অসম বিধানসভার শেষ দফায় যে চল্লিশটি কেন্দ্রে ভোট হল, তার বেশ কয়েকটির সঙ্গে অসমের বহুশ্রুত ‘বিদেশি সমস্যা’র প্রত্যক্ষ সংযোগ আছে। আগের দুই দফায় তেমন কেন্দ্র ছিল না, তা নয়। শেষ পর্বে যেমন ছিল গোয়ালপাড়া পূর্ব ও পশ্চিম, কোকড়াঝাড় পূর্ব ও পশ্চিম, গুয়াহাটি পূর্ব ও পশ্চিম, ধুবুরি এবং বঙ্গাইগাঁও বিধানসভা, আগের দু’টি পর্বে যেমন ছিল কাছাড়, তেজপুর, জোরহাট।
কেন বিশেষ করে এই নামগুলির কথা বলা হল? এখানে মনে রাখতে হবে যে, অসমের গোয়ালপাড়া, কোকরাঝাড়, কাছাড়, তেজপুর, জোরহাটের ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে ২০১৬ থেকে ২০১৯-এর মধ্যে, মাত্র তিন বছরে মারা গিয়েছেন আটাশ জন! ‘শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে’ মৃত এই ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন সমরগঞ্জ জেলার বাসিন্দা পঁয়ত্রিশ বছরের দুলাল মিয়া (গোয়ালপাড়া ক্যাম্প), গোয়ালপাড়া জেলার কিশনি থানা এলাকার বাবুপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাঁইত্রিশ বছর বয়সি সুব্রত দে (গোয়ালপাড়া ক্যাম্প), ধুবুরি জেলানিবাসী বছর পঁয়তাল্লিশের নজরুল ইসলাম (কোকড়াঝাড় ক্যাম্প) প্রমুখ। নাগরিকত্ব প্রমাণের উপযুক্ত ‘কাগজ’ নেই বলে প্রশাসনিক স্তরে চূড়ান্ত লাঞ্ছিত হয়ে, কোনও ভাবেই এর থেকে পরিত্রাণ মিলবে না বুঝতে পেরে (পড়ুন, ‘ঘুষের টাকা জোগাড়ে ব্যর্থ হয়ে’) অসমে ২০১৮ থেকে ২০২০, এই সময়কালে আত্মহত্যা করেছেন ঊনপঞ্চাশ জন অসমবাসী। তাঁদের অধিকাংশ বাঙালি। গলায় দড়ি, বিষপান, ঘুমের ওষুধ খাওয়া, কুয়োয় ঝাঁপ, চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহননের পথে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অত্যাচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে চেয়েছেন এঁরা। এর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কোকড়াঝাড়ের শ্রীরামপুর কলোনির বাসিন্দা সুরেন্দ্র বর্মনের বয়স সাতাশ!
ডিটেনশন ক্যাম্পগুলিতে মৃত্যু এবং আত্মহত্যা— সাড়ে তিন বছরে যে সাতাত্তর জন ভারতবাসী নাগরিকত্ব প্রমাণের নৃশংস জাঁতাকলের বলি হলেন, ‘গণতন্ত্রের উৎসব’-এ তাঁদের কথা অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো অন্য নির্বাচনী রাজ্য মনে রাখল কি না, এই মুহূর্তে সেটা খুব বড় প্রশ্ন। এই কথাও মনে রাখা দরকার যে, করোনা-গ্রাসের পূর্বের এই মৃত্যু তালিকা গত চৌদ্দ মাসে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সংখ্যাটা শতাধিক হয়ে গেলেও বিস্ময়ের কারণ নেই। দুর্ভাগ্যের কথা, হাতে গোনা কয়েক জনকে বাদ দিলে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। তাঁরা ভিন্ন রাজ্যের বাঙালির সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে নারাজ। বরং শীত থাকতেই এই বঙ্গে বেজে ওঠা ভোটের দামামা শুনে তাঁরা জল মেপেছেন— কোন রঙে নিজেকে রাঙালে নানাবিধ সরকারি বদান্যতায় ঝুলি উপচে উঠবে। এই কারণে অসমবাসী বাঙালির মনে আমাদের প্রতি ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক।
উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজ অবশ্য চুপ করে বসে নেই। কিন্তু, তাঁদের প্রতিবাদ সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের দরজায় কড়া নাড়লেও মনে রেখাপাত করে কি? ব্রহ্মপুত্রের দেশের এই ‘মৃত্যু উপত্যকা’র কথা সেখানকার সাহিত্যসেবীদের কলমে জোরালো ভাবে উঠে আসছে। কথাসাহিত্যে স্বপ্না ভট্টাচার্য, মিথিলেশ ভট্টাচার্য, কান্তারভূষণ নন্দী, মেঘমালা দে মহন্তের পাশাপাশি কবিতায় বিজয়কুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন এমন অগ্নিশব্দ: “সব নথি দিয়েও দুলাল স্বদেশে বিদেশি/ তার মতো ফালু দাস এবং অনেকে/ ক্যাম্পের যন্ত্রণা কত, জানে কম-বেশি/ সাপের মতো সময় যায় এঁকেবেঁকে!”
অসমবাসী বাঙালির চলমান বিপন্নতার ইতিহাস বুঝতে গেলে বীরেশ্বর দাসের এন আর সি: প্রক্রিয়া ও প্রভাব, তপোধীর ভট্টাচার্যের আসামে বাঙালি মৃগয়া অবশ্যপাঠ্য।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে হর্ষ মান্দার ২০১৮-র জানুয়ারি মাসে ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি পরিদর্শন করেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন মহসিন আলম ভাট ও আব্দুল কালাম আজাদ। গোয়ালপাড়া ও কোকরাঝাড়ের বন্দিশালা দেখে হর্ষ মান্দারের মন্তব্য: “আমরা প্রত্যক্ষ করেছি বন্দিশালাগুলির অন্ধকারাচ্ছন্ন নারকীয় দিক। না আছে কোনও বৈধতা, না আছে কোনও মানবতার স্পর্শ।” তিনি এর প্রতিকার চেয়ে রাষ্ট্রের কাছে উপেক্ষা ছাড়া আর কিছু পাননি। ফলে কমিশনের ওই বিশেষ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে পৌঁছে গিয়েছিলেন এই সমস্যার সমাধান চেয়ে।
বস্তুত আজ পর্যন্ত অসমের বাঙালি সমাজের হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে একটা বড় অংশ ‘ডাউটফুল ভোটার’-এর বিষ-ছোবলে ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারছেন না, ড্রাইভিং লাইসেন্স পাচ্ছেন না, হারিয়েছেন জমি কেনা ও বিক্রির অধিকার, চাকরির অধিকার। এক-দুই জন নয়, লক্ষ লক্ষ অসমবাসী বাঙালি আজ চূড়ান্ত সঙ্কটে দিন কাটাচ্ছেন, ইতিমধ্যে একটা প্রজন্ম স্বাভাবিক জীবনযাপনের লড়াইয়ে পিছিয়ে পড়েছেন। বেকারত্বের এই দেশে সেই তরুণ-তরুণীরা চাকরির ফর্ম জমা দেওয়ার লাইনে নয়, দিনের পর দিন ধরে বাধ্য হচ্ছেন নিজের দেশে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের নথি খুঁজে বার করার চেষ্টায় সময় নষ্ট করতে।
ঈশান কোণের বাঙালির দুর্দশার রোজনামচা এই দেশের মূল ভূখণ্ডের বাঙালির কাছে ব্রাত্য। তারা এখন দলবদলের সার্কাস আর ‘সোনার বাংলা’র কে কতটা ঘরের আর কে বহিরাগত, তাই নিয়ে বিভোর হয়ে থাকল। ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক শক্তি অসমের বাঙালি সত্তার ঘাড় মটকে এ বার যে বঙ্গদেশের বাঙালির ঘাড় মটকাতে তৎপর, এ-পথেই যে তার প্রায় শতবর্ষের গূঢ় অভিপ্রায় ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-র বাস্তবায়ন সম্ভব, তা কি আমরা আদৌ বুঝতে পারছি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy