রাতের শহরের রাস্তাঘাটের উপরে পুরুষদের একচেটিয়া অধিকার, মহিলাদের উপস্থিতি সেখানে নগণ্য। শুধু রাতই বা কেন, দিনের বেলাও মহিলারা রাস্তায় বেরোন মূলত কোথাও না কোথাও যাওয়ার জন্য। তাঁরা একা একা উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাস্তা ধরে বা পাড়ার মোড়ে, এই ছবি বিরল। অথচ দিনে-রাতে শহরের নানা জায়গায় পুরুষদের দেখা যায় ছড়ানোছেটানো— পার্কের বেঞ্চে, চায়ের দোকানে, সর্বত্র। লিঙ্গভিত্তিক এই পার্থক্যের কারণ কী?
এই প্রশ্ন তুলেছিল হোয়াই লয়টার? উইমেন অ্যান্ড রিস্ক অন মুম্বই স্ট্রিটস (পেঙ্গুয়িন ইন্ডিয়া, ২০১১) বইটি। ‘লয়টার’, অর্থাৎ উদ্দেশ্যহীন ভাবে ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো। লেখিকা শিল্পা ফাড়কে, সমিরা খান, আর শিল্পা রাণাড়ে। তাঁরা বলেন, আমাদের সমাজ ও সরকার মহিলাদের শেখায়, শহরের পথঘাট তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। মহিলাদের নিয়ন্ত্রণ বা নিগ্রহ করা কেন খারাপ, তা বোঝানো হয় না পুরুষদের। শুধু মহিলাদেরই বলা হয় রাত করে বাড়ি না ফিরতে, রাস্তাঘাটে ছোট জামা না পরতে। সরকারি নির্দেশিকা বিধান দেয় মহিলাদের নাইট ডিউটি না দিতে।
কিন্তু যদি শহরের রাস্তায় মহিলাদের উপস্থিতির অন্য একটা চেহারা কল্পনা করি? যেখানে পুরুষদের মতো তাঁরাও ইচ্ছেমতো যখন খুশি, যেখানে খুশি যেতে-আসতে পারতেন? পথেঘাটে পুরুষরা যা যা করেন, তাঁরাও ঠিক তেমনটা করতে পারতেন, পুরুষদের হাতে যৌন হেনস্থার সম্মুখীন না হয়ে? বর্তমান আন্দোলনের সময়ে মহিলারা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছেন, লিঙ্গসাম্যের এই কল্পনাকে বাস্তবায়িত করার সমাধান বিপদের ভয়ে পথঘাট থেকে মহিলাদের আগলে রাখা নয়। বরং উপায় শহরের প্রতিটি পরিসরে মহিলাদের যাতায়াত বাড়ানো, যাতে এই সব পরিসরের উপর পুরুষদের একচেটিয়া অধিকার পিছু হটে। দরকার লিঙ্গবৈষম্যের বিষয়ে পুরুষদের শিক্ষিত করা। মহিলাদের রাত দখল করার অভিযান আমাদের এই দিকেই পথ দেখায়। দাবি তোলে যে, রাতের রাস্তাঘাট, দোকানবাজার, গণপরিবহণের উপরে মহিলাদেরও সমান অধিকার।
পথেঘাটে মহিলাদের উপস্থিতি বাড়ানোর প্রধান উপায় শহরের পরিকাঠামোগত উন্নয়ন। বর্তমান আন্দোলনে শামিল বহু মহিলা ও সংগঠন এই দাবি তুলেছেন। নগরীর সমস্ত জায়গায় মহিলাদের অবাধ আনাগোনা সুনিশ্চিত করতে দরকার রাস্তায় যথেষ্ট পরিমাণ আলো লাগানো, পথেঘাটে বেশি সংখ্যায় শৌচালয় নির্মাণ করা, চওড়া ফুটপাত বানানো, দিন ও রাতের সব সময়ে পরিবহণের সুব্যবস্থা করা। এর পাশাপাশি প্রয়োজন যানবাহনের চালক, হকার, বাস কন্ডাক্টর, দোকানদার, পুলিশ ইত্যাদি সব কাজেই বেশি সংখ্যায় মহিলাদের বহাল করা।
এ সব সুযোগসুবিধা না থাকলে মহিলারা যে পথেঘাটে চলাফেরা করতে পারেন না, তা নয়। কিন্তু এগুলি থাকলে তাঁদের নিরাপত্তা ও সুবিধা বাড়ে, আরও বেশি সংখ্যায় মহিলা বাইরে বেরোতে উৎসাহ পান। বর্তমানে নানা অসুবিধা অগ্রাহ্য করেই দৈনন্দিন নানা কাজে মহিলারা রাস্তায় বেরোন প্রত্যহ, নানা বিপদের ভয় অগ্রাহ্য করেই চলাফেরা করেন তাঁরা। পরিকাঠামোর অভাব তাঁদের ঠেকাতে পারে না। কিন্তু যদি পরিকাঠামোকে আরও উন্নত করা যায়, তবে তাঁদের চলাফেরাও অনেক সহজ হয়। প্রতিনিয়ত হিসাব কষে পথ চলতে হয় না।
এর পাশাপাশি দরকার মানসিকতার পরিবর্তন, বিশেষত পুরুষদের। পুরুষ হওয়ার দরুন রাস্তায় কী কী সুবিধা আমরা পাই যা মহিলারা পান না, কেনই বা তা পান না মহিলারা, কী ভাবে রোজ তাঁরা শহরের রাস্তায় নিগৃহীত হন, তা বোঝা দরকার। মহিলাদের আন্দোলনে সঙ্গী হয়ে পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন তাঁদের কথা শুনতে ও ছড়িয়ে দিয়ে— তাঁদের বক্তব্যকে নিজেদের বক্তব্যে ডুবিয়ে না দিয়ে। নিজেদের সাফাই গাইতে যেন না বলি, ‘নট অল মেন’— কারণ মহিলারা মনে করিয়ে দেন, প্রতি দিনের অজস্র ধর্ষণের প্রত্যেকটির পিছনেই এক জন করে (কখনও একাধিক) পুরুষ। শহরের পথেঘাটে মহিলারা ধর্ষিত হলে পুরুষরা যেন নিগৃহীতার দিকে আঙুল না তুলি। ধর্ষণের দায় একমাত্র ধর্ষকের, আর তাকে তৈরি করার দায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের।
হোয়াই লয়টার? বইয়ের লেখিকারা বলেন, শহরের উপর মহিলাদের অধিকারের প্রসঙ্গ অন্য এক বৃহত্তর প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত— ভারতীয় শহরের সব পরিসরকে নিজেদের দখলে রাখার যে মধ্যবিত্ত পুরুষ প্রবণতা। রাতের শহরে মহিলাদের উপস্থিতি যেমন আমরা বিপজ্জনক বা অবাঞ্ছিত বলে ভাবি, তেমনই পাড়ার পার্কে বসে থাকা স্থানীয় বস্তির মানুষ, বাড়ি ভাড়া চাইতে আসা সংখ্যালঘু পরিবার, ট্র্যাফিক লাইটে ভিক্ষা চাইতে আসা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, ফুটপাতে পসরা সাজানো হকার, বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা যৌনকর্মীর উপস্থিতি আমাদের বিরক্তি উৎপাদন করে। আমরা ঠিক করেছি, গোটা শহরের আগাগোড়া শুধু আমাদেরই, বাকিরা সবাই অবাঞ্ছিত। রাতের শহরের রাস্তাঘাটের উপর মহিলাদের অধিকার কায়েম করার আজকের লড়াই তাই বিশেষ জরুরি। তা যেন আমাদের দ্বারা প্রান্তিক করে রাখা অন্যান্য মানুষকেও শহরের উপর সমান অধিকার কায়েম করার সুযোগ করে দেয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy