আমাদের সমস্যা হয় না। কিন্তু, যেটা ক্ষতিতে আছে, সেটা বেচে দিলে সেই ক্ষতি পূরণ করার আর কোনও পথ থাকে না। আফসোস থেকেই যায় যে, ধরে রাখলে হয়তো লাভ দিতে পারত ওই শেয়ারও।” কথা শেষ করে শিবুদা উঠে পড়লেন।
পিছু ডাকল শিশির, “শেষ কথাটা বলে যান তবে, আফসোস না-করার কোনও উপায় আছে?”
“আছে, কানেম্যানই জানিয়েছেন,” ফের বসে পড়লেন শিবুদা। “উপায় হল চরমপন্থা— কোনও কাজ করার আগে হয় সব দিক প্রবল খুঁটিয়ে ভেবে নে; নয়তো একেবারে ভাবিস না। খানিকটা ভেবে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ, পরে মনে হবেই যে, ইস্ এটা তো ভেবেছিলাম!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy