Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
National Emblem controversy

প্রতীক ও জাতিগত আত্মপরিচয়

গুজরাত ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি ক্রমাগত দাবি করতে থাকে যে, সিংহকে রাষ্ট্রীয় পশু হিসেবে মান্যতা দিতে হবে।

অর্যমা ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২২ ০৪:২৩
Share: Save:

নতুন সংসদ ভবনের মাথায় দেশের জাতীয় প্রতীক অশোক স্তম্ভের নতুন রূপ নিয়ে খুব একচোট বিতর্ক হয়ে গেল। পশুর জাতীয় গুরুত্বকে কেন্দ্র করে বিতর্ক অবশ্য এই প্রথম নয়। ১৯৭২ সালে, ইন্দিরা গান্ধী যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী, তৎকালীন পর্যটন ও অসামরিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী করণ সিংহের প্রচেষ্টায় ভারতের জাতীয় পশু সিংহ পরিবর্তন করে করা হল বাঘ। শুরু হল বিতর্ক। সরকার লোকসভায় বিবৃতি দিয়ে জানাল যে, ভারতে ক্রমহ্রাসমান বাঘের সংখ্যার কথা মাথায় রেখেই এই পরিবর্তন। কিন্তু, সময়ের সঙ্কেত কি তা-ই বলে? ১৯৭১-এ ভারত-পাক যুদ্ধে আমেরিকার মদতে পুষ্ট পাকিস্তানকে হারিয়ে ভারত তখন এক আত্মপ্রত্যয়ী রাষ্ট্র— জাতীয় প্রতীক বদলানোর ঘটনা কি সেই আত্মপ্রত্যয়ী রাষ্ট্রের আত্ম-উপস্থাপনও ছিল না?

বাঘের জাতীয় পশুর মর্যাদা লাভের এই ঘটনার প্রায় দুই দশক আগে, ১৯৪৯ সালে, প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের শিশুদের উদ্দেশে পাঠান ‘ইন্দিরা’ নামের একটি হস্তিশাবক। জাপানের শিশুদের উদ্দেশে লেখা চিঠিতে নেহরু হাতিকেই ভারতের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন, কারণ তাঁর মতে প্রাণী হিসেবে সেটি শান্ত, অথচ ক্ষমতাশালী— অনেকটা তাঁর প্রকল্পিত ভারতের মতোই। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে নেহরু একে একে আমেরিকা, তুরস্ক, জার্মানি, চিন, নেদারল্যান্ডস প্রভৃতি দেশে একের পর এক হস্তিশাবক উপহার তথা ভারতের শুভেচ্ছার দৌত্য হিসেবে পাঠাতে থাকেন।

এ দিকে গুজরাত ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি ক্রমাগত দাবি করতে থাকে যে, সিংহকে রাষ্ট্রীয় পশু হিসেবে মান্যতা দিতে হবে। সেই দাবি মেনে ১৯৪৮ সালে সিংহকেই রাষ্ট্রীয় পশুর মর্যাদা দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। রাজনৈতিক মদত দিয়েছিল তৎকালীন গুজরাত প্রদেশ কংগ্রেস— ভারতের একমাত্র রাজ্য, যেখানে সিংহ রয়েছে। বল্লভভাই পটেলের সময় থেকেই গুজরাত প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব ছিল চরিত্রগত ভাবে রক্ষণশীল, নেহরুর আপাত-সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের বিরোধী। স্থানীয় সাংস্কৃতিক পরিচিতি রক্ষার স্বার্থে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও সঙ্ঘ পরিবারকে বহু ক্ষেত্রে সমর্থন জুগিয়েছে গুজরাত প্রদেশ কংগ্রেস। ১৯৪৮ সালের জাতীয় পশুসংক্রান্ত দাবির ক্ষেত্রে গুজরাতের রাজনৈতিক চাপ ছিল অন্যতম কারণ।

১৯৫০-এর পর থেকে দিল্লির রাজনীতিতে নেহরুর প্রাধান্য বাড়তে থাকায় কে এম মুনশি, ভি পি মেনন, এমনকি বল্লভভাই পটেলের ছেলে দাহিয়াভাই পটেলও ক্রমে কংগ্রেস ছেড়ে স্বতন্ত্র পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০-এর দশকের মাঝে মোরারজি দেশাই নেহরু ও ইন্দিরার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে উঠে আসেন, এবং ১৯৬৯-এর কংগ্রেসের ভাঙনের অন্যতম কান্ডারি হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে পাওয়া ষোলোটি আসনের মধ্যে মোরারজির কংগ্রেস গুজরাতেই পেয়েছিল এগারোটি আসন। ১৯৭১ সালের নির্বাচনে ইন্দিরার বিপুল জয়ের পরেই ১৯৭২ সালে জাতীয় পশু হিসেবে গুজরাতের সিংহের বদলে বাঘকে ঘোষণা করার ঘটনা বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। এই পদক্ষেপ গুজরাত প্রদেশ কংগ্রেসের রক্ষণশীল অস্তিত্বকে প্রতীকী অস্বীকারও বলা যায়; অন্তত গুজরাতের নেতৃত্ব তা-ই ভেবেছিল।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার কিছু পরেই গুজরাতের অন্যতম শিল্পপতি, তথা ঝাড়খণ্ড থেকে তৎকালীন রাজ্যসভার সদস্য পরিমল নাথওয়ানি ভারতীয় পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে সিংহকে ফের জাতীয় পশু ঘোষণার দাবি করেন। ইউপিএ-র আমলে ২০১২ সালে নাথওয়ানি প্রথম এই দাবি তুললেও তখন প্রস্তাবটি খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু ২০১৫ সালে এই একই প্রস্তাব পরিবেশমন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর পরিবেশ কমিটির আলোচনার বিষয়বস্তু করেন। যদিও ন্যাশনাল বোর্ড অব ওয়াইল্ড লাইফ প্রস্তাবটি খারিজ করে দেয়। তাদের যুক্তি ছিল, বাঘ ভারতের সতেরোটি রাজ্যে পাওয়া যায়, আর সিংহের উপস্থিতি কেবলমাত্র গুজরাতে। অন্য দিকে, সিংহকে জাতীয় পশু ঘোষণার পক্ষে মূল যুক্তি ছিল, যে হেতু ভারতের জাতীয় প্রতীক সারনাথের সিংহ, এবং ১৯৭২-এর আগে সিংহই ছিল জাতীয় পশু, তাই তাকে ফের জাতীয় পশুর মর্যাদা দেওয়া হোক।

অবশ্য বিজেপির গুজরাত গোষ্ঠীর এই দাবি অবিসংবাদী ছিল না। ২০১৮ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত গরুকে জাতীয় পশু ঘোষণার কথা উঠেছে অনেক বার। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের পাশাপাশি খোদ এলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতির মুখেও শোনা গিয়েছে এমন দাবি। ২০১৭ থেকে যোগী আদিত্যনাথের ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আরও জনসমর্থন পেয়েছে এই দাবি। ২০১৪ সালে মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সিংহ, কিন্তু এখনও পর্যন্ত সিংহকে জাতীয় পশু করা যায়নি। সামনের ডিসেম্বরেই গুজরাত বিধানসভা ভোট। ভারতের জাতীয় প্রতীকের নতুন রূপ তুলে ধরে আসন্ন বিধানসভা ভোটে গুজরাতের ঐতিহ্যময় দাবিতেই কি প্রলেপ দিচ্ছেন মোদী— উদ্দেশ্যটি কি মূলত আঞ্চলিক ও সাময়িক?

এই প্রাত্যহিক রাজনীতির বাইরে তাকালে বোঝা যাবে যে, সুদূরপ্রসারী প্রভাবের ক্ষেত্রে বিষয়টি তার থেকেও বেশি গভীর। জাতীয় প্রতীক হল ‘আধুনিক টোটেম’। প্রাগাধুনিক সমাজের গোষ্ঠীচেতনার মূল সমন্বয়-বিন্দু ছিল টোটেম— যেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোনও একটি পশুকে পূর্বপুরুষ রূপে কল্পনা করা হত। এই প্রতীক গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের মধ্যকার সম্পর্ক নির্দেশ করত। আজকের পশুকেন্দ্রিক জাতীয় পরিচয়ের প্রতীকীকরণের রাজনীতির মধ্যে রয়েছে সেই আদি টোটেমবাদের বহমানতা। ভাষাবিদ আরনেস্ট রেনাঁর মতে, কালেক্টিভ মেমরি বা সামূহিক স্মৃতি হল জাতীয় কল্পনার মূল স্তম্ভ। কিন্তু যে কোনও দেশেই সামূহিক স্মৃতি স্মরণ-বিস্মরণের এক জগাখিচুড়ি। ভারতের মতো দেশে, যেখানে প্রায় প্রত্যেক রাজ্যের নিজস্ব জন্তুর প্রতীক রয়েছে, এবং ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক চরিত্রানুসারে মানব-পশু সম্পর্ক ভিন্ন; সেখানে রাষ্ট্রীয় টোটেমের বদল বিতর্ক সৃষ্টি করবেই। বহুত্বের মাঝের ঐক্যকে কেন্দ্রীকৃত সংখ্যাগুরুর একমাত্রিক স্মৃতির রূপ দিতে গেলেই সমস্যা দেখা দেবে।

অন্য বিষয়গুলি:

National Emblem controversy National Emblem of India Lion
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy