দশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল, যোজনা কমিশনের অস্তিত্ব নেই। থাকলে, গত শনিবার, ১৫ মার্চ তার প্রতিষ্ঠার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হত। কমিশন বিদায় হওয়ায় ভাল হয়েছে না মন্দ, সে তর্ক আর কখনও হবে— এই পৌনে শতকের দূরত্বে দাঁড়িয়ে বরং এক বার দেখা যাক, যখন প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যোজনা কমিশন, তখনকার ভারত-ভাবনায় তার স্থান কোথায় ছিল।
শুরুরও শুরু থাকে। ভারতে উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যোজনা কমিশনের সূচনাবিন্দু হিসাবে দেখা হয় ১৯৩৮ সালের ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটিকে। কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্যোগে তৈরি হয় এই কমিটি, চেয়ারম্যান হন জওহরলাল নেহরু। দেশ স্বাধীন হলে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের চেহারা কী রকম হবে, তা নির্ধারণের জাতীয়তাবাদী উদ্যোগ ছিল এই কমিটি। কিন্তু, এটাই কি সূচনা? এর অন্তত আট বছর আগে থেকেই ভারতে ডেভলপমেন্ট প্ল্যানিংয়ের ভাবনা চলছিল। জর্জ শুস্টারের রিপোর্ট, ‘ফিকি’-র বার্ষিক সভায় ঘনশ্যামদাস বিড়লার বক্তৃতা অথবা এম বিশ্বেশ্বরায়ার প্ল্যান, সবই ঘটে গিয়েছিল ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটি তৈরি হওয়ার আগেই। তখন গোটা দুনিয়া বিস্মিত সোভিয়েটের পরিকল্পনা-সাফল্যে— সেই প্রদীপের নীচের অন্ধকার তখনও চোখে পড়েনি বিশ্বের; শুধু দেখা গিয়েছিল, একটা কৃষিপ্রধান অর্থব্যবস্থা ঝড়ের গতি শিল্পায়িত হয়ে উঠছে, জাতীয় আয় বাড়ছে, জীবনযাত্রার মানও বাড়ছে। কিন্তু, অর্থনীতিবিদ রাঘবেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, সোভিয়েটের জন্মেরও অন্তত দেড় দশক আগে, ১৯০৩ সালে গোপালকৃষ্ণ গোখলের লেখাতেও আভাস ছিল উন্নয়ন পরিকল্পনার গুরুত্বের, ভারতের জন্য তার প্রয়োজনীয়তার।
ন্যাশনাল প্ল্যানিং কমিটির আগে এবং পরে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার যত প্রস্তাব পেশ হয়েছে ভারতে, সবের মূল কথা ছিল একটাই— দ্রুত শিল্পায়ন প্রয়োজন। দারিদ্র থেকে ভারতকে উদ্ধার করার এই একটিমাত্র পথ। শিল্পায়ন হলে কৃষি থেকে শিল্পে চলে আসবেন মানুষ, তাঁদের দ্রুত আয়বৃদ্ধি ঘটবে, এবং সেই পথেই দেশের সমৃদ্ধির ভাগীদার হবেন তাঁরা। ভারতের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের মূলত বামপন্থী অংশ— যাঁর পুরোভাগে ছিলেন স্বয়ং নেহরু— বিশ্বাসী ছিলেন এই মতবাদে। কিন্তু, স্বাধীনতার মুহূর্ত যত এগিয়ে আসতে আরম্ভ করল, ততই বোঝা গেল যে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার শুধু মানুষের আয়বৃদ্ধির দায়িত্ব পালন করলেই চলবে না, তাকে বহন করতে হবে আরও অনেক বোঝা। একটা নতুন জাতীয়তাবাদ তৈরির বোঝা— ‘ভারতীয়’ পরিচয় রচনা করার বোঝা।
জাতীয়তাবাদের প্রশ্নটা চিরকালই গোলমেলে। কোন পরিচয়ের সূত্রে একটা জাতি তৈরি হবে, ইউরোপের তুলনায় ভারতে সে প্রশ্নের উত্তর জটিলতর— ধর্ম হোক বা ভাষা, অথবা জাতি, পরিচিতির বিভিন্নতায় ভারতের তুলনা মেলা ভার। ১৯৪০-এর দশকের গোড়ায় সংশয়াতীত ভাবে স্পষ্ট হয়ে গেল, ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে শেষ অবধি ঠেকানো যাবে না। হলও তা-ই— ধর্মের ভিত্তিতেই ভাগ হল দেশ। কিন্তু, অন্য পরিচিতিগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জাতীয়তাবাদও যে নতুন নতুন বিভাজিকা তৈরি করতে পারে, সে সম্ভাবনাও স্পষ্ট হয়ে উঠল এই সময়েই। এই অবস্থায় দুটো সম্ভাব্য পথ ছিল— এক, ভারত বেছে নিতে পারত সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের জাতীয়তাবাদ, অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষার জাতীয়তাবাদকে, বাছতে পারত মনুবাদী সমাজকাঠামোর পরিচিতিকে;অথবা দুই, ভারত খুঁজতে পারত এক নতুন পরিচিতি— যাবতীয় খণ্ড জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে, ‘ভারতীয়’ পরিচিতি।
ভারত বেছে নিল দ্বিতীয় পথটিকেই। ভেবে দেখলে, সে এক আশ্চর্য অভিযান— এত দিন ধরে যে সব পরিচয়ে নিজেকে চিনেছে মানুষ, সেগুলোকে অতিক্রম করে সম্পূর্ণ নতুন এক পরিচয়ে চিনতে শেখা নিজেদের। সেই নতুন পরিচয়টা ‘স্বাভাবিক’ নয়— তা জন্মসূত্রে পাওয়া নয়— সেই পরিচয় ‘কৃত্রিম’, তৈরি করা, ভারতীয় পরিচয়। বিবিধ পরিচয়ে বিভক্ত, এবং সেই পরিচয়ের কারণেই বিভিন্ন ভাবে রক্তাক্ত, এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিজেদের নতুন পরিচয়ে চিনতে শেখানো। বিভিন্নতাকে এক মালায় গাঁথতে এখানে একটাই সুতো, তার নাম উন্নয়ন। ভারত নামক দেশটা তৈরি হবে নতুন করে— সে দেশে হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-তামিল-মরাঠি, অথবা দলিত-উচ্চবর্ণের পরিচয়কে ছাপিয়ে যাবে একটাই পরিচয়, সবাই ভারতবাসী। এমনই এক প্রায়-ইউটোপীয় ভাবনার বোঝা চাপল উন্নয়ন পরিকল্পনার ঘাড়ে।
পরবতী সাড়ে সাত দশক বুঝিয়েছে, সে স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল না। অতীতের যাবতীয় রক্তদাগ মুছে দিতে পারবে, উন্নয়ন পরিকল্পনার সাধ্য ছিল না ততখানিও। কিন্তু, সেই ব্যর্থতা তো সূচনার মুহূর্তটাকে মিথ্যা করে দিতে পারে না। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রকাশিত হওয়ার আগে-পরের সময়টুকুতে বিভিন্ন জনসভায় নেহরুর ভাষণগুলো পড়লে স্পষ্ট হবে, প্রায় ক্লাস নেওয়ার ভঙ্গিতে তিনি সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে চলেছিলেন যোজনার মাহাত্ম্য। অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হলেই যে সাম্প্রদায়িকতা বা জাতপাতের মতো সমস্যার সমাধান হবে আপনা থেকেই, এ বিশ্বাস তাঁর দীর্ঘ দিনের। যোজনার মুহূর্তটি যেন ছিল সেই বিশ্বাসকে হাতেকলমে পরখ করে নেওয়ার ক্ষণ। অবশ্য, শুধু জনসভায় নয়, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই প্রদেশগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি লেখার যে প্রথা নেহরু চালু করেছিলেন, একের পর এক সেই চিঠিতেও তিনি লিখে গিয়েছেন, কী ভাবে আর্থিক উন্নয়নের সূত্র ধরেই তৈরি হতে পারে নতুনজাতি-পরিচয়।
উন্নয়নের সুফল সবার ঘরে পৌঁছবে, শুধু সেটুকুতেই যে তৈরি হবে না জাতি-পরিচয়, সে কথা জানা ছিল। দীর্ঘ দিনের অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের রাজনীতির থেকে এই জায়গাটাতে সরে এল নেহরুর যোজনা-ভাবনা। একের পর এক জনসভায় দাঁড়িয়ে নেহরু মানুষকে মনে করিয়ে দিলেন, তাঁদের সক্রিয় অংশীদারি ছাড়া দেশ তৈরি করা সম্ভবই নয়। যে সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনা, তাতে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের অবকাশ ছিল না, সে কথা অনস্বীকার্য। এমনকি, গণতান্ত্রিক মতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সিংহভাগেরও নাগালের বাইরে ছিল সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মঞ্চ— ‘রাজনীতির কোলাহলের বাইরে’ যোজনা কমিশনের দফতর ছিল টেকনোক্র্যাটদের চারণভূমি। কিন্তু, সেই পরিকল্পনামাফিক দেশ তৈরির কাজে সাধারণ মানুষকে যোগ দিতে হবে, বারে বারে মনে করিয়ে দিতেন নেহরু। সে কাজ যদি নিতান্ত রাস্তা তৈরির, অথবা কারখানার দেওয়াল গাঁথার হয়, তাও তার গুরুত্ব অনেক। তবে, সে যোগদানের সিদ্ধান্তটি রাষ্ট্র চাপিয়ে দেবে না নাগরিকের উপরে, জুলুম করবে না— মানুষ স্বেচ্ছায়, দেশ গঠনে যোজনার এবং নিজেদের গুরুত্ব বুঝে যোগ দেবেন সেই মহাযজ্ঞে। যোজনার জন্য টাকা তুলতে চালু হল বন্ড— নেহরু বললেন, সুদের লোভ দেখিয়ে নয়, এর দিকে মানুষকে টানতে হলে মনে করিয়ে দিতে হবে দেশনির্মাণে তাঁদের ভূমিকার গুরুত্বের কথা। সিনেমার আগে প্রদর্শিত হল যোজনা বিষয়ক তথ্যচিত্র, সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল বিজ্ঞাপন, আয়োজিত হল বিপুল মেলা। যোজনা বিষয়ে সচেতনতা তৈরির এই বিপুল উদ্যোগ আসলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নির্মাণের প্রক্রিয়াও বটে।
এক দিকে তৈরি হবে আধুনিক দেশ, আর অন্য দিকে সেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার পরিচয়েই তৈরি হবে দেশবাসীর জাতিপরিচয়— এই দ্বিমুখী দায়িত্বের কোনটি পালনে ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনা কতখানি সফল, সে হিসাব বিস্তর কষা হয়েছে। দেশের সব আর্থিক সম্পদের হিসাব কষে, তার ব্যবহারের সবচেয়ে কুশলী পথ খুঁজে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সে পথে চলার ভাবনার মধ্যে কোথায় কী গলদ ছিল, সে বিশ্লেষণও হয়েছে বিস্তর। যাবতীয় খামতি সত্ত্বেও যদি ভারতের উন্নয়ন পরিকল্পনার নৈর্ব্যক্তিক বিচার করেন কেউ, তাঁকে স্বীকার করতেই হবে, দুনিয়ার আর কোনও দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনাকে জাতিনির্মাণের এই বিপুল বোঝা বইতে হয়নি।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই বিজেপি যখন যোজনা কমিশন তুলে দিল, তার মধ্যে কি কোথাও এই বার্তাটিও ছিল না যে, বিভিন্নতাকে এক ইতিবাচক সূত্রে বাঁধার মতো জাতিপরিচয়ের আর দরকার নেই আদৌ? নরেন্দ্র মোদী নেহরু-যুগের অবসান চেয়েছিলেন। উন্নয়নভিত্তিক ভারতীয় পরিচিতির সম্ভাবনাটিরও বিসর্জন কি সেই অবসানের মধ্যেই নিহিত ছিল না?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)