Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
দেশের মধ্যে প্রথম ড্রোন আক্রমণ এই ছোট পার্বত্য রাজ্যে
Manipur Violence

ক্ষতবিক্ষত মণিপুর

১ এবং ২ সেপ্টেম্বর ড্রোন আক্রমণের সম্মুখীন হলেন মণিপুরের মানুষ— ভারতের মাটিতে প্রথম বার কোথাও এমন কাণ্ড ঘটল। প্রথম ড্রোন বোমা হামলার মুখোমুখি হয়েছিল কৌতরুক।

অগ্নিগর্ভ: জাতিগত বিদ্বেষের আগুনে জ্বলছে মণিপুর, ১৬ জুন, ২০২৩।

অগ্নিগর্ভ: জাতিগত বিদ্বেষের আগুনে জ্বলছে মণিপুর, ১৬ জুন, ২০২৩। ছবি পিটিআই।

অনিন্দিতা ঘোষাল
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৩৮
Share: Save:

আবার ভয়ানক অশান্ত মণিপুর। সে রাজ্যের জাতিগত বিদ্বেষজাত সংঘর্ষ আঠারো মাস পেরোলো। ২০২৩ সালের মে মাসে পাহাড়ের বাসিন্দা কুকি, জো সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে সমতলের বাসিন্দা মেইতেইদের সমস্যার সূত্রপাত হয়, যখন মেইতেইরা পাহাড়ে জমির অধিকার, বাসস্থান তৈরি এবং সরকারি চাকরিতে সুবিধা পাওয়ার জন্য, শিডিউলড ট্রাইবস বা তফসিলি জনজাতি হওয়ার দাবি জানায়। মণিপুর হাই কোর্ট আবার সেই দাবি মেনে নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে সবুজ সঙ্কেতও দেয়। তার পর থেকে, এই শেষ ১৭ মাসে মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকা-ভিত্তিক মেইতেই এবং পার্শ্ববর্তী পাহাড়-ভিত্তিক কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে জমি, চাকরি এবং রাজনৈতিক আধিপত্য সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে, জাতিগত হিংসায় এখনও অবধি ২২৬ জনের বেশি মানুষ নিহত, প্রায় ৬০০০০ হাজার পরিবার গৃহহীন।

১ এবং ২ সেপ্টেম্বর ড্রোন আক্রমণের সম্মুখীন হলেন মণিপুরের মানুষ— ভারতের মাটিতে প্রথম বার কোথাও এমন কাণ্ড ঘটল। প্রথম ড্রোন বোমা হামলার মুখোমুখি হয়েছিল কৌতরুক। দ্বিতীয় হামলা হয় কৌতরুক থেকে মাত্র তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে পশ্চিম ইম্ফলের একটি গ্রামে। এ দেশে এত দিন কেউ, এমনকি কেন্দ্রীয় সামরিক সংস্থাও, দেশের ভিতরে ড্রোন আক্রমণ চালায়নি। শুধু ড্রোন নয়, মণিপুরে এখন রকেট, হ্যান্ড গ্রেনেড, ডেটোনেটর এবং স্টান গ্রেনেড, স্টিংগার গ্রেনেড, স্থানীয় ভাবে তৈরি ‘পাম্পি’ নামে পরিচিত ইম্প্রোভাইজ়ড মর্টার, সাধারণ অস্ত্রের মতো ব্যবহার করা হচ্ছে। যেমন, বিষ্ণুপুর জেলায় রকেট হামলা চালানো হয়েছে, আক্রমণের মুখে পড়েছে জিরিবাম এবং কাকচিং জেলাও। মৈরাং শহরের মাইরেম্বাম লেকাইতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মাইরেম্বাম কোইরেং-এর বাসভবনের কম্পাউন্ডে রকেট ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে। বিষ্ণুপুর জেলার নারাইনসেনা, নাম্বোল কামং এবং ইম্ফল পূর্ব জেলার পুখাও, দোলাইথাবি, শান্তিপুরে একাধিক ড্রোন দেখা গেছে, আতঙ্কে মানুষ রাতে আলো নিবিয়ে দেওয়া শুরু করেছেন।

মণিপুর পুলিশ এবং অসম রাইফেলসের সঙ্গে বিএসএফ এবং সিআরপিএফ-এর সম্মিলিত বাহিনী অস্ত্র উদ্ধারে নেমেছে। উদ্ধারের সরকারি তালিকা দেখলেও চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। মৈরাং-এ ৬ সেপ্টেম্বর রকেট হামলার পর, পাহাড়ি এলাকা থেকে ২৬টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। কাংপোকপি জেলার লোইচিং রিজ থেকে রাইফেল, এমএম পিস্তল, কার্তুজ, হাতবোমা, ডেটোনেটর এবং দেশীয় মর্টার এবং দূরপাল্লার ইম্প্রোভাইজ়ড মর্টার উদ্ধার করা করেছে। চূড়াচাঁদপুর জেলার গোঠোল গ্রাম ও থৌবাল জেলার ফাইনোম পাহাড়ি এলাকা থেকেও সমস্ত উচ্চ মানের অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। অ্যান্টি-ড্রোন বন্দুক মোতায়েন করার সঙ্গে, সামরিক হেলিকপ্টার ও বিমান টহল দিচ্ছে। পার্বত্য জেলা চূড়াচাঁদপুর, টেংনুপাল, উখরুল, কামজং এবং ফেরজালে বিশেষ সতর্কতা জারি রাখা হয়েছে।

গোদের উপর বিষফোড়া— গত ২০ সেপ্টেম্বর, মণিপুরের নিরাপত্তা উপদেষ্টা কুলদীপ সিংহ ঘোষণা করেন, মায়ানমার থেকে ৯০০ জন প্রশিক্ষিত কুকি জঙ্গি ঢুকে এসেছে। অবশ্য এই ঘোষণার কয়েক দিন পরই বিবৃতিটি সংশোধন করে বলা হয়, এই তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিরাপত্তা বাহিনী নাগরিকদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য উচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছে। গুজব বা যাচাই না-করা খবরে বিশ্বাস না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সমস্যা তাতে লেশমাত্র কমছে না। জিরিবাম জেলায় এই ক’দিন আগে এক স্কুলশিক্ষিকা ধর্ষিত ও নিহত হলেন। পোড়ানো হল অসংখ্য দোকান এবং বাড়ি। হামলা চলল কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআরপিএফ শিবিরেও। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, পাল্টা গুলিতে নিহত ১১ জন কুকি জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। স্বভাবতই কুকি এবং মেইতেইদের মধ্যে এখন পারস্পরিক সন্দেহ ও বিদ্বেষ ক্রমশ গভীরতর। গোটা রাজ্য মেইতেই এবং কুকি এলাকা, দু’টি ভাগে বিভক্ত। সম্পূর্ণ তল্লাশি ছাড়া কোনও এলাকায় ঢোকা যায় না। কুকি পক্ষের বক্তব্য, কে তাঁদের এলাকায় ঢুকছে বা বেরোচ্ছে, তা নিরীক্ষণের জন্য যে ড্রোন তাঁরা ব্যবহার করেন, তা দিয়ে বোমা ফেলা যায় না।

ইম্ফল উপত্যকার পাঁচটি জেলা জুড়ে হাজার হাজার মেইতেই বাসিন্দারা সাম্প্রতিক ড্রোন, রকেট এবং অন্য মারণ আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন তৈরি করেছেন। ইতিমধ্যে, মণিপুর অখণ্ডতার সমন্বয়কারী কমিটি এই সঙ্কট সমাধানে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কাছে নিষ্পত্তিমূলক পদক্ষেপের দাবি করেছে। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের পাশাপাশি মহিলারাও বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে, ‘ভুয়ো ইন্টেল ইনপুট’-এর বিরুদ্ধে জনজাতি ঐক্য কমিটি কাংপোকপিতে কুকি-জো সম্প্রদায়ের বিশাল সমাবেশে যোগ দিয়েছিল। কিছু কুকি প্রতিনিধিরা জাতিগত বিরোধ মেটানোর সমাধান হিসাবে পুদুচেরির মতো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরির দাবি জানিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য বিজেপি, নাগা পিপলস ফ্রন্ট ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির বিধায়ক-সহ
রাজ্যে ক্ষমতাসীন জোটের জরুরি বৈঠক ডাকেন। কিন্তু তাতেও কোনও সমাধানসূত্র বার হয়নি। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি ড্রোন হামলার তদন্তভার নিয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের পর ভারতের দিক থেকে এখন নানা নতুন আশঙ্কা। মায়ানমার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আশঙ্কার একটি উৎস। বাংলাদেশের বর্তমান কর্ণধার মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর শপথ গ্রহণের আগেই ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এখন এমনকি এও প্রচার করা হচ্ছে যে, মায়ানমারে চিন প্রদেশ এবং ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তৃত অঞ্চলকে। উদ্দেশ্য নাকি— দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত মহাসাগর ও তার আশপাশের অঞ্চলে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলির এক প্রভাববলয় তৈরি। এই এলাকায় বিশেষ করে কুকিদের মতো খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী, বা নাগাল্যান্ড, মিজ়োরাম, মেঘালয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং মায়ানমারে চিন প্রদেশের খ্রিস্টীয় ধর্মের অনুসারী বাসিন্দাদের নিয়ে নাকি ক্রাউন কলোনি মডেলে ‘বাফার স্টেট’ তৈরি করলে প্রথম বিশ্বের নজর রাখতে সুবিধা হবে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। স্বভাবত তাতে যুক্ত হয়েছে চিন এবং পাকিস্তানের নামও।

মণিপুরের ক্ষেত্রে আগে আফিম চাষ, অস্ত্র এবং ড্রাগ ব্যবসার কথা বলা হত, নতুন এ সব ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এখন এই সমস্যাকে এক বিরল রূপ দিয়েছে। রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। নানা ভাবেই মণিপুরের সংঘাতকে কেন্দ্রীয় সরকার প্রসারিত হতে দিয়েছে। অসংখ্য ভয়াবহ ঘটনা, সাংবাদিকদের উপর গুলি চালনা, ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ বন্ধ ইত্যাদির পরও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মণিপুর যাওয়া তো দূরস্থান, টুঁ শব্দটিও খরচ করেননি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দিল্লিতে একটি সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেছেন যে, সাম্প্রতিক ঘটনার আগে মণিপুর এত দিন নাকি শান্ত ছিল!

দক্ষিণ এশিয়ার তথাকথিত ‘চিকেন নেক’ এখন আন্তর্জাতিক আলোচ্য। হিন্দু বা খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরির কথা বাদ দিলেও, মণিপুরে জমি, সংরক্ষণ, বৈধ ও অবৈধ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্ব আশু ভবিষ্যতে মেটার সম্ভাবনা নেই। একমাত্র সম্ভাব্য সমাধান, সব রাজনৈতিক দল এবং গোষ্ঠীদের আলোচনার টেবিলে বসানো। তবে সে কথা বলা সহজ। করবে কে?

অন্য বিষয়গুলি:

Manipur Drone Attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy