Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Shah Rukh Khan

রবিবার মনে হয়েছিল, এই আমাদের দেশ, সোমবার ভাবলাম, এই আমাদের দ্বেষ!

গত রবিবার পর্যন্ত চারফুট সামথিং এবং আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো লতা মঙ্গেশকরের পার্থিব অবিনশ্বরতা একবিন্দুও টোল খায়নি।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১১:১৬
Share: Save:

রবিবার সন্ধ্যায় শিবাজি পার্কে যখন নাগাড়ে মন্ত্রোচ্চারণের পটভূমিকায় চিরপ্রণম্য অগ্নির রথে সওয়ার হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে ৯২ বছরের এক নশ্বর শরীর, তখন বেজিংয়ে কূটনৈতিক সফরের ফাঁকে টুইট করছিলেন এক প্রৌঢ় পাক নাগরিক। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান লিখছিলেন, ‘লতা মঙ্গেশকরের জীবনাবসানে এই উপমহাদেশ এমন একজন শিল্পীকে হারাল, যাঁর গান বিশ্বজুড়ে বহু মানুষকে আনন্দ দিয়েছে।’

ঠিক তখনই ঢাকার বাসিন্দা তরুণ শিল্পী সামিউল ইসলাম পুলক তাঁর ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট করছিলেন ‘আয়ে গা আনেওয়ালা’র গুঞ্জরন। কয়েক কলি গানের শেষে এক চিকন গলা বলছিল, ‘চলে যাওয়ার আগে আমি একটা কথাই বলব। আসলে মিনতি করব। আপনারা মনে কোনও বৈরিতা রাখবেন না। ভাই-ভাই হয়ে শান্তিতে থাকবেন। তা হলেই আপনাদের জীবন সুখ-শান্তিতে ভরে উঠবে। আর আমার এটা ভেবে ভাল লাগবে যে, আপনারা সকলে ছোটবোনের এই কথাটা মনে রেখেছেন।’
সেই পোস্টের নীচে বাংলাদেশের বাসিন্দা ইনসা ইনাম হক আকুল হয়ে লিখছেন, ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়াইন্না ইল্লাহে রাজেউন।’ লায়লা আহমেদ লিখছেন, ‘ইউ উইল নেভার ডাই, আওয়ার সরস্বতী লতাজি।’

তার কিছু আগে পনিটেলে বাঁধা চুল এবং সানগ্লাসে ঢাকা সজল চোখে শিবাজি পার্কের সজ্জিত চিতায় শেষশয্যায় শয়ান নবতিপর শরীরের পদপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিল এক দোহারা চেহারা। সাদা ফুলস্লিভ টি-শার্ট আর অফ হোয়াইট ট্রাউজার্স আলগোছে ছুঁয়ে যাচ্ছিল আরবসাগরের তীরে অস্তগামী সূর্যের শেষ রশ্মির আভা। মুখে জীবাণুরোধক কালো মাস্ক। পড়ন্ত বিকেলে দু’হাতের করতল পাশাপাশি রেখে সেই চেহারা ‘দুয়া’ ভিক্ষা করছিল আল্লাহর কাছে। পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর ম্যানেজার। শেষ শ্রদ্ধায় সেই যুবতী জোড়হাত।

ঝপঝপ করে শাটার পড়ার মতো একের পর এক ছবি তৈরি হচ্ছিল। মিলিয়ে যাচ্ছিল। আবার তৈরি হচ্ছিল। আবার মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যাওয়ার আগে একটার সঙ্গে অন্যটাকে জুড়েও দিচ্ছিল। গাঁথা হচ্ছিল এক আশ্চর্য বিনিসুতোর মালা।

মনে হচ্ছিল, এই হল অভিঘাত। যেতে হলে এ ভাবেই যেতে হয়।

লতা মঙ্গেশকর কতবড় গায়ক ছিলেন, সে কথা বলবেন সঙ্গীতবোদ্ধারা। বলবে ভাবীকাল। এ নিয়েও নিরন্তর আলোচনা চলতেই থাকবে যে, ভগ্নি আশা ভোঁসলে দিদির চেয়েও উচ্চমার্গের বা বহুমুখী প্রতিভা ছিলেন কি না। কিন্তু এ নিয়ে বিশেষ তর্ক থাকবে না যে, দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ একটিই কণ্ঠের জাদুবাস্তবে আলোড়িত, আন্দোলিত, অভিভূত এবং আপ্লুত হয়েছে। হতে পারে তার পিছনে রয়েছে তাঁর সুদীর্ঘ সঙ্গীতজীবন। রয়েছে অসামান্য প্রতিভাবান সঙ্গীত পরিচালকদের প্রাণঢালা দান। তাঁর শৈশব এবং খানিকটা কৈশোরের লোকগাথাসম লড়াই। হিন্দি ছবির জগতে সুরসম্রাজ্ঞীর আসন দখল করার পর পুরুষ নেপথ্যগায়কের সঙ্গে সমান পারিশ্রমিক দাবি। বিবসনা নারীর প্রতিকৃতি পুরস্কারের ট্রফি হিসেবে নিতে অস্বীকার করা। কে জানে আরও আরও কতকিছু!

শাহরুখের পাশেই দু’হাত জোড় করে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায় অভিনেতার ম্যানেজার পূজা দাদলানিকে।

শাহরুখের পাশেই দু’হাত জোড় করে শ্রদ্ধা জানাতে দেখা যায় অভিনেতার ম্যানেজার পূজা দাদলানিকে।

কিন্তু সেসব ছাপিয়ে গিয়ে সারা দেশে জেগে ছিল লতা মঙ্গেশকরের প্রভাব। অধুনাপ্রয়াত কংগ্রেস নেতা ভি এন গ্যাডগিল নব্বইয়ের দশকে ২৪ নম্বর আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর দফতরে বসে বলেছিলেন, ‘‘এই দেশের যে দূরতম প্রান্তেই যান না কেন, তিনটি জিনিস পাবেনই। পোস্টকার্ড, কংগ্রেসের তেরঙা পতাকা আর লতা মঙ্গেশকরের গান।’’

কালের নিয়মে প্রথম দু’টি সত্যিকারের প্রান্তিক হতে বসেছে। প্রযুক্তি এসে এক ধাক্কায় পোস্টকার্ডকে জুরাসিক যুগে নিয়ে ফেলেছে। কংগ্রেস যে কোথায়, তা কংগ্রেসিরাই ভাল জানেন। কিন্তু গত রবিবার পর্যন্ত চারফুট সামথিং এবং আঁচলটা আটপৌরে ভাবে গায়ে জড়িয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানো লতা মঙ্গেশকরের পার্থিব অবিনশ্বরতা একবিন্দুও টোল খায়নি।

পাবলিক লাইফ থেকে বহুদিনই এক অনতিক্রম্য দূরত্বে ছিলেন পেডার রোডের প্রভুকুঞ্জের অন্তঃপুরবাসিনী। শেষ প্লেব্যাক করেছেন আল্লারাখা রহমানের সুরে ২০০৬ সালে। ‘রং দে বসন্তী’ ছবিতে— ‘লুকা ছুপি, বহত হুয়ি’। কিন্তু গত ১৬ বছর ধরে সেই শেষ গানের রেশ, তার অনুরণন অনস্বীকার্য হয়ে রয়ে গিয়েছে।

তবে জীবিত লতা মঙ্গেশকরের প্রভাবকে ছাপিয়ে গিয়েছে তাঁর দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার তীব্র, তীব্রতম অভিঘাত।

যে অমোঘ অভিঘাতে নড়ে গিয়েছে আসমুদ্রহিমাচল। আবেগে দুলে উঠেছে গোটা উপমহাদেশ। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ এক সূত্রে বাঁধা পড়েছে। যে অভিঘাতে তাঁর নশ্বর শরীরের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে পাশাপাশি আল্লাহর কাছে ‘দুয়া’ ভিক্ষা করেছেন এক মুসলিম এবং প্রার্থনা করেছেন এক হিন্দু। আর সারা দেশ উথালপাথাল হয়েছে।

লতা-হীন রবিবারের বিকেল সন্ধ্যায়, সন্ধ্যা রাতের দিকে গড়িয়ে যায়। আর মুম্বইয়ের দাদার এলাকায় শিবাজি পার্কে সশ্রদ্ধ শোকগ্রস্ত শাহরুখ খান এবং তাঁর ম্যানেজার পূজা দাদলানির ছবি নেটমাধ্যম বাহিত হয়ে পৌঁছে যায় চরাচরে। উপমহাদেশে বিগ্রহরূপে পূজিত শিল্পীর পদপ্রান্তে তৈরি হয় এক বৈগ্রহিক ছবি। মনে হয়, এই আমাদের দেশ। এই-ই আমার দেশ।

কিন্তু তার মধ্যে তিরতির করে আরও একটা ভাবনা। মনে হয়, সত্যিই! আমার দেশের এখন এই অবস্থা যে, হিন্দু-মুসলিমের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পরপারগামীকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর চিরকালীন এবং শাশ্বত ছবিকে আলাদা করে গুরুত্ব দিতে হয়। দিতেই হয়। উচ্চকিত হয়ে বলতে হয়, এই আমার দেশ। এই-ই আমাদের দেশ।

রাত পোহাতে সব গোলমাল করে দিয়ে তিরতিরে ভাবনাটা ঠিক হয়। চটকা ভেঙে যায়। বিজেপি-র এক উটকো এবং ভুঁইফোড় নেতা বলে বসেন, শাহরুখ মাস্ক নামিয়ে থুতু ছিটিয়েছেন লতা মঙ্গেশকরের চিতায়! হতভম্ব লাগছিল! মনে হচ্ছিল, কী করে সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ ভাবতে পারে কেউ কারও চিতায় থুতু ছেটাচ্ছে! মনে হচ্ছিল, এত ঘৃণা! এত অন্ধ ঘৃণা! এত দ্বেষ! স্রেফ মুসলিম বলে!

লতার শেষকৃত্যে শাহরুখের ‘দুয়া’ এবং ‘আয়াত’।

লতার শেষকৃত্যে শাহরুখের ‘দুয়া’ এবং ‘আয়াত’।

পাশাপাশিই মনে হচ্ছিল, আসলে কত কম জানি আমরা! মুসলিমরা ‘বল হরি, হরি বোল’ জানেন। কিন্তু হিন্দু-মুসলিমের এই দেশে এত বছর বসবাস করেও আমরা জানি না শেষযাত্রায় মুসলিমদের ‘আয়াত’-এর কথা। যা শাহরুখ করেছিলেন লতার শেষযাত্রায়। মুসলিম রীতি অনুযায়ী ‘দুয়া’ বা প্রার্থনার পর যাঁর জন্য প্রার্থনা, তাঁকে লক্ষ্য করে ফুঁ দেওয়া হয়। যাতে সমস্ত অশুভ শক্তি তাঁর থেকে দূরে সরে যায়। রীতিটি প্রতীকী। ভঙ্গিটি আন্তরিক। লতা মঙ্গেশকরের শেষশয্যায় তাঁর জন্য নিজের ধর্মাচরণ করে সেই রেওয়াজই পালন করেছিলেন শাহরুখ। প্রার্থনার পর মাস্কটা সামান্য নামিয়ে ফুঁ দিয়ে ‘আয়াত’ করেছিলেন। মাস্ক নামিয়ে ফুঁ দিয়েছিলেন অশুভ শক্তিকে উড়িয়ে দিতে।

যে ভালবাসার, শ্রদ্ধার, ঘিরে থাকার রীতিকে ‘থুতু ছেটানো’ বলে দেগে দেয় কোনও এক ‘রামভক্ত’। আর ভারত নামক কর্মভূমির এক সন্তানের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসতে হয় ঊর্মিলা মাতণ্ডকর, ভূমি পেডনেকর, রাখি সবন্তদের।

ভাল হত শাহরুখ খানের ‘আয়াত’-এর ফুঁয়ে যদি উড়ে যেত দেশজোড়া ঘৃণার অবগুণ্ঠন। উড়ে যেত সেই স্থবিরতা, যা কাউকে কাউকে দিয়ে এখনও লিখিয়ে নেয়, একদা লতা মঙ্গেশকর প্রশংসা করেছিলেন দামোদর বিনায়ক সাভারকরের। অথবা লিখিয়ে নেয় তিনি কাকে কাকে ‘চেপে’ দিয়েছিলেন। লিখিয়ে নেয়, তিনি সব সময় প্রতিষ্ঠানের মন যুগিয়ে চলেছেন।

শাহরুখ খানের ‘আয়াত’-এর এক ফুঁয়ে যদি উড়িয়ে দেওয়া যেত এই অক্ষমতাজনিত ঘৃণার প্লাবন, এই বালখিল্যসুলভ অসূয়ার স্রোত, এই বিবমিষা উদ্রেককারী রাগ, এই সম্প্রদায়ভিত্তিক দ্বেষ।

গেল না। রবিবার মনে হয়েছিল, এই আমাদের দেশ। সোমবার মনে হল, এই আমাদের দ্বেষ!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy