হিজাব মামলার নিষ্পত্তি হল না। বিচারপতি হেমন্ত গুপ্ত কর্নাটক হাই কোর্টের রায় বহাল রাখলেন, অর্থাৎ স্কুলে হিজাব পরে আসার উপর কর্নাটক সরকারের যে নিষেধাজ্ঞাকে কর্নাটক হাই কোর্ট বৈধ ও সাংবিধানিক বলে রায় দিয়েছিল, তাকে তিনিও বৈধতা দিলেন। বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া বললেন, ওই নিষেধাজ্ঞা বৈধ নয়। মীমাংসার জন্য আবার শুরু হল লম্বা লড়াই। প্রধান বিচারপতি হয়তো এ বার তিন বা ততোধিক সদস্যের কোনও বেঞ্চের সামনে এই মামলাটিকে পাঠাবেন।
কর্নাটক সরকার ‘কর্নাটক এডুকেশন অ্যাক্ট অ্যান্ড রুল’ অনুযায়ী ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ একটি আদেশনামা জারি করে। সেখানে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্ধারিত ইউনিফর্মের বাইরে কোনও ধর্মীয় পোশাক পরে আসতে ছাত্রছাত্রীদের নিষেধ করা হয়। এই নিয়ম অমান্য করে কিছু মুসলিম ছাত্রী হিজাব পরে ক্লাস করতে গেলে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ক্লাসে হিজাব পরার অধিকার চেয়ে কিছু ছাত্রী হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। দীর্ঘ শুনানির পর কর্নাটক হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ সরকারি আদেশ বহাল রাখে, এবং বলে যে, হিজাব ইসলামের অপরিহার্য অঙ্গ নয়। ওই ছাত্রীদের একাংশ সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়, আরও বেশ কিছু সংস্থাও হিজাবের পক্ষ নিয়ে মামলায় অন্তর্ভুক্ত হয়।
আদালতে যখন এই বিচারপর্ব চলছে, তখনই ইরানে হিজাব না পরার দাবিতে নিজেদের চুল কেটে, হিজাব আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ করছেন মেয়েরা। এই আন্দোলনে দু’শোর বেশি আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্তত কুড়ি জন নাবালিকা। তবু আন্দোলনকে দমন করা যায়নি। খোমেনি সরকার মেয়েদের হিজাব থেকে মুক্তি দিতে নারাজ। তার ঠিক বিপরীত চিত্রটি দেখা যাচ্ছে ভারতে। এখানে মুসলিম মেয়েরা হিজাব পরে ক্লাস করার অধিকারের দাবিতে সরব। যদিও ভারতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে হিজাব পরায় নিষেধাজ্ঞা নেই, তাই সামগ্রিক ভাবে হিজাব পরা বা না-পরার অধিকার নিয়ে চর্চার প্রশ্ন নেই। ভারতে প্রশ্ন হল, কোনও সরকার কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্মের সঙ্গে হিজাব পরে আসায় নিষেধাজ্ঞা চাপাতে পারে?
এক পক্ষের দাবি, হিজাব পরা কোনও ছাত্রীর মৌলিক অধিকার। তা যেমন ধর্মীয় অধিকারের মধ্যে পড়ে, তেমনই ব্যক্তির মর্যাদা রক্ষার মৌলিক অধিকারের মধ্যেও পড়ে। তা ছাড়া, ছাত্রীরা হিজাব পরে ক্লাসে এলে কারও কোনও অধিকার লঙ্ঘিত হয় না। এ ছাড়াও তাঁরা যুক্তি দেন, হিজাব পরার ব্যাপারটি ব্যক্তির নির্বাচন বা ‘চয়েস’-এর অন্তর্গত। এবং কোনও অবস্থাতেই হিজাব পরার জন্য এক জন শিক্ষার্থীর শিক্ষাতে ব্যাঘাত ঘটানো যায় না।
অন্য পক্ষের দাবি, ক্লাসরুমের মধ্যে নিজের ইচ্ছামতো পোশাক পরার দাবি কখনও মৌলিক অধিকার হতে পারে না। তা হলে ইউনিফর্ম-ই উঠে যাবে। স্কুল বা কলেজ কর্তৃপক্ষ স্থানীয় এলাকায় প্রচলিত রীতি মেনে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাকবিধি ঠিক করে দিতেই পারেন। ইউনিফর্ম প্রতিষ্ঠানের সকল ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রযোজ্য, কোনও একটি ধর্মকে ছাড় দেওয়া যায় না। দিলে প্রতিষ্ঠানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের ব্যাঘাত ঘটে।
এই দু’পক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে অগণিত ছাত্রী আর তাদের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। স্কুলশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত এক সমাজকর্মী হিসাবে আশঙ্কা হয়, যে পক্ষেরই জিত হোক না কেন, হিজাব মামলার রায়ের প্রভাব সমাজ জীবনে কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে। যদি রায় হিজাবের পক্ষে আসে, তবে প্রগতিশীল মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরার জন্য পরিবার ও সমাজের থেকে প্রবল চাপ আসবে। হিজাবের ঝুল বাড়বে, তা হয়তো ক্রমে বোরখায় পরিণত হবে। সেই সঙ্গে, স্কুলে ইউনিফর্ম বা ড্রেস কোড লঙ্ঘন করার প্রবণতা সব সম্প্রদায়ের মধ্যেই দেখা দিতে পারে। একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নিজের ধর্মের প্রচলিত বা অপ্রচলিত অভিজ্ঞান স্কুলে-কলেজে পরে আসার চেষ্টা হয়তো দেখা দেবে।
অপর দিকে, আদালত যদি স্কুলে হিজাব পরা নিষিদ্ধ করে, তা হলে হয়তো বেশ কিছু মেয়েকে সরকারি স্কুল ছেড়ে এমন কোনও প্রতিষ্ঠানে পড়তে যেতে হবে, যেখানে হিজাব পরায় বাধা নেই। তাতে মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ ব্যাহত হবে। মনে রাখতে হবে যে, নাবালিকা মেয়েরা নিজেদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
সবচেয়ে ভাল হয় যদি রাষ্ট্রের দিক থেকে, এবং পরিবার ও সমাজের দিক থেকে হিজাব পরার বিষয়টি মেয়েদের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়। হিজাব পরার চাপ না থাকায় ইরানের মেয়েদের মতো ভারতে আজকের, বা আগামী প্রজন্মের মেয়েদের পিতৃতন্ত্রের চাপানো পোশাক বাতিলের দাবিতে পথে নেমে মৃত্যুবরণ করতে হবে না। মুসলিম মেয়েদের সমানাধিকারের লড়াই গতি পাবে। ভারতের সব মেয়েই নিজেদের পছন্দের পোশাক পরবে। হয়তো কিছু মেয়ে হিজাব পরাকেও তাদের স্বাধিকারের মধ্যে গণ্য করবে কিছু দিন। সামাজিক প্রত্যাশার চাপ যত কমবে, তত তারাও স্বাধীন ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে নিজের পোশাক, নিজের দেহ সম্পর্কে। সেই নির্বাচনকে মান্যতা দিতে হবে বইকি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy