ছ’কিলোমিটারের কিছু বেশি লম্বা এবং অতিকায় এই নির্মাণ যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়ে গিয়েছে। যার জোরে বাংলাদেশ সমস্বরে বলে— নিজের টাকায় নিজের সেতু। মূল ছবি: শাটারস্টক, ছবি সম্পাদনা: শৌভিক দেবনাথ।
ছবি তুলবেন না! এখানে ছবি তোলা যাবে না! খুব নৈর্ব্যক্তিক গলায় বললেন বাংলাদেশ ফৌজের অফিসার।
ছবি তোলা যাবে না? অ্যাঁ! বলে কী! এত দূর থেকে এসে এট্টু ছবিও তোলা যাবে না? ঘন কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে চরাচর। কয়েকশো মিটার দূরের বস্তুও ঠাহর হচ্ছে না ঠিকঠাক। সেই কুয়াশা ভেদ করে খানিকটা জেগে ছিল এক মহাকায় নির্মাণ। বড় রাস্তা ছেড়ে ডান দিকের একটা রাস্তা ধরে পৌঁছেছি পদ্মাপারের মাওয়া ঘাটের অনতিদূরে কাঁচা মাছের ততক্ষণে গুটিয়ে-যাওয়া পাইকারি বাজারে। যে বাজার শুরু হয় ভোরবেলায় ফজরের নমাজের সময়। শেষ হয়ে যায় ভাল করে রোদ্দুর ওঠার আগেই।
সেই গুটিয়ে-যাওয়া বাজারের বাতাসে তখনও লেগে-থাকা আঁশটে গন্ধ নাকে নিয়ে বালি পেরিয়ে পদ্মার পারে পৌঁছেছে ভারতীয় সাংবাদিকদের দল। বাঁ পাশে পদ্মা সেতুর কুয়াশায় ঝাপসা অবয়ব। সামনে কুয়াশায় ঢাকা পদ্মা। নদীর পার বরাবর একটা রাস্তা তৈরি হচ্ছে। আসা-যাওয়া করছে বুলডোজ়ার, বিশাল বিশাল গতরের ট্রাক। পরিকাঠামো উন্নয়নের বান ডেকেছে।
তার উপরের আকাশে একটা ন্যাড়ামাথা, রোগাভোগা কমজোরি সূর্য কোনও মতে লাট খাচ্ছে। ছবি তোলার পক্ষে বিশেষ জুতসই আবহাওয়া নয়। কিন্তু পদ্মা সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছবি না-তুললে তো আবার জীবনই বৃথা! অতএব, গোটা দলটা গুটগুট করে এগোল, যাতে ভাল ব্যাকগ্রাউন্ড পাওয়া যায়। তখনই যেন স্রেফ মাটি ফুঁড়ে উদয় হলেন ফৌজি অফিসার। এবং নিদান দিলেন— ছবি তোলা যাবে না!
কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের প্রটোকল অফিসারের কি সে সব শুনলে চলে? তিনি বিদেশি প্রতিনিধিদল নিয়ে এসেছেন। খালেদা জিয়ার আমলে প্রভাবশালী মন্ত্রীর আপ্ত-সহায়ক ছিলেন। এ সব ম্যাও-ঘৌ অনেক সামলেছেন। সুতরাং কঠিন গলায় তিনি বললেন, ‘‘আমি একজন সরকারি অফিসার। গেজেটেড অফিসার। আপনি আমায় বাধা দিতে পারেন না!’’
উল্টো দিকের মানুষটি হাসিমুখে শুনলেন। তার পরে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, ‘‘আমিও একজন মিলিটারি অফিসার। এই সেতুকে রক্ষা করা আমার দায়িত্ব। আমি আপনাদের এখানে ছবি তুলতে দিতে পারি না।’’
চোটপাটে লাভ হল না। সুড়সুড় করে বালি-বিছানো পথ ধরে এসে আবার মাইক্রোবাসে উঠে পড়তে হল। তার কয়েক মিনিট পরে কুয়াশা ভেদ করে যখন সেই সেতুর উপর উঠছিলাম, মনে হল, ফৌজি অফিসারের নীচু এবং নম্র কণ্ঠ থেকে আসলে ঠিকরে বেরোচ্ছিল প্রখর আত্মবিশ্বাস। ছ’কিলোমিটারের কিছু বেশি লম্বা (স্থলভাগের বিস্তার ধরলে প্রায় ১০ কিলোমিটার) এবং অতিকায় নির্মাণ যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়ে গিয়েছে। যার জোরে বাংলাদেশ সমস্বরে বলে— নিজের টাকায় নিজের সেতু।
দরপত্র প্রক্রিয়ায় ‘দুর্নীতি’র অভিযোগ এনে গোটা প্রকল্প থেকে মাঝপথে হাত তুলে নিয়েছিল বিশ্বব্যাঙ্ক। কিন্তু থমকে যাননি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিজেদের অর্থে বাংলাদেশ শেষ করেছে সেতু নির্মাণ। নিজেদের টাকায়। নিজেদের সেতু।
অ্যাপ্রোচ রোডের দৈর্ঘ্যই ১২ কিলোমিটার। ইংরেজি ‘এস’-এর মতো আকৃতির এই সেতু দোতলা। উপরের তলায় সড়ক। নীচের তলায় রেললাইন (সেই কাজ অবশ্য এখনও শেষ হয়নি)। কিন্তু সড়কপথে রোজ গড়ে ৭৫,০০০ যানবাহন যাতায়াত করে এই সেতু দিয়ে। ১৮ মিটার নীচে পদ্মার জল।
ঝাঁ-ঝাঁ করে ও পারে পৌঁছলাম। ঘুরে আসার সময় টোল দিতে হল ১,৩০০ বাংলাদেশি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানলাম, চার চাকার গাড়ির টোল ৭৫০ টাকা। মাইক্রোবাসের ১,৩০০ টাকা। মাঝারি বাস ২,০০০ টাকা। ট্রাক ২,৮০০ টাকা। ট্রেলার ৬,০০০ টাকা। বাইক নিয়ে গেলে ১০০ টাকা।
দৈনিক টোল আদায় হয় প্রায় ২ কোটি (ঠিকই পড়লেন, দু’কোটি) বাংলাদেশি টাকা! শাসকদল আওয়ামি লীগের দু’নম্বর নেতা তথা দেশের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের হিসেব দিচ্ছিলেন, গত জুনে উদ্বোধনের পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি টাকা টোল আদায় হয়েছে পদ্মা সেতু থেকে। বাংলাদেশ সরকারের ধারণা, এমন চললে সেতু তৈরিতে খরচ-হওয়া ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকার অনেকটাই আগামী কয়েক বছরে তুলে ফেলা যাবে।
দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ কভার করতে বার্জে করে গাড়ি-সহ পদ্মা পেরিয়ে বরিশালে গিয়েছিলাম। বার্জের অধিপতি ক্যাপ্টেন পদ্মায় জাল ফেলিয়ে, মাছ ধরিয়ে, আঁশবঁটিতে সেই মাছ কাটিয়ে, ভাজিয়ে খাইয়েছিলেন। তখনও বরিশাল পৌঁছইনি! ঠিক যে কথাটা বললেন খানিক নস্ট্যালজিয়া-আক্রান্ত বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, ‘‘আগে আমরা যখন ও পারে টুঙ্গিপাড়া যেতাম, তখন এ পারে মাওয়া ঘাট থেকে ইলিশ কিনে উঠতাম। ভেসেলে ইলিশভাজা দিয়ে গরম খিচুড়ি খেতে খেতে পদ্মা পেরোতাম। এখন নতুন সেতু উন্নয়নের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে সব অনন্য অভিজ্ঞতা হারিয়ে গিয়েছে। সেটা খুব মিস্ করি।’’
তবে কিনা, এ নেহাতই অতীতচারণ। যে অতীতের অনেকটাই বাংলাদেশ পিছনে ফেলে এসেছে। কোথায় পদ্মা পেরোনোর সেই দেড় থেকে দু’ঘণ্টা। আর কোথায় এই ১৫ থেকে ২০ মিনিট! ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এখন ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ হতে চায়। যে স্মার্টনেসের অন্যতম সূচক পরিকাঠামো (ঢাকার ভাষায় ‘অবকাঠামো’)। সেই অবকাঠামোর প্রথম সূচক পদ্মা সেতু। দ্বিতীয়, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলা দিয়ে পণ্যবাহী যান যাতায়াতের টানেল। তৃতীয়, ঢাকা মেট্রো। তার সঙ্গে যোগ করুন ঢাকা শহরে একাধিক উড়ালপুল, নির্মীয়মাণ ৪১ কিলোমিটার লম্বা ‘এলিভেটেট এক্সপ্রেসওয়ে’, চট্টগ্রাম শহরে নির্মীয়মাণ ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালপুল ইত্যাদি ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। বিমান পরিবহণের পরিভাষায় বলতে গেলে, উন্নয়নের পাখনায় ‘টেল উইন্ড’ লেগে গিয়েছে। যা কাজের গতিকে ধাক্কা মেরে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
পরিকাঠামো বাড়লে ঘরোয়া উৎপাদন বাড়ে। বাড়ে মাথাপিছু আয়। এমনিতেই গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক স্বাবলম্বী হয়েছে। আরও বৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে শেখ হাসিনার শাসনাধীন দেশ। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মস্ত বড় প্রভাব বিস্তারকারী পদ্মা সেতু সেই অগ্রগতির ‘অভিজ্ঞান’ও বটে।
কিন্তু ইতিহাস বলে, উন্নয়নের পিছু পিছু আসে খানিক নিরাপত্তাহীনতা, খানিক পুরনোর ক্ষয়, খানিক বিরোধিতাও। যেমন অনেকে বলছেন, পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াতের ফলে যশোর এবং বরিশাল থেকে বিমান পরিষেবা ধাক্কা খেয়েছে। যশোর থেকে রোজ ১৪টি উড়ান চলত। এখন তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে চারে। বরিশাল থেকে দিনে চারটি উড়ান চলত। তা নেমে এসেছে একটিতে। মাওয়া ঘাটের ফেরি বন্ধ। অতএব বরিশাল থেকে বাসে করে ঢাকা যেতে হয়। সে না হয় হোক। কিন্তু পদ্মা সেতুতে বিপুল পরিমাণ টোল ট্যাক্সের জন্য আগে বাসের যা ভাড়া ছিল, তার উপর অন্তত ৩০০ টাকা চাপানো হয়েছে। কথায় কথায় ‘সমস্যা নাই’ বলতে অভ্যস্ত বাংলাদেশের মানুষের একাংশের কাছে ব্যাপারটা খানিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বইকি।
তিনটি মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার পর চতুর্থ বার ক্ষমতায় ফেরার জন্য আগামী বছর সাধারণ নির্বাচনে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা রয়েছে। তার উপাদান হল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, আওয়ামি লীগের কিছু নেতার বল্গাহীন দুর্নীতি, লোডশেডিংয়ের মতো দৈনন্দিন সমস্যা। ওবায়দুল সাহেব যেমন সরাসরি বলেই দিলেন, ‘‘এ বারের নির্বাচন বেশ টাফ হবে! নেত্রী শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন। রাজনীতিতে হারাতে না-পেরে তাঁকে হত্যার চক্রান্ত করা হচ্ছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের পর আওয়ামি লীগ এখন সবচেয়ে বেশি সংগঠিত। উল্টে বিএনপি নেতাদের ঝগড়ায় বেসামাল।’’
বিরোধী বিএনপি নেতাদের অবশ্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করার অবকাশ কম। প্রথম সারির প্রায় সমস্ত নেতাই জেলে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পরে তারা অভিযোগ করেছিল, ভোট যা হওয়ার আগের রাতেই হয়ে গিয়েছে! ফলে এই সরকার ‘অবৈধ’। অতএব আগামী ভোটে হাসিনাকে ‘গ্রহণযোগ্য’ নির্বাচন করাতেই হবে। বিদেশি ‘দাতা’ দেশগুলিও তেমন জানিয়ে দিয়েছে। মওকা বুঝে বিএনপি-ও জানিয়েছে, হাসিনা সরকারের অধীনে থাকলে সুষ্ঠু ভোট হবে না। ভোট হোক ‘নিরপেক্ষ’ সরকারের অধীনে। যা শুনে ওবায়দুল বলছেন, ‘‘এ বার তো বিরোধী জোট থেকে অনেক দল আওয়ামি লীগের জোটে আসতে চাইছে। আমাদের জয় নিয়ে বিরোধীদেরও সংশয় নেই। বলার জন্য অনেক কথা বলতে হয়!’’
শুনতে শুনতে আবার মাওয়া ঘাট থেকে দেখা পদ্মা সেতুর কথা মনে পড়ে গেল। মনে হল উন্নয়নের অতিকায় অভিজ্ঞানকে আশার সঙ্গে ঘিরে রয়েছে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কিছু কুয়াশা। সেই ধোঁয়াটে নির্মোক সরিয়ে ঝকঝকে রোদ্দুর নিয়ে আসাই শেখ হাসিনার চ্যালেঞ্জ!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy