পৌষের হিম-হিম রাত। আশেপাশের কোনও বাড়ি থেকেই আর কোনও শব্দ আসে না। হয়তো অল্প একটু ‘হ্যাঁচ্চো’ শোনা গেল, অথবা খুব ক্ষীণ ভাবে টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা সুদীর্ঘ ও একঘেয়ে বাক্যরাজি— এর বাইরে কিছু নেই। তার মাঝে বসেই মফস্সলের বাড়ির সামনের চিলতে জায়গাটিতে দু’টি বিড়ালকে অতি যত্নে তাদের রাতের খাবার খাইয়ে দিচ্ছিল বোন। প্রতি রাতে এ ভাবেই তারা খাবারটুকু খায়। তার পর তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে দু’টি বিড়াল ধীরে ফিরে যায় নিজেদের আস্তানায়। জীবনের একেবারে নিজস্ব, প্রায়-অলৌকিক যে আন্তরিকতাটি রয়েছে, তাকে গায়ে মাথায় নেবে বলেই যেন প্রতি বার ফিরে আসে বিড়াল দু’টি। যে জায়গায় তারা ফিরে যায়, সেখানে ছাড়া আর সম্ভবত কোথাও তাদের ফিরে যাওয়ার নেই। কিন্তু, অন্তত এই দৃশ্যটি লক্ষ করলে মনে হয়, তাদের এখনও চাওয়ার আছে কিছু। কী চাওয়ার আছে তাদের— ন্যূনতম চাহিদা, যা আসলে এই দুনিয়ার প্রতিটা প্রাণের অবচেতনেই থেকে যায় বিরতিহীন— ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের কাছে এখনও খরচ না হওয়া জীবনটুকু।
সেই খরচ-না-হওয়া জীবনটুকুকে আগলে রাখার জন্য আমরা কখনও দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসি। কখনও উঠে দাঁড়াই। আর করি গল্প। মৃত্যুর গল্প। তার আরম্ভ যেমন ধোঁয়াটে, বিস্তারও তাই। অথচ, সেই গল্প আর অবশ করে না আমাদের। অস্থিরও করে না। মানুষ যেমনই হোক, মৃত্যুর কাছে সে অপ্রস্তুত, নিঃসঙ্গ এবং নিঃস্ব। প্রায় টানা দু’বছর ধরে এর একটা সামগ্রিক ব্যত্যয় ঘটেছে। আমাদের একেবারে কাছের যারা মানুষ, রোজকার চা-জলখাবারের মানুষ, পিঠে হাতটা রেখে ‘ভাল আছিস তো, রে?’ বলার মানুষ, শীতের সকালে আধ কাপ মধু হাতে করে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢোকা মানুষ— তাদের কত জন কেমন গড়াতে গড়াতে একটি বড় ঘুমের দিকে চলে গেল! অথচ, আমাদের গায়ে একটা ফোস্কাও পড়ল না আর! আমরা কেবল পরবর্তী মৃত্যু-সংবাদটি শোনার জন্য নিজেকে ক্রমে আরও একটু প্রস্তুত এবং নিপুণ করে তুললাম।
এই ‘আমরা’ আসলে কারা? এই যে বিশাল মৃত্যুযজ্ঞের আয়োজন, তারই আর এক রকম প্রত্যক্ষদর্শী। মজার ব্যাপার, ‘মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী’ শুনলে সচরাচর যেমনটা মনে হওয়া দস্তুর, যে অ-মানবিকতা এবং অ-সংবেদনশীলতার নিদর্শনগুলি ফট করে উঠে এসে ধাক্কা মারে, এ ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। এ ক্ষেত্রে, এমনকি, এগিয়ে যাওয়ার সামান্যতম ‘অধিকারটুকু’-ও সে হারিয়ে ফেলেছে। সংবেদনশীলতা রাখতে গিয়ে হায়, কে আর নিজের প্রাণটি খোয়াতে চায়! তাই এগিয়ে যেতে চাইলেও সে নিরুপায়। এর ফলে কী হল? মৃত্যুর আগের যে ব্যথা ও বিষণ্ণতা, তা উপশমের জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও পারল না মানুষ। দমবন্ধ আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে আলো ও আঁধারের মধ্যেই চিন্তা ও যাবতীয় যা ভাব, তার আদানপ্রদান তাকে সেরে নিতে হল কার্পণ্যে, একটি মাত্র শব্দে, যে শব্দই হয়ে দাঁড়িয়েছে গত দু’বছরের জীবনের স্তব্ধতার ভাষা— ‘অতিমারি’।
প্রকৃতির নিয়ম মেনেই শীত, গ্রীষ্ম, ঝড়, খরা, বন্যা, ভূমিকম্প— সবই এল একটু একটু করে। গত বছরও এসেছিল। এই বছরও এল। তার মাঝেই রয়ে গেল অতিমারি। টিকা নেওয়া হল। মানুষ হাসতে হাসতে লাইনে দাঁড়িয়ে তা নিলও। ছবি দিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। ‘সাকসেসফুলি জ্যাব্ড’ শব্দ দু’টি পেল নতুন মাত্রা। কেবল, যে নিটোল আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, তা আর গেল না। মৃত্যু থিতিয়ে এলেও, মৃত্যুবোধটি আর আত্মগোপন করতে পারল না কোনও ভাবে। তারার আলোর মতো অকম্প ও স্থির হয়ে থেকে গেল সেটি। ঠিক যে ভাবে অচিকিৎস্য অসুখের বীজাণু রয়ে যায় শরীরের মধ্যে, কিছুতেই আর যেতে চায় না!
২০২১ সালের শুরুতে আমরা প্রায় প্রত্যেকেই আসলে কী ভেবেছিলাম? একেবারে স্পষ্ট করে তা বলা সম্ভব না হলেও, এটুকু বলাই যায় যে, ২০১৮, ২০১৯, এমনকি ২০২০ সালের শুরুতেও যা যা ভেবেছিলাম, যে ভাবে ভেবেছিলাম, সেই ভাবনার সঙ্গে চলতি বছরের শুরুর ভাবনার কিছু পার্থক্য রয়ে গিয়েছে। আমরা ভেবেছি আমাদের ভাল চাকরি হবে ও তাতে উন্নতি হবে, বিভিন্ন ধরনের সম্পদের অধিকারী হব আমরা, নতুন প্রেম হবে, ভালমন্দ খাওয়াদাওয়া করতে পারব, সমস্ত ধরনের সরকারি ঘোষণার পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ দেখতে পারব— এই সব প্রত্যাশার পাশে মনে মনে আর্ত হয়ে উঠতে উঠতেও প্রায় ফুটনোটের মতো করে এই আশাটিও রাখতে ভুলিনি যে, আমরা যেন বেঁচে থাকি এই বছর।
আমরা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠতে পারি। ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর কী হবে বা হতে পারে, আমরা জানি না। আমাদের চাকরি চলে যেতে পারে, আমাদের সমস্ত সম্পদ কেড়ে নেওয়া হতে পারে, আমাদের অত্যন্ত দুঃখজনক বিচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে, প্রতি বছরের মতোই এই বছরেও সরকারি প্রতিশ্রুতির আংশিক প্রয়োগও দেখা না যেতে পারে, তা থেকে বিহ্বলতা আসতে পারে। কিন্তু, তার পরেও, আমরা যে বেঁচে আছি এখনও, এত কিছুর পরেও, সেই আনন্দটুকুকে একেবারে জড়িয়েমড়িয়ে নিতে ভুলব না। এ কথা তো সকলেই জানি যে, মৃত্যু একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালে, চির-বিচ্ছেদের দিকে ঘূর্ণাবর্তের বেগে টেনে নিয়ে যাওয়ার ক্ষণটি উপস্থিত হলে, জীবনের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়। বস্তুত, সে দিক দিয়ে দেখতে গেলে, বিশ্ব জুড়েই ২০২১ সালের গোটা বছরটারই এক সার্বভৌম জীবন-চেতনার বছর হয়ে ওঠাও বটে। এত তীব্র ভাবে আমরা শেষ কবেই-বা বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম!
পাশাপাশি, এর বিপরীত দিকটিও রয়েছে। সেটিকে ভুলে গেলেও চলবে না। মানুষের আঁচ থেকেই তৈরি হয়ে যায় মানুষ। ঠিক সেই কারণেই, সব সময় মিশতে না পারলেও, মিশে যাওয়ার জন্য আমাদের মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন এবং সত্য কামনা থাকে। কিন্তু, এখন যখন সে দিকে তাকাই, তাকে নিছকই একটি অলীক কল্পনা বলে মনে নিতে এবং মেনে নিতে বাধ্য হই। ধরা যাক, সেই অভিভাবকদের কথা, যাঁরা কোভিডের কারণে তাঁদের সন্তানকে হারালেন। শুধু যে হারালেন তা-ই নয়, সন্তানকে স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারলেন না, জানতেও পারলেন না শেষে সন্তানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটি হয়েছিল ঠিক কোথায়— তাঁদের পক্ষে আর কখনও অপরের সঙ্গে শারীরিক মেশামেশি একেবারে অসম্ভব না হলেও, তা তো কঠিন বটে!
কুয়াশা কেটে গেলে অনেক কিছু দেখা যায়। চুনসুড়কি খসে পড়া রাতের মধ্য থেকে চাঁদ উঠে এলে তা নাম, দাগ, খতিয়ান, দলিল, মিউটেশন পর্যন্ত সবই দেখিয়ে দিতে পারে। কোভিড-কাল আসলে যেন সে রকমই। এ পিঠ-ও পিঠ করে যা আমাদের প্রায় সবটাই দেখিয়ে দেয়। ইস্কুল এক দিন ঠিকই খুলবে, ধীরগতির ইন্টারনেট কানেকশন নিয়ে কম দামি ফোনের ক্যামেরার সামনে বসে আর ক্লাস করতে হবে না— এই আশা নিয়ে থাকতে থাকতে একটা প্রজন্মের লক্ষাধিক ছেলেমেয়ে পড়াশোনাই ছেড়ে দিল। বিয়ে হয়ে গেল কারও, মাঠে বাবার সঙ্গে চাষ করতে চলে গেল কেউ কেউ। অপর দিকে, তাদের একেবারে বিপরীত গোলার্ধে বসে থাকা অপর একটি প্রজন্মের ষাট পেরোনো কত মানুষ বাড়ি থেকে আর বেরোতেই পারলেন না কখনও। বহু দিনের জীর্ণ কলমি ডাল হয়ে মৃত্যু ঝুলে রইল ঠিক জীবনের মাথার উপরেই! মাস্ক পরে থাকতে থাকতে তাঁদের নিজের ঘরটিই অচেনা হয়ে উঠল ক্রমশ। যে কাঁঠালিচাঁপা গাছটি যত্ন করে পুঁতেছিলেন, জল না পেতে পেতে তা-ও মরে গেল এক সময়।
মৃত্যুর রুক্ষ, তপ্ত মাটিতে বসে জীবনের ফুল ফোটানোর কৌশল আয়ত্ত করার প্রক্রিয়াটি সহজ নয়। মৃত্যুমুখী অন্ধকারকে প্রতিনিয়ত সঙ্গে করে চলতে চলতে কখনও অসহায়ের মতো গম্বুজের দিকে ঢিল ছুড়ে দিয়েছি একের পর এক। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে উঠতে গিয়ে দেখেছি, ওটার কিছুই হল না, কেবল নিজেদের লালাতেই ভিজে গেল জামার উপরের বোতাম। তার চূড়ায় তাক করে মারতে গিয়ে দেখেছি, পায়ের পাতার সামনে গড়িয়ে পড়ল ভাঙা দুর্বল তির... আকাশের রং পাল্টায়। কালাচ সাপের মতো শব্দহীন ঘুরে বেড়ায় এক ভাইরাস। শব্দহীন ক্লান্তহীন ঘুরে বেড়ায় কত মানুষও! কোভিড-আবহের মধ্যে ব্যক্তিগত শোকের মোকাবিলা করতে কলকাতা শহর জুড়ে অলি-গলি ঘুরে নীল রং খুঁজে খুঁজে তার ছবি তুলে বেড়ায় এক বন্ধু। সে ঠিক করেছে কোনও তাড়াহুড়ো করবে না, তুলেই যাবে এই সব নীল রং, যত দিন না অন্য একটি রঙের সন্ধান পাচ্ছে।
গলাটেপা মধ্যরাতগুলির মধ্যে মিশে গিয়েছে আমাদের জিতে যাওয়া-হেরে যাওয়ার এই ন’টা-ছ’টার জীবন। তবু, বছরের শেষ দিকে এসে আশা করতে ইচ্ছে করে, এই মাঝরাতকে সঙ্গে নিয়ে চলা অতি তপতপে জীবনটির অভিমুখ আসলে পূর্ব দিকেই। ভোর হয়নি এখনও। তবু, একটি ভোরের দিকেই ছুটছে সে। একটি মুখোশ-হীন পৃথিবীর দিকে ছুটছে। যেখানে একটু জল পেতে আর কোনও কাঁঠালিচাঁপার কখনও অসুবিধা হবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy