Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
এই সামাজিক প্রতিবাদ কি নতুন প্রবণতার প্রকাশ
R G Kar Hospital Incident

‘বার্তা’ বোঝার সময়

রাজ্যে, হয়তো দেশেও, স্মরণকালের মধ্যে যে ক’টি সাড়া জাগানো প্রতিবাদ-আন্দোলন হয়েছে, তার পিছনে ছিল সরাসরি রাজনীতি। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর সবই ওই গোত্রে ফেলা যায়।

বিচলিত: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল। ২৩ অগস্ট, কলকাতা।

বিচলিত: আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল। ২৩ অগস্ট, কলকাতা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২৪ ০৫:৪৮
Share: Save:

শেষ কোথায় এবং কী ভাবে, তা জানা নেই। তবে একটি বিষয় বোধ হচ্ছে, প্রচেষ্টা জারি থাকলেও আর জি কর-আন্দোলনের লাগাম কোনও রাজনৈতিক দলই এখনও সে ভাবে কব্জা করতে পারেনি। তাই এই প্রতিবাদের সামাজিক অভিঘাত এত প্রবল হতে পেরেছে। নাগরিক আন্দোলন ছড়াতে থাকলে যে কোনও শাসকের পক্ষে তা উদ্বেগের। আর ঘোলা জলে মাছ ধরার ‘রাজনীতি’ বেলাগাম উচ্ছৃঙ্খলতায় পর্যবসিত হলে তা আত্মঘাতী ও জনবিরোধী হতে বাধ্য।

রাজ্যে, হয়তো দেশেও, স্মরণকালের মধ্যে যে ক’টি সাড়া জাগানো প্রতিবাদ-আন্দোলন হয়েছে, তার পিছনে ছিল সরাসরি রাজনীতি। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর সবই ওই গোত্রে ফেলা যায়। শাসক ও বিরোধীদের মধ্যে বিভাজন-রেখাটি স্পষ্ট হয়। তার ভিত্তিতে কিছুটা আঁচ করা যায় যে, পরিণতি কোন দিকে যেতে পারে। আর জি করের আন্দোলন সেই তত্ত্ব, ধারণা সব কিছু গুলিয়ে দিয়ে শুধু একটি সর্বব্যাপী সামাজিক আন্দোলন হয়ে উঠতে পেরেছে। কার্যত যার আকার বিশ্বজোড়া। যেখানে ভেঙে যাচ্ছে দলীয় ব্যারিকেড। খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে নেতা-নেত্রীদের ইচ্ছা বা চাহিদামতো চলার ফরমান।

বস্তুত আর জি কর-কাণ্ড এমন একটি সাধারণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, যেখানে আন্দোলনের সঙ্গে না-থাকা যেন সমাজের স্রোত থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়া। ধারাবাহিক ভাবে চলা প্রতিবাদ-মিছিলগুলির চেহারা ও ব্যাপ্তিতে সেটা ধরা পড়েছে। এটা অভূতপূর্ব বলেই পরিণতি সম্পর্কে সহসা কিছু বলা কঠিন। তবে, যে পরিচালন-ব্যবস্থার মধ্যে সবাই বাস করেন, তার বিভিন্ন গলদ বেরিয়ে আসছে আর জি করের ঘটনাকে সামনে রেখেই— এই কথাটিও মনে রাখতে হবে।

আর সেখানেই সামাজিক প্রতিবাদের হাত ধরে রাজ্যে একটি নতুন প্রবণতার উন্মেষ দেখা যাচ্ছে। যেটা বিশেষ লক্ষণীয়। বিষয়টিকে তাই শুধুই একটি হাসপাতাল অথবা স্বাস্থ্যের কাঠামোর মধ্যে সীমিত করে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা হিসাবে না দেখাই ভাল। বরং ভাবা হোক, এই প্রতিবাদের ধরন এক বৃহত্তর সঙ্কেত। তার ‘অন্তর্নিহিত বার্তা’ বোঝার সময় এসেছে।

সমসময়ে দেশের আরও কয়েকটি রাজ্যে নারী-নিগ্রহ, ধর্ষণ, তার ফলে মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনা ঘটেই চলেছে। মহারাষ্ট্রের বদলাপুরে স্কুলের ভিতরে দুই নাবালিকা ছাত্রীর শারীরিক হেনস্থা, উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণে মৃত এক নার্সের দেহ ন’-দশ দিন পরে প্রতিবেশী রাজ্য থেকে খুঁজে পাওয়া ইত্যাদি আমাদের বিশেষ ভাবে শিহরিত করে। সপ্তাহখানেক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশে প্রতি দিন গড়ে নব্বইটি ধর্ষণ হচ্ছে বলে দাবি করেছেন। পরিসংখ্যানটি কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যার মতোই সর্বজনীন আতঙ্কের। কারণ নির্যাতিতারা যেখানকারই হোন, তাঁরা কারও মেয়ে, কারও স্ত্রী, কারও বোন বা মা। প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সে সব জায়গাতেও হয়েছে।

কিন্তু কোনওটিই আর জি করের পর্যায়ে যায়নি। তা হলে আর জি কর এতটা ব্যতিক্রমী হয়ে উঠল কেন? কারণ রাতের ডিউটিতে থাকা তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়াকে ধর্ষণ ও খুনের নির্মমতার পাশাপাশি বেরিয়ে এসেছে রাজ্যের সামগ্রিক পরিচালন-ব্যবস্থার অনেক ছিদ্র। সেখানে গোষ্ঠীবাজি ও ‘ব্যক্তিতন্ত্রে’ ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য-প্রশাসন আছে। জনগণকে নিরাপত্তা দিতে দায়বদ্ধ পুলিশের ভূমিকা ও দক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন আছে। রয়েছে কর্ণধারদের বিবেচনাবোধের অভাব থেকে শুরু করে শাসক-দুষ্টচক্র যোগাযোগের অভিযোগ পর্যন্ত। এগুলিই কোথাও একক, কোথাও বা সম্মিলিত ভাবে নাগরিক প্রতিবাদের উপাদান হিসাবে কাজ করছে।

আসলে এ সব ক্ষেত্রে এটাই হয়। একের সঙ্গে জড়িয়ে যায় অনেক সামাজিক সঙ্কটের সূত্র। এমনিতে তারা একটির সঙ্গে আর একটি বেঁধে বেঁধে থাকে। সব সময় সব বোঝা যায় না। কিন্তু এক বার কোনও ভাবে পাক খুলে গেলেই সুতো লম্বা হয়! তখন একটির অনুষঙ্গে আরও কিছু মিলে-মিশে প্রতিবাদ নিজস্ব মাত্রা পায়। মূল বিষয়টি হয়ে
যায় প্রতীকী।

আর জি করের ঘটনা নিয়ে ফের বিশদ অবতারণা নিষ্প্রয়োজন। এই মুহূর্তে সকলের চাহিদা হল অপরাধের দ্রুত কিনারা, বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিবিধান। এতে কোনও দ্বিমত নেই। তীব্র চিৎকারে অবশ্যই এই দাবি জানাতে হবে।

পাশাপাশি ‘কান্ডারি’দেরও বোঝা উচিত, চাপা থাকা বিভিন্ন ‘ক্ষত’ সম্পূর্ণ নিরাময় না হলে শরীরে সংক্রমণ ছড়ানোর শঙ্কা থেকে যায়। নাগরিক প্রতিবাদের তো ছক হয় না। আজ এটা সামনে, কাল হয়তো সেটা! তাই পুরসভার রাস্তা মেরামতির মতো শুধু একটু জায়গায় এক পর্দা প্রলেপে ‘প্রকৃত’ সমাধান শক্ত।

স্বাস্থ্যের কথাই ধরা যাক। আর জি করের তদন্ত ও শাস্তি অগ্রাধিকার। কিন্তু রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে, চিকিৎসক-মহলে যা নিয়ে এত আলোচনা, কানাকানি চলে, নবান্ন থেকে স্বাস্থ্য ভবন কোথাও কি এত দিনেও তা পৌঁছয়নি? কর্তারা কি জানেন না যে, রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রশাসনের নেপথ্যে থাকা এক ‘অ-সরকারি’ চিকিৎসকের হস্তক্ষেপ ও দাপট কী পর্যায়ে গিয়েছে? ‘না-জানলে’ সেটা সরকারের ব্যর্থতা। আর চোখ বুজে থাকলে অপরাধ।

স্বাস্থ্যে ‘নর্থ বেঙ্গল লবি’ নামক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অলিখিত ‘চালক’ বলে চিহ্নিত ওই ব্যক্তির কাছে ‘দাসখত’ দেওয়ার কথা সর্বজনবিদিত এবং বার বার এ সব নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ কথাও ক্রমশ বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে যে, বড় বড় পদে সরকারি ডাক্তারদের নিয়োগ ও বদলিতে ওই ব্যক্তির পরামর্শ অথবা সুপারিশ নাকি ‘ব্রহ্মাস্ত্র’! কোন আশকারায় এটা হতে পারে?

আর জি করের অধুনা ‘অপসারিত’ অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এখন আতশকাচের তলায়। তাঁর সঙ্গেও ওই প্রভাবশালীর ‘ঘনিষ্ঠতা’র অভিযোগ নতুন নয়। আজ ফাঁদে পড়ে দ্রুত সন্দীপের বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির পুরনো অভিযোগ সামনে এনেছে সরকার নিজেই। এত দিন তা হলে ধামাচাপা ছিল কেন? কেনই বা হাসপাতালে এত বড় ঘটনার পরেও সন্দীপ সরকারি প্রশ্রয় পেয়েছিলেন? বহু দিন শোনা যাচ্ছে, ‘দাসত্ব’-এর জাল স্বাস্থ্য-ভবন পর্যন্ত ছড়ানো। যা চাউর হচ্ছে, তার সবই ‘মিথ্যা’ বলে উড়িয়ে দিলে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন স্বাভাবিক।

এটা কোনও ব্যক্তি বা দলের বিষয় নয়। এ হল প্রশাসনিক পদ্ধতির অঙ্গ। জনস্বার্থের সঙ্গেও যুক্ত। কারণ এতে হাসপাতালের পরিচালন ব্যবস্থা থেকে প্রশাসক ও চিকিৎসকদের দক্ষতার মান সব কিছুর যোগ রয়েছে। বাইরে থেকে ‘প্রভাব’ খাটানোর স্পর্ধায় হাসপাতাল, স্বাস্থ্য ভবন সর্বত্র মুড়ি-মিছরি একাকার করে কিছু অদক্ষ ধান্দাবাজের হাতে লাগাম তুলে দেওয়ার বিষফল আজকের আর জি কর। শিকড় অবিলম্বে না ওপড়ালে বিপদ রোখা কঠিন।

এ বার পুলিশ। আর জি করের ঘটনা নিয়ে তাদের এক-একটি পদক্ষেপ ক্ষোভের মাত্রা কী ভাবে বাড়িয়েছে, সবাই জানেন। জানতে ইচ্ছে করে, ১৪ অগস্ট রাতে হাসপাতালে বহিরাগতদের অবাধ তাণ্ডবের পরে পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যেও কি নাগরিকদের মনোবল তিলমাত্র বাড়ল? স্বয়ং নগরপাল অসহায়ের মতো কবুল করছেন, সাত হাজার (তাঁর হিসাবে) লোক ধেয়ে আসার খবর পুলিশ ‘জানত না’! ঘটনার ব্যাপকতা আঁচ করা যায়নি! বাহিনী মোতায়েনেও ঘাটতি ছিল!

শুভবুদ্ধির কাছে প্রশ্ন, আমরা তবে কাদের ভরসায় আছি? মাঝি নৌকা ডোবালে বাঁচাবে কে? সরকার এটা ভাববে না? মেয়েদের রাতের ডিউটি যথাসম্ভব কম দিতে হবে, এটা কি কোনও সমাধান? থালা চুরি আটকাতে মাটিতে ভাত খাওয়া! এই কি বিবেচনাবোধ?

আগেই বলেছি, এ সব সামগ্রিক ‘অসুস্থতা’র এক-একটি লক্ষণমাত্র। ‘শরীর’ সারাতে ওষুধ, না অপারেশন? ভাবার চেষ্টা করা ভাল! ভাবার দায় সরকারের।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy