ব়্যাগিং বন্ধ করার দাবিতে প্রতিবাদ। —ফাইল চিত্র।
যাদবপুরে পড়তে যাওয়া কিশোর ছাত্রটির মৃত্যু যে কার্যত ‘খুন’, এ নিয়ে কোনও সংশয়ের অবকাশ নেই। বিভিন্ন মহলে বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু চর্চা, তর্ক, আলোচনা হয়ে গিয়েছে। এখনও হচ্ছে। তবে দেখছি, ঘটনার নিন্দা করতে গিয়ে অনেকেই নানা ভাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক গৌরব, মর্যাদার দিকগুলি বড় করে তুলে ধরছেন। কেউ কেউ আবার এটাও বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, র্যাগিং ব্যাপারটি আসলে নবাগতদের ‘গড়েপিটে তৈরি করে’ নেওয়ার একটি রসিক-প্রক্রিয়া!
সন্দেহ নেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসাবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শুধু রাজ্যের নয়, সারা দেশের গর্ব। ভারতের অগ্রগণ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে এখন তার স্থান। এখানকার পঠনপাঠন, শিক্ষার্থীদের মান, পরীক্ষার ফল, উত্তীর্ণদের জন্য বৃহত্তর ক্ষেত্রে বেশি সুযোগের সম্ভাবনা ইত্যাদি মিলেমিশে আজকের যাদবপুর মেধাবী পড়ুয়াদের পছন্দের শীর্ষে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
এখানে ‘মুক্তচিন্তা’র পরিসরও আর পাঁচটি শিক্ষাঙ্গনের তুলনায় বেশি। কর্তৃপক্ষ সচেতন ভাবে সেই আবহ ধরে রাখার পক্ষে কথা বলেন। রাজনৈতিক উত্তাপ, আন্দোলন, প্রতিবাদ এখানে প্রায়ই তীব্র আকার নেয়, সেটা ঠিক। তবে তার ভিতর থেকে রাজনীতি ও সংস্কৃতি-চেতনার অন্য রকম কিছু ভাবনাও কখনও ফুটে বেরোয়। সবচেয়ে বড় কথা, মুক্তচিন্তা এবং সুস্থ ভাবে বহুমতের প্রকাশ তো সর্বদাই স্বাগত। তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যে কোনও অন্যায় আছে বলে মনে করি না।
কিন্তু প্রশ্ন তখনই ওঠে, যখন কোনও স্বাধীনতা যথেচ্ছাচারে পর্যবসিত হয়। ‘মুক্তমনা’দের আচরণ কমজোরিদের উপর নিপীড়নের উৎকট আনন্দ হয়ে ওঠে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সেখানেও বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গিয়েছে। আজ নয়, বেশ কিছু কাল। এ বার এই কিশোরের মৃত্যু সেই তালিকায় চরমতম এক সংযোজন। তাই গর্বের মুকুট মাথায় তোলার সঙ্গে সঙ্গে কলঙ্কের কালিও প্রতিষ্ঠানকে মাখতে হবে। যুক্তির আড়ালে তাকে ঢাকা যাবে না।
একই সময়ে অনুরূপ ঘটনার ক্লেদ লেগেছে খড়্গপুর আইআইটি-র গায়ে। র্যাগিং নিয়ে গুরুতর অভিযোগ শোনা গিয়েছে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের হস্টেলেও। তারাও গরিমাময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন থাকে ওই সব জায়গায় পড়ার।
তবে প্রতিষ্ঠান যেমন শুধু ইট-কাঠ-লোহা-সিমেন্টে বাঁধানো ইমারত নয়, তেমনই তার গর্ব শুধুই শিক্ষক ও পড়ুয়াদের জ্ঞান এবং মেধার উৎকর্ষে সীমায়িত থাকতে পারে না। মূল্যায়নটা সেখানে সার্বিক মাপকাঠিতে হয়। যে কারণে ধরে নেওয়া হয়, পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধ, সামাজিক অনুশাসনের মতো কিছু ‘শিক্ষা’ তাদের থাকবে। সেই জন্যই হয়তো ‘ভাল’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আসা ছাত্ররা অন্য যে কারও থেকে কিঞ্চিৎ বেশি সমীহ পেয়ে থাকেন। তাঁদের কাছে সমাজের প্রত্যাশাও থাকে সেইমতো। পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের পাশাপাশি স্কুল-কলেজের পরিচিতিও তাই বৃহত্তর বৃত্তের বহু ক্ষেত্রে বিবেচনায় প্রাধান্য পায়। ফলে আশাবাদী মা-বাবা মাত্রেই চান, তাঁদের সন্তান যেন এমনই কোনও প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ পায়।
কিন্তু মেধার জোরে নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারাই যে সেখানকার হস্টেলে থেকে পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়, নদিয়া থেকে যাদবপুরে যাওয়া নিম্নবিত্ত পরিবারের কিশোর ছাত্রটি প্রাণের বিনিময়ে ফের সেই বার্তা দিয়ে গেল। সে জানিয়ে গেল, হস্টেলে ‘সিনিয়র দাদা’ নামক বিকৃতকাম, কদর্যরুচি, অ-মানবিক (এবং অবশ্যই মেধাবান) একদল দ্বিপদের হাতে মরণ-বাঁচন সঁপে না-দিলে এই রকম একটি স্বপ্নের শিক্ষাঙ্গনে পড়াশোনা করা কঠিন। যাঁরা তা পারবেন না, তাঁদের জন্য ‘গুডবাই’!
জানি না, আইআইটি পড়ুয়ার মৃত্যু-রহস্যের জট খুললেই বা কী বেরোবে! তবে এটা তো দেখাই যাচ্ছে, এক বিচারপতি ‘সিট’ গড়ে ওই মৃত্যুর তদন্তের নির্দেশ দিতেই তা আটকানোর জন্য আইআইটি এবং রাজ্য সরকার হাত ধরাধরি করে অন্য আদালতে দৌড়েছে। এর চেয়ে বিস্ময়ের আর কী বা হতে পারে!
তাই আরও জোরের সঙ্গে বলা যায়, মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও একটি নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হস্টেলে টিকে থেকে পড়া চালাতে হলে এক জন পড়ুয়াকে আগে যে কোনও রকম জঘন্য, নিষ্ঠুর শারীরিক ও মানসিক পীড়ন মুখ বুজে সহ্য করার ‘পাঠ’ নিতে হবে। তাকে জেনে নিতে হবে, অন্যথা হলে তার জন্য পড়াশোনা চালানোর অনুকূল পরিস্থিতি সেই সব প্রতিষ্ঠান দিতে পারবে না।
টাটকা উদাহরণ, এই সংবাদপত্রেই প্রকাশিত আমেরিকাবাসী এক বাঙালি বিজ্ঞানীর সাম্প্রতিক স্মৃতিচারণ। যা আমাদের সরাসরি ওই সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। আমরা জানতে পারি, যাদবপুরের কিশোর ছাত্রের মতো তিনিও র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে তিনতলা থেকে নীচে পড়ে গিয়েছিলেন। বরাত জোরে বেঁচে যান। আইআইটি ছেড়ে পালান।
মৃত্যু হয়তো কখনও এক জনের হয়। এ বার যেমন যাদবপুরের ঘটনা এবং এত আলোড়ন। কিন্তু দশকের পর দশক শিক্ষাঙ্গনে র্যাগিং তো বন্ধ হয় না। কারণ পীড়নের এই ধারাবাহিকতা বন্ধ করার সাধ্য, সদিচ্ছা, ক্ষমতা কিছুই কারও নেই। না পরিচালকদের, না পড়ুয়াদের।
এটাই সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব। বাকি যা, সেগুলি পোশাকি ‘আহা’ এবং শূন্যগর্ভ হুঙ্কারমাত্র! কিছু দিন পরে আবার যথা পূর্বম্। এ বিষয়ে সকল কর্তৃপক্ষের নিশ্চেষ্ট ভূমিকা, পরোক্ষ প্রশ্রয় এবং দায় এড়ানোর মানসিকতা প্রকৃতপক্ষে গোটা শিক্ষা-প্রশাসনকেই জনতার কাঠগড়ায় টেনে এনেছে। প্রশ্ন জাগে, এই সব অপদার্থ ‘কর্তা’দের ছত্রছায়ায় আমাদের ছেলেমেয়েরা কতটুকু সুরক্ষিত?
এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে হবে না তার বিশ্বাসযোগ্য নিশ্চয়তা কে দেবেন? কোন মন্ত্রী? কোন আচার্য? কোন উপাচার্য? কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান? ঘটনা হল, প্রকৃত সমস্যা মোকাবিলার ‘সাহস’ এঁদের কারও নেই বলেই রাজনীতির রঙে চুবিয়ে মূল বিষয়টি ঝাপসা করে দেওয়ার মতো ‘সস্তায় পুষ্টিকর’ পথটি বার বার বেছে নেওয়া হয়! এ বারেও দেখুন, যাদবপুরে সেই চেষ্টা স্পষ্ট।
বস্তুত গ্রাম থেকে আসা এক জন নবাগত পড়ুয়াকে এক ঝাঁক প্রাক্তনীর নেতৃত্বে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়াতে কী রাজনীতি ছিল— অথবা এতে কোন সিপিএম, কোন নকশাল, কোন বিজেপি, কোন তৃণমূল কী ভাবে ‘লাভবান’ হবে, বলতে পারব না। পরিস্থিতি ‘কাজে’ লাগাতে কেউ যদি ঘোলা জলে ভেসে ওঠার রাজনীতি করতে চায়, সে দায় তাদের।
পাশাপাশি অবশ্যই বলতে হবে, এক-একটি দায়িত্বশীল পদ ‘অলঙ্কৃত’ করে যাঁরা সেই সব পাপাচারকে নীরব প্রশ্রয় জুগিয়ে চলেন, অপরাধ তাঁদেরও একবিন্দু কম নয়। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ তথা হস্টেলের নিয়মশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে গাফিলতির চরম নজির তৈরি করেছেন, ঘটনার দিনেও নড়ে বসেননি, এমনকি দিনের পর দিন ছাত্রদের হস্টেলে ‘বহিরাগত’দের মৌরসিপাট্টা এবং মদ-মাদকের আসর চলতে দিয়েছেন, তাঁদের এখনও পদে বসিয়ে রাখা হয় কেন? তাঁরা কি এতটাই প্রভাবশালী বা অপরিহার্য যে, কর্তৃপক্ষ তাঁদের তাৎক্ষণিক ভাবেও সরিয়ে দিতে পারেন না? মগডালে ঘা দিতে কিসের দ্বিধা? কিসের ভয়?
সাধারণ পড়ুয়াদের নিরাপত্তাহীনতা, অভিভাবকমহলের শঙ্কা, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উদ্বেগ এ সবের ফলে আরও বাড়ছে। সদিচ্ছা নিয়ে সংশয় ঘনীভূত হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার উপর যার ছায়াপাত অনিবার্য।
ভুললে চলবে না, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সকলের গর্ব। যেমন গর্ব রাজ্যের আইআইটি। আমরা সবাই চাইব কলঙ্কের মোচন। ক্ষমতাধরেরা এটা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই মঙ্গল। একই সঙ্গে বলব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের কথা। এ বার কিন্তু তাদেরও একত্রে সরব হওয়ার সময়। আর বিলম্ব নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy