Sourced by the ABP
খেলোয়াড়দের মতামত কেউ গ্রাহ্যই করেন না, তাঁদের ভালমন্দ নিয়ে খেলার পরিচালকবর্গ উদাসীন; কর্পোরেট লাভ-ক্ষতি ও প্রভাবের কাছে নতিস্বীকার করে খেলার শীর্ষে থাকা কর্তারা প্রতি বছর আমদানি করছেন নিত্যনতুন প্রতিযোগিতা; খেললেও মাঠে খেলোয়াড়রা শারীরিক ভাবে একশো শতাংশ দিতে পারবেন কি না, উলুখাগড়ার মতো গজিয়ে ওঠা প্রতিযোগিতায় ফুটবলাররা আদৌ খেলতে ইচ্ছুক কি না, সে সব আলোচনার বালাই নেই; যে কুশীলবদের নিয়ে এই মহাযজ্ঞ, তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ব্রাত্য— ফুটবলের ময়দানে ক্ষোভের এমন বিস্ফোরণ ঘটছে। স্পেনের ইউরো কাপ-জয়ী দলের ফুটবলার রদ্রি জানিয়েছেন, প্রয়োজনে তাঁরা ধর্মঘটের পথেও হাঁটতে পারেন।
বছরভর বিশ্বের প্রথম সারির লিগ-কাপ-টুর্নামেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ফুটবলাররা খেলেন দেশের হয়েও। দল প্রতিযোগিতাগুলোর শেষ পর্যায়ে পৌঁছলে এক জন ফুটবলার বছরে ৭০-এর বেশি ম্যাচ খেলেন। রদ্রির মতে, সংখ্যাটা ৫০-এর বেশি হওয়া উচিত নয়, বড় জোর ৬০। সংখ্যাটা নিয়ে ক্রীড়াবিজ্ঞানীরাও মোটামুটি একমত। অথচ উপচে পড়া ক্রীড়াসূচিতে নতুন সংযোজন আগামী বছর শুরু হতে চলা ৩২ দলের ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপ। বছরে নিরবচ্ছিন্ন ছুটি পান ফুটবলাররা যে একটা মাস, যে সময়ে পরিবার-পরিজনদের নিয়ে সময় কাটানোর কথা, সে সময়েই ঠুসে দেওয়া হয়েছে নতুন প্রতিযোগিতা। এটি চালু হলে এক জন ফুটবলারকে বছরে খেলতে হবে ৮০টির বেশি ম্যাচ। তাঁর শারীরিক-মানসিক সহ্যক্ষমতা পড়বে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে— শারীরিক-মানসিক ধকলের সঙ্গে লেজুড় হবে নতুন করে চোট-আঘাতের সম্ভাবনাও। কমতে শুরু করবে তাঁদের খেলোয়াড়ি জীবনের আয়ু। মানবদেহের উপরে সহ্যক্ষমতার অতিরিক্ত শ্রম যদি ক্রমাগত চাপিয়ে চলা হয়, অত্যাধুনিক ক্রীড়া-চিকিৎসাবিজ্ঞানও কি কোনও কাজে আসবে?
ফুটবল হোক কি ক্রিকেট, ছবিটা দেশে-দেশে জনপ্রিয় খেলাগুলোর ক্ষেত্রে একই রকম। গোটা বছর ক্রিকেটের বিভিন্ন টুর্নামেন্টের সঙ্গে থাকে বিদেশ সফর। ঠাসা ক্রীড়াসূচির যে চাপ এখন ভারতীয় ক্রিকেটারদের নিতে হয়, তা কয়েক দশক আগেও কল্পনাতীত ছিল। যে সমাজে পান থেকে চুন খসলেই আক্রমণের ঝড় বয়ে যায়, সেখানে আলোকবৃত্তে থাকার কারণেই হয়তো নিজেদের উদ্বেগের কথা তারকা ক্রিকেটাররা মুখ ফুটে বলেন না। তাঁদের নীরবতার সুযোগে কর্তাব্যক্তিরা বিজ্ঞাপনদাতা, সম্প্রচারকারী সংস্থাদের কোর্টে দায় ঠেলে দেন, চাহিদা আর জোগানের চিরাচরিত গল্প শুনিয়ে। টেলিভিশন, ওটিটি-র বাড়বাড়ন্তে খেলাধুলার নীতি-নির্ণায়ক ক্ষেত্রেও কর্পোরেট সংস্থাগুলোর প্রভাব বাড়ছে। তাঁদের যুক্তি এই যে, দর্শক দেখতে চান বলেই নাকি প্রতি বছর ক্রিকেট-ফুটবলের ক্রমবর্ধমান ক্রীড়াসূচি। কিন্তু জনমতের এত কদর ক্রীড়াকর্তা ও কর্পোরেটরা আদৌ করেন? না কি, তা অজুহাতমাত্র— আসল লক্ষ্য নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি? উত্তরটা সম্ভবত জানা।
কেউ বলতেই পারেন যে, খেলোয়াড়রা কোটি-কোটি টাকা উপার্জন করেন, সুতরাং তাঁদের অনুযোগ কি যুক্তিযুক্ত? সাধারণ মানুষকেও তো নিত্য অনিচ্ছা সঙ্গী করেও আপিস যেতে হয়, মুখ বুজে ওভারটাইম করতে হয়। কিন্তু তার পরিণাম কী হতে পারে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে মহারাষ্ট্রের ২৬ বছরের অ্যানা সেবাস্টিয়ানের করুণ পরিণতি। সব পেশায় শ্রমের মাপকাঠি সমান না হলেও, আর পাঁচটা পেশার থেকে খেলার রূপ অবশ্যই ভিন্ন। ক্রিকেট-ফুটবলের মাঠ হোক কি বক্সিং-কুস্তির রিং, সেগুলোর সঙ্গে যুক্ত খেলোয়াড়দের রোজকার কর্মকাণ্ড দর্শক ও বৃহত্তর দুনিয়ার কাছে বিনোদনমাত্র। কিন্তু, খেলোয়াড়দের কাছে সেটা জীবিকার প্রশ্ন। অবশ্যই তার সঙ্গে যুক্ত থাকে সেই খেলার প্রতি তাঁদের নিখাদ ভালবাসা। সত্যিই তাঁরা কোটি-কোটি টাকা উপার্জন করেন, সেই সুবাদে তাঁরা যে কোনও সমাজের অর্থনৈতিক অনুক্রমের উপরের দিকে বিচরণ করেন। কিন্তু যে সাম্মানিক তাঁরা পান, সেটা শুধু তাঁদের প্রতিভা ও অধ্যবসায়ের ফসল নয়, তার সঙ্গে এত মানুষকে বিনোদন জোগানোর গুরুভারের লভ্যাংশও বটে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, অন্যের মনোরঞ্জনের জন্য, কর্পোরেটদের লাভের অঙ্ক বাড়ানোর জন্য খেলোয়াড়রা পর্যাপ্ত বিশ্রাম না নিয়ে, নিজেদের শরীরের ভাল-মন্দ বিসর্জন দিয়ে, মানসিক অবসাদকে সঙ্গী করে বছরভর বিনোদন জুগিয়ে যাবেন। লভ্যাংশের টোপ দিয়ে কাউকে অমানুষিক পরিশ্রম করানোর যুক্তি অমানবিক, সামাজিক অধোগতিরও লক্ষণ।
ক্রীড়াসূচি বাড়লে একটা সময়ের পরে খেলোয়াড়দের খেলার মান যে কমবে, তা অবধারিত। প্রতিনিয়ত সেরা থাকার চাপে তাঁদের অনেকেই অবসাদের অতলে তলিয়ে যাবেন— মারাদোনা থেকে মাইকেল ফেল্পস, সবাই সেই অন্ধকারের ভুক্তভোগী। মাঠে পারফরম্যান্স বজায় রাখতে গিয়ে ড্রাগের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনাও কি উড়িয়ে দেওয়া যায়? অবশ্য ঘনায়মান এই মেঘ দেখেও ক্রীড়াকর্তা ও কর্পোরেটদের থোড়াই কেয়ার। এ যেন সময়ের চাকা ঘুরিয়ে প্রাচীন রোমে ফেরত যাওয়া, কলোসিয়ামে দর্শকদের পৈশাচিক আনন্দের দোহাই দিয়ে যেখানে সাত খুন মাফ। তবে ইতিহাসের চাকা তো ঘোরেই; তাই ক্ষুব্ধকণ্ঠের স্বর যখন একে একে জোরালো হচ্ছে, আশা করা যায় খেলার মাঠেও বিপ্লব আসন্ন। শুধু স্পার্টাকাস হয়ে কে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করবেন ‘খেলব না’ সেটাই দেখার অপেক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy