E-Paper

উন্নয়নের কাদাগোলা স্রোত

দার্জিলিং, সিকিমের প্রাচীন জনগোষ্ঠী লেপচাদের উপকথায় তিস্তা যেন রূপকথার রানি। রঙ্গিতের সঙ্গে তার প্রেম, দাম্পত্য নিয়েও কত কথা।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০২৪ ০৮:৩২
Share
Save

হোয়াটসঅ্যাপে বানভাসি তিস্তার ছবি আঁতকে ওঠারই মতো। পাশের পাহাড় থেকে ধস নেমে এসেছে। গোটা এলাকা যেন ধ্বংসস্তূপ! সিকিম, কালিম্পং, দার্জিলিঙের মানুষ গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝেছেন, বর্ষা এলেই এমন বিপদ অবশ্যম্ভাবী। প্রতি বছরই ঘরদোর ভেসে যাবে, জীবনজীবিকা থাকবে না। সরকারি উদ্ধারকারী দল আসবে, ত্রাণ দেবে। এই বিপদ সরকারি খাতায়-কলমে ‘ন্যাচারাল ডিজ়াস্টার’। কিন্তু তার পিছনে দায় মানুষেরই। পরিবেশবিদ, ভূগোলবিদেরা বার বারই বলেছেন, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল পরিবেশ এবং ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে অতি সংবেদনশীল। সেই ভারসাম্যে সামান্য গড়বড় করলেই বড় বিপদ নেমে আসতে পারে। কিন্তু বল্গাহীন উন্নয়নের রথের সারথি রাষ্ট্রীয় নেতারা সে কথা একেবারেই শোনেননি।

দার্জিলিং, সিকিমের প্রাচীন জনগোষ্ঠী লেপচাদের উপকথায় তিস্তা যেন রূপকথার রানি। রঙ্গিতের সঙ্গে তার প্রেম, দাম্পত্য নিয়েও কত কথা। ওই এলাকার জনজীবনে তিস্তা নদীর ভূমিকা তাকে রূপকথার রানি কিংবা দেবীত্বে উন্নীত করেছিল। সেই নদীর উপরেই তৈরি হয়েছে একের পর এক বাঁধ। জলবিদ্যুৎ তৈরির নামে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই আটকে দেওয়া হয়েছে স্বাভাবিক জলধারা। পলি, পাথরে ভরে গিয়েছে নদীগর্ভ। তার বিপদ গত বছরই টের পাওয়া গিয়েছিল। উত্তর সিকিমে হিমবাহ হ্রদ ফেটে জল নেমে এসেছিল এবং তিস্তার বাঁধ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। কেন্দ্রীয় জল কমিশনই জানিয়েছিল যে, নদীর উপরে একের পর এক বাঁধ তৈরি হলে অতিরিক্ত জল বয়ে এলে হড়পা বানের পরিস্থিতি হবে। জ়ঙ্গু-র মতো জনপদের লেপচা অধিবাসীরা বহু দিন ধরেই এর প্রতিবাদ করেছেন। তবে সে সব কথা নীতি-নির্ধারকদের কানে পৌঁছয়নি।

আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে সিকিমের রাবংলা থেকে কিউজ়িং যাওয়ার পথে বিরাট আকারের ওক গাছের সারি দেখা যেত। এখন সে সব অতীত। চওড়া রাস্তা তৈরি করতে গিয়ে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস হয়েছে। ওই মহীরুহের শিকড়েরা পাথর, মাটিকে আগলে রাখত। এখন ফি বছর বর্ষা হলেই ধস নামে। সেই ধস ঢাল বেয়ে এসে পড়ে তিস্তা কিংবা তার উপনদীগুলিতে। এমনকি, পাহাড়ি এলাকায় বর্ষার জল বার করে দেওয়ার জন্য যে ছোট ছোট ঝোরা আছে, সে সবও আটকে যায়। তাই প্রবল বৃষ্টিতে অতিরিক্ত জল বেরোনোর উপায় থাকে না। পাহাড়ের উপর থেকে কাদাস্রোত রাস্তার উপর দিয়েই বয়ে যায়। অবশ্য এই ছবি শুধু সিকিমের নয়, দার্জিলিং, কালিম্পঙেরও।

কেউ বলতে পারেন যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো হবেই। তা বলে কি পাহাড়ি মানুষেরা উন্নয়নে শামিল হবেন না? এই পাহাড়ি এলাকায় অন্যতম বড় শিল্প পর্যটন। উন্নত পরিষেবা না পেলে পর্যটকেরাই বা যাবেন কেন? প্রথমত, সব এলাকার উন্নয়নের নকশা এক নয়। খাস কলকাতা শহরে আকাশচুম্বী অট্টালিকা হতে পারলেও টাইগার হিলে সে সব করা যায় না। উপরন্তু, উন্নয়নের ক্ষেত্রে বর্তমানে একটি সমীক্ষার কথা বলা হয়— এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ)। অর্থাৎ, এই কর্মকাণ্ডের প্রভাব পরিবেশে কতটা পড়বে। পাহাড়ি এলাকায় যে ভাবে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ চলছে তাতে সে সব পরীক্ষা কতটা ঠিকমতো করা হয়, আদৌ করা হয় কি না, ঘোরতর সন্দেহ থেকেই যায়। এমনিতেই পাহাড় লাগোয়া এলাকায় বর্ষার দাপট বেশি। তার উপরে সাদা চোখেই দেখতে পাওয়া যায়, উত্তরবঙ্গের পাহাড় এবং তরাইয়ে গত কয়েক দশক ধরে বৃষ্টিপাতের ধরন বদলাচ্ছে। সে সব কথা গবেষক এবং খোদ সরকারি সংস্থার সমীক্ষাতেও উঠে এসেছে। কিন্তু উন্নয়নের পরিকল্পনার সময় বোধ হয় সে সব তথ্য মাথায় রাখা হয়নি।

দ্বিতীয়ত, পাহাড়ি এলাকায় উন্নয়নের যুক্তিগ্রাহ্যতা নিয়েও তো প্রশ্ন উঠতে পারে। ইদানীং কালিম্পং, সিকিমে বড় বড় হোটেল তৈরি হচ্ছে। তাতে আর পাঁচটা আরামপ্রদ ব্যবস্থার সঙ্গে সুইমিং পুলও গড়ে উঠছে! অবশ্য, সরকারই যেখানে পাহাড় ভেঙেচুরে সেবক-রংপো রেলপথ তৈরি করছে, সিকিমের সীমান্তবর্তী এলাকায় পরিবেশের পক্ষে ক্ষতিকর পেল্লাই মাপের রাস্তা তৈরি করছে, সেখানে প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠী হোটেলে সামান্য সুইমিং পুল করবে না কেন?

পাহাড়ি এলাকায় পর্যটন শিল্প প্রয়োজন। কারণ, এর উপরে বহু মানুষের জীবনজীবিকা নির্ভরশীল। অনেক সময়ই জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে প্রান্তিক মানুষকে আইনের বাঁধন থেকে কিছুটা শিথিলতা দেওয়া হয়। কিন্তু বর্তমানে সিকিম, দার্জিলিং জুড়ে যে উন্নয়ন হচ্ছে, তাতে এই প্রান্তিক মানুষদের অধিকার কতটা? বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় বাসিন্দারাই এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করেছেন। সেই প্রতিবাদ এটুকু প্রমাণ করেছে যে তথাকথিত পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও প্রান্তিক মানুষের মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা আছে। প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের ফলে তাঁরা বুঝতে পারেন, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে এই কাজের ফল কী হতে পারে?

পশ্চিমবঙ্গ-সিকিমের জনসংযোগকারী জাতীয় সড়কের এক ভিডিয়ো চোখে পড়ল। দু’কূল ছাপিয়ে তিস্তার জল জনপদ ভাসিয়ে দিয়েছে। তারই মাঝে একটি পাথরখণ্ডের উপরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন এক নেপালি মহিলা। চোখে শূন্য দৃষ্টি।

উন্নয়নের রথে চাপা পড়া মানুষের প্রতীক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Teesta River landslides Natural Disasters

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।