Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Guardian Meeting

মা সন্তানের অভিভাবক নন?

ইদানীং স্কুলে ভর্তির খাতা অথবা পাসপোর্টে মায়ের নাম লেখার জায়গা হয়েছে, কিন্তু সন্তানের উচ্চশিক্ষা এবং কর্মজীবনের ক্ষেত্রে জন্মদাত্রীর পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সামান্যই।

শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:৩১
Share: Save:

ছাত্রী বলল, “মা-কে আনলে হবে, মিস?” বড়দিদিমণি নাছোড়, বাবাকেই চাই। কেননা স্কুলে ভর্তির ফর্মে ‘অভিভাবক’ হিসেবে যতই মা-বাবা দু’জনেরই নাম থাক, আসল ‘অভিভাবক’ তো বাবাই? আগে মায়ের নাম কোথাও থাকত না। এখন সামান্য কিছু জায়গায় জন্মদাত্রীর নামের স্থান হয়েছে। তবু সন্তানের শিক্ষা এবং কর্মজীবনে ‘নির্ধারক’-এর ভূমিকা নেওয়ার যোগ্যতা যে কেবল বাবারই আছে, ‘মহিলা’সুলভ ‘অযোগ্যতা’র যে সেখানে মোটেও স্থান নেই, এ কথা পুরুষ তো বটেই, দুর্ভাগ্যবশত অনেক মহিলাও মনে করেন। ২০১৮ সালে ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর করা এক সমীক্ষা দেখিয়েছিল, এমনকি বয়ঃসন্ধিকালে থাকা ছেলেরাও মনে করে, সংসার চালানোই মেয়েদের আসল কাজ। তাদের লেখাপড়া বেশি শেখানোর দরকার নেই। কারণ, তাতে ছেলেদের চাকরির সুযোগ নষ্ট হবে। এ-হেন মনোবৃত্তি নিয়ে বড় হওয়া পুরুষ সমাজ নারীকে ‘অভিভাবক’ হিসেবে মেনে নেবে, সন্তানের নামের সঙ্গে মায়ের পদবি যুক্ত করার কথা ভাববে, এমন আশা করা এই আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও আকাশকুসুম মনে হয়।

তবু সকলে তথাকথিত সামাজিক জ্যেষ্ঠতাতের পায়ে মেরুদণ্ড অঞ্জলি দিতে পারে না। যেমন পারেননি মৃণালিনী মজুমদার। ‘বার কাউন্সিল’-এ নাম নথিবদ্ধ করার সময় তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে, কেন, হয় বাবা নয় ‘স্বামী’র নাম লিখতে হবে? যে মা সন্তানকে জন্ম দেন, কোনও পুরুষের সাহায্য ছাড়াই তিনি যদি তাকে কোনও পেশায় যুক্ত হওয়ার যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেন, নথিভুক্তির সময় সেই মা-কে ‘স্বাভাবিক অভিভাবক’ হিসেবে গণ্য করা হবে না কেন? মৃণালিনী মামলা করলেন। মাতৃত্বের যোগ্য মর্যাদার আবেদন উপস্থাপিত করলেন আদালতে। উচ্চ আদালতে প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব এবং বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ‘ডিভিশন বেঞ্চ’ সম্প্রতি এ বিষয়ে রাজ্য এবং দেশের ‘বার কাউন্সিল’-এর কাছে কৈফিয়ত তলব করেছে।

ইদানীং স্কুলে ভর্তির খাতা অথবা পাসপোর্টে মায়ের নাম লেখার জায়গা হয়েছে, কিন্তু সন্তানের উচ্চশিক্ষা এবং কর্মজীবনের ক্ষেত্রে জন্মদাত্রীর পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ সামান্যই। ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স ইত্যাদি প্রায় সর্বত্র মায়েরা আমাদের মাতৃভূমিতেই ব্রাত্য হিসেবে থেকে যান। ছাত্রীর ‘কাস্ট সার্টিফিকেট’ বা ‘আধার কার্ড’ না থাকলে বড়দিদিমণি তাঁকে বাবার ‘আধার’-এর আশ্রয় নিতে বলেন।

‘হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট-১৯৫৬’-তে বলা হয়েছিল, সন্তানের ‘স্বাভাবিক অভিভাবক’ হবেন তিন জন, বাবা, মা এবং ‘স্বামী’। এই শুনে আনন্দ পাওয়ার কারণ নেই। কারণ, অবিবাহিত কন্যার অভিভাবক মা তখনই হতে পারবেন যখন বাবা সেই কাজের অনুপযুক্ত বা অনুপস্থিত হবেন। আর বিবাহিত মেয়ের তো ‘স্বামী’ই আছেন। ‘অভিভাবক’ কে? যিনি ব্যক্তি বা সম্পত্তির যত্ন নিতে পারেন, নিরাপত্তা বিধান করতে পারেন। মা যদি সেই কাজে পারঙ্গম হন, তবুও তাঁকে ‘অভিভাবক’ মানা হবে না? ১৯৯৯ সালে ‘গীতা হরিহরণ বনাম রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক’ মামলাতে মায়ের অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে জোরালো প্রশ্ন উঠেছিল। দেশের শীর্ষ আদালতের বিচারপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সেই মামলায় বাবা-মা দু’জনকেই ‘স্বাভাবিক অভিভাবক’ হওয়ার ক্ষেত্রে সমানাধিকারী হিসাবে স্বীকার করে নেন। সন্তানের জীবনে বাবার জীবদ্দশাতেই মায়েরও অভিভাবকত্বের অধিকার স্বীকৃতি পায়। ২০২২-এর জুলাই মাসে শীর্ষ আদালতে বিচারপতি দীনেশ মহেশ্বরী এবং বিচারপতি কৃষ্ণ মুরারির বেঞ্চ আরও এক ঐতিহাসিক রায় দেয়। সেখানে ঘোষণা করা হয়, প্রথম জীবনসঙ্গীর মৃত্যুর পর মা যদি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন তখনও তিনি আগের পক্ষের সন্তানের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী থাকবেন। অন্ধ্রপ্রদেশ আদালতের একটি রায়কে নস্যাৎ করে এই মামলায় বিচারপতিদ্বয় গীতা হরিহরণ মামলায় রায়ের দৃষ্টান্ত টেনে মায়ের ‘স্বাভাবিক অভিভাবক’ পরিচয়ের পুনরুল্লেখ করেন।

কিছু দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারতীয় গণতন্ত্রকে এখনও শক্ত হাতে ধরে আছে আমাদের মাননীয় বিচারালয়। কিন্তু আদালতের হাতেই আমজনতা যদি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার সব দায় সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে, তবে সঙ্কট গভীর। সমাজের বটতলায় ‘অভিভাবকত্ব’ এবং ‘পৌরুষ’ আজও একই হুঁকোর নল নিয়ে টানাটানি করছে। তার গোড়া ধরে টান দেওয়াটাই আশু প্রয়োজন। স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক ভারতে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে শিক্ষা ও কর্মজীবনের সর্বত্র মায়ের নাম লেখা বাধ্যতামূলক হোক। ফ্রান্স, সুইডেন, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক— এমন অনেক দেশই পেরেছে। আমরা পারি না?

অন্য বিষয়গুলি:

Guardian Meeting Motherhood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy