সাংবাদিকের কণ্ঠরোধ ভারতে এখন ‘স্বাভাবিক’। কিন্তু অল্ট নিউজ়-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ জ়ুবেরের (ছবিতে, সামনে) গ্রেফতারির ঘটনাকে স্রেফ আরও এক সাংবাদিকের কণ্ঠরোধের চেষ্টা হিসাবে দেখলে খণ্ডদর্শন হবে। তাঁর গ্রেফতারি আসলে আদর্শগত এক দীর্ঘ যুদ্ধের মুষলপর্ব।
গোটা দুনিয়াতেই বিশেষত দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি পরিকল্পিত ভাবে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করছে। তার একটা দিক রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন, দলীয় বার্তা প্রচার ইত্যাদি। অন্য দিকে, দলের নেতা, বেতনভুক পেশাদার কর্মী, এবং ‘ভক্ত’রা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে অপতথ্যের চাষ করছে নাগাড়ে— গুজব, ভুল খবর, অর্ধসত্য ছড়িয়ে কল্পিত শত্রু তৈরি করেছে, প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেছে বিদ্বেষের বাস্তুতন্ত্র গড়ে তুলতে। মন-দখলের লড়াইয়ে সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া মনগড়া কথার কোনও বিকল্প নেই, তা হাতেকলমে পরীক্ষা করেই বুঝে নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। তার পর থেকে দীক্ষিত মন সেই ঘৃণার ব্যাটন বইছে তো বইছেই। বছরের পর বছর সুপরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলা এই মিথ্যার মহীরুহে কুঠারাঘাত করা অসম সাহসিকতার কাজ। সব দেশেই কয়েক জন এই স্ব-আরোপিত দায়িত্ব নিয়েছেন। অল্ট নিউজ়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা জ়ুবের তাঁদেরই এক জন।
দেশে রাজনৈতিক ভাষ্য নিয়ন্ত্রণে সোশ্যাল মিডিয়াকে কতখানি ব্যবহার করা যায়, বিজেপি সে কথাটি ২০১২ সালেই বুঝেছিল। তখন থেকেই ধাপে ধাপে কাজে যোগ দেন বেশ কয়েক লক্ষ সোশ্যাল মিডিয়া ভলান্টিয়ার। তাঁদের কেউ পেশাদার ট্রোলার, কেউ পেশাদার ভুল খবরের জোগানদার। তাঁদের সাংগঠনিক উদ্যোগে দেশের আম আদমির হোয়াটসঅ্যাপে, ফেসবুকে প্রতি দিন ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষজ্ঞরা আজ এই ঘটনাকে বলেছেন ‘ডিজিটাল মহামারি’। এই সোশ্যাল ভলান্টিয়ারদের প্রতিনিয়ত উজ্জীবিত করেছেন বিজেপির প্রথম সারির নেতারা। অনেককে ‘ফলো’ করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও। এক দশকের পরিশ্রমের ফল আজকের ভারত।
এই পরিস্থিতিতে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের যে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল, অনেক ক্ষেত্রেই তারা সে দায়িত্ব পালন করেনি। হিংসার শিকড় খুঁজে লাগাতার সত্য প্রকাশ করার কাজটা শুরু করে কতকগুলি অতিক্ষুদ্র সংগঠন। প্রতীক সিংহ, মহম্মদ জ়ুবেরদের সংগঠন অল্ট নিউজ় তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। সংবাদ পরিবেশনের প্রাথমিক শর্ত ফ্যাক্ট চেকিং বা তথ্য যাচাই। এই কাজটি নিরলস ভাবে করে গিয়েছে এই ছোট সংগঠনগুলি। মিথ্যা তথ্য খণ্ডনের প্রশ্নে দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে খুচরো নেতা, কাউকেই রেয়াত করেনি তারা। এ কাজ অভিশপ্ত সিসিফাসের রোজ পাহাড়চূড়ায় পাথর তোলার মতো— কেউ বাহবা দেবে না, এক জন সাংবাদিকের কর্মজীবনে যে নানা মাত্রিক অভিজ্ঞতা থাকে, ছোঁয়া যাবে না তাকেও। শুধু যত বার মিথ্যে তথ্য ছড়াবে কেউ, সত্যের খুঁটি আগলে ধরে থাকতে হবে সর্বশক্তি দিয়ে। যাদের মিথ্যা ধরলেন জ়ুবেররা, তারা তো শত্রু ভাববেই। ফলে জ়ুবেরদের শত্রুর শেষ নেই।
২০১৭ সালে জ়ুবেররা যখন অল্ট নিউজ় তৈরি করে ভুয়ো খবরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন, তত দিনে আইটি সেলের ভুয়ো তথ্যের মৌরসিপাট্টা তৈরি হয়ে গিয়েছে। শুরু হচ্ছে ২০১৯ ভোটের প্রস্তুতি। দামামা বাজিয়ে মিথ্যা ছড়ানোর কাজে নামল গৈরিকবাহিনী। ‘দ্য ইন্ডিয়া আই’ বলে একটি ফেসবুক পেজের কথা ধরা যাক। এখানে সদস্যের সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষেরও বেশি। এই পাতা থেকে প্রতি দিন নিয়ম করে ভুয়ো খবর ছড়ানো হত। বেছে বেছে আক্রমণ করা হত সংখ্যালঘুদের। এই সময়কালে বিজেপি সাইবার আর্মি ৪০০+ বলে একটি গ্রুপ তৈরি হয়, যার পরিচালকদের মধ্যে ছিলেন বিজেপির আইটি সেলের কর্তা অমিত মালবীয়ও। গ্রুপটির বর্ণনায় লেখা ছিল, “এই জাতীয়তাবাদী দলটি হিন্দু যোদ্ধাদের, যারা দেশকে রাজনৈতিক ভাবে কংগ্রেস ও কমিউনিস্টদের হাত থেকে, এবং ধর্মীয় ভাবে ইসলাম এবং খ্রিস্টীয়দের মতো অশুভ শক্তির হাত থেকে বাঁচাবে।” শোনা যায়, প্রত্যেক সভ্যকে নাকি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, অন্তত পঞ্চাশ জনের গ্রুপ বানিয়ে একটি চ্যাটবট থেকে আসা তথ্য সেখানে ছাড়তে হবে। প্রতি দিন সকাল সন্ধে অনর্গল এই সমস্ত জায়গা থেকে প্রচারিত মিথ্যাগুলি ধরতে চেষ্টা করেছে বুমলাইভ, অল্ট নিউজ়, লজিক্যাল ইন্ডিয়ানের মতো সংস্থা। মিথ্যাটা কোথা থেকে প্রচারিত হয়েছে, আসল সত্যটা কী, তারা জানিয়ে দিয়েছে তাও।
কখনও অমিত মালবীয় বলেছেন, শাহিন বাগে মহিলাদের টাকা দিয়ে আনা হয়েছে। কখনও বলেছেন, সিএএ মঞ্চ থেকে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান তোলা হচ্ছে। এমন ভুয়ো দাবির তালিকা অতিদীর্ঘ। কিন্তু, অল্ট নিউজ়ের মতো সংস্থা প্রতি ক্ষেত্রেই ঠান্ডা মাথায় প্রচারিত অপতথ্যটিকে নাকচ করেছে, পাশাপাশি প্রকৃত সত্য তুলে ধরেছে। করোনার সময়েও ক্রমাগত মুসলিম ঘৃণা ছড়ানোর কাজ জারি রেখেছে দক্ষিণপন্থী আইটি সেলের মাইনে করা পদাতিকরা। রাওয়ালপিন্ডির ২০০৭ সালের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে বলা হয়েছে, এ ঘটনা এ দেশের, মুসলিমরা কোভিড বিধি মানছেন না। তখন জ়ুবেরদের তৈরি করা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলিই আইটি সেলের কারখানায় তৈরি করা মিথ্যা খবরকে নস্যাৎ করেছে প্রতি দিন। মিথ্যার প্রচারযন্ত্রের তুলনায় শক্তিতে ছোট হলেও তাঁরা গড়ে তুলেছেন মিথ্যাকে চিহ্নিত করার এক নিটোল ব্যবস্থা। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মূলধারার সংবাদমাধ্যম যে দায়িত্ব পালনে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছিল, অল্ট নিউজ়ের মতো প্রতিষ্ঠান সেই কাজ করে চলেছে।
ইউনিভার্সিটি অব সাদার্ন ক্যালিফর্নিয়া এবং ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, টুইটারের প্রায় ১৫ শতাংশ কোনও ব্যক্তির হ্যান্ডল নয়। এগুলি চ্যাটবট, বহু মানুষের মধ্যে একই তথ্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ছড়িয়ে দিতেই এই হ্যান্ডল ব্যবহার করা হয়। বছর দুয়েক আগেই রেডিটের তরফে করা একটি পাঁচ মাসের সমীক্ষায় দেখা যায়, অন্তত ১৮ হাজার টুইটার অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে বিজেপির পক্ষে ভুয়ো খবর ছড়ানো হয়েছে প্রতি দিন। আর এই মেয়াদে সমস্ত মিথ্যেকে ক্রমাগত খণ্ডন করে গিয়েছেন জ়ুবেররা। এ এক নতুন মহাভারত যেন। অজুত মানুষকে অনর্গল অর্থের বিনিময়ে ‘অশ্বত্থামা হত’ বলানো হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ধরেই নিয়েছে অশ্বত্থামা নিহতই। এখন যদি কোনও কুশীলব স্রেফ সত্যানুসারী হয়ে এই দশকের প্রচেষ্টাতে জল ঢেলে দিতে চান, তাঁকে তো প্রত্যাঘাত সইতে হবেই।
সামনে বেশ কিছু রাজ্যে ভোট, বছর দুয়েক পরে আরও এক বার লোকসভা নির্বাচন। জয়ের হ্যাট্রিক নিশ্চিত করতে সোশ্যাল মিডিয়া ভলান্টিয়ারদের সংখ্যাও বাড়বে বলেই আশঙ্কা। এই সবের মধ্যে জ়ুবের যেখানেই থাকুন— জেলের কুঠুরির বাইরে বা ভিতরে— সেই মহাভারতে তাঁর ভূমিকার কথা ভোলা যাবে না কোনও মতেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy