Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Umran Malik

এক ওভার, ১৪ রান, তবু ছেলেটার সঙ্গে থাকি না হয়

এই এক ওভারে ১৪ রানও না আবার কোনও ‘দেশদ্রোহিতা’ হয়ে আবির্ভূত হয়। বিশেষত, সে ছেলে যদি জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা হয়!

উমরান মালিক।

উমরান মালিক।

অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২২ ০৮:৫৬
Share: Save:

আয়ারল্যান্ডের হাওয়ায় কনকন করছে ঠান্ডা। ফিল্ডাররা সকলে ফুলস্লিভ জাম্পার পরে নিয়েছেন। দেশের হয়ে জীবনের প্রথম ম্যাচে ষষ্ঠ ওভারে বল করার আহ্বান গেল ছেলেটার কাছে।

ভারত-আয়ারল্যান্ড ম্যাচটা দেখতে দেখতে খুব মন দিয়ে জরিপ করছিলাম ছেলেটাকে। বয়স ২২। পরিচয়ে লেখা রয়েছে— রাইট আর্ম ফাস্ট বোলার। ডানহাতি জোরে বোলার।

ফাস্ট! গতিশীল! কিন্তু শুধু ওই শব্দটাতেই যদি সবটুকু বোঝানো যেত! ২০২০-২১ মরসুমে জম্মু-কাশ্মীরের হয়ে সৈয়দ মুস্তাক আলি ট্রফিতে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিজয় হজারে ট্রফিতে খেলে প্রথম শ্রেণির ম্যাচে অভিষেক। সেপ্টেম্বরে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের মামুলি নেট বোলার থেকে মূল দলের বোলার টি নটরাজনের ‘কোভিড বিকল্প’ হিসেবে টিমে ঢোকা। ২০২১ সালের আইপিএলে অভিষেক কলকাতা নাইট রাইডার্সের বিরুদ্ধে। কিন্তু নজরে এসেছিলেন বিরাট কোহলীর রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স ব্যাঙ্গালোরের বিরুদ্ধে এক ওভারে পর পর পাঁচটা ডেলিভারি ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে করে। ওহ্, মাঝখানে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে কোহলীদের টিমের জন্য নেট বোলারও বটে। ২০২২ সালের নিলামে তাঁকে রেখে দিল হায়দরাবাদ। গুজরাতের বিরুদ্ধে ম্যাচে পাঁচ উইকেট নিলেন উমরান। সেই গুজরাত, যারা কালক্রমে ২০২২ সালের আইপিএল ট্রফিটা নিয়ে যাবে। কিন্তু উমরানকে ধরে রাখে কে! ২০২২-এর আইপিএলে ১৪ ম্যাচে ২২ উইকেট। আইপিএলের বোলারদের মধ্যে চতুর্থ সর্বোচ্চ। হায়দরাবাদ দলে সর্বোচ্চ। গড় ২০.১৮। ইকনমি রেট ৯.০৩। ২০২২ সালের আইপিএলের ‘ইমার্জিং প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ও হলেন ডেল স্টেনের এই ছাত্র।

ইমার্জিং। উদীয়মান। সেই উদীয়মান উমরানকে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে পাঁচ ম্যাচের হোম সিরিজে ভারতীয় দলে নেওয়া হল। তবে প্রথম দলে জায়গা হয়নি। স্বাভাবিক। অধিকাংশ সময়েই প্রতিশ্রুতিমান বা প্রতিশ্রুতিমতীদের মূল দলের সঙ্গে রেখে গোটা ক্যাম্পের রাহান-সাহান, হাল-হকিকত সম্পর্কে অবহিত করানো হয়। সইয়ে নেওয়ানো হয়। মহীরুহদের সঙ্গে ড্রেসিংরুমে থাকাও তো একটা গুরুকুলে থাকার মতো শিক্ষা।

রশিদ খান এবং হার্দিক পাণ্ড্যর সঙ্গে উমরান মালিক।

রশিদ খান এবং হার্দিক পাণ্ড্যর সঙ্গে উমরান মালিক। ছবি: আইপিএল

তার পরেই আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম দলে। ভুবনেশ্বর কুমারের হাত থেকে ইন্ডিয়া ক্যাপ। বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচের ষষ্ঠ ওভারে অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ড্য বল তুলে দিলেন উমরানের হাতে। যাঁকে দেশের ক্রিকেটবোদ্ধা তথা দেশভক্ত জনতার একাংশ ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের শোয়েব আখতারের ‘জবাব’ হিসেবে ভেবে ফেলেছে! ছোটবেলায় ব্যাটিংটাই করতেন। পরে শখে বোলিং শুরু করেন জম্মুর গুজ্জরনগর এলাকার ফলবিক্রেতা আব্দুল রশিদ মালিকের পুত্র। দিনভর ক্রিকেট, ক্রিকেট এবং ক্রিকেট। বাবা কখনও বাধা দেননি। বরং সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। ক্রমে এলাকায় নাম ছড়িয়ে পড়ে উমরানের। পাড়াতুতো ব্যাটাররা তাঁর বল খেলতে ভয় পেতে শুরু করে। এলাকায় নাম হয়ে যায় ‘গজনি’। আমির খানের ছবি। যেখানে হাতে-পায়ে-পেটে-পিঠে গুলি গুলি পেশি সমন্বিত আমির প্রেমিকার হত্যার বদলা নিতে একাই ঠেঙিয়ে ঢিট করেন ভিলেনকুলকে। তেমনই হয়ে ওঠেন উমরান। একাই একশো! তবে দেশীয় ক্যানভাসে উঠে আসার পর তাঁর নাম হয়েছে ‘জম্মু-কাশ্মীর এক্সপ্রেস’। কে জানে, সেখান থেকেই হয়তো শুরু হয়েছে ওয়াঘায় আটারি সীমানার ওপারে ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’-এর সঙ্গে তাঁর তুলনা! যে তুলনা বাড়াবাড়ি বললেও কম বলা হয়। যে তুলনা, প্রায় তুলনারহিত ভাবে এই বাইশের তরুণের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে অনাবশ্যক এবং অবাঞ্ছিত চাপ।

সেই চাপই কি তাঁকে আয়ারল্যান্ডের কনকনে হাওয়ায় জীবনের প্রথম আন্তর্জাতিক ওভারে ওই বোলার্স ব্যাকড্রাইভটা খাওয়াল?

খুব মন দিয়ে জরিপ করছিলাম ছেলেটাকে। ঝকঝকে মিষ্টি হাসি। হাসলে গালে বোধহয় প্রায় অদৃশ্য টোলও পড়ে একটা। একেবারেই ফাস্ট বোলার সুলভ নয়। গলায় রুপোর মোটা হার। পুরোপুরিই ফাস্ট বোলার সুলভ। উরুর কাছে ট্রাউজার্সটা সামান্য গুটিয়ে নেন দৌড় শুরুর আগে। তার পর রান আপ শুরু করেন। এবং অতঃপর গোলার মতো ডেলিভারি।

উমরান মালিকের বাবা ফলবিক্রেতা আব্দুল রশিদ মালিক।

উমরান মালিকের বাবা ফলবিক্রেতা আব্দুল রশিদ মালিক। ফাইল ছবি।

প্রথমটা ইয়র্কার। ঘণ্টায় ১৪৮ কিলোমিটার। এক রান। দ্বিতীয় ডেলিভারি ঘণ্টায় ১৪৫ কিলোমিটার। এক রান। তৃতীয় ডেলিভারি বাউন্ডারি। চতুর্থ ডেলিভারি ঘণ্টায় ১৪০ কিলোমিটার। পঞ্চম ডেলিভারি আবার বাউন্ডারি। ষষ্ঠ ডেলিভারি একেবারে ছক্কা! এক ওভারে ১৪ রান। হার্দিক আর বল করতে ডাকেননি উমরানকে। ম্যাচে ভারত জিতেছে। আতুপুতু আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে অবশ্য জেতারই কথা ছিল। এই সিরিজগুলোকে কূটনীতির ভাষায় বলতে হয় ‘সিবিএম’। কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজার্স। ঢলঢলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলে এবং জিতে আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে নেওয়া এবং তার পর সেই বর্ধিত আত্মবিশ্বাস সম্বল করে ফ্ল্যাশব্যাকে নিরামিষ ক্ষমতার টিমের বিরুদ্ধে সাফল্য ভাবতে ভাবতে বাঘা বিপক্ষের বিরুদ্ধে মাঠে নামা।

সম্ভবত সেই কারণেই উমরানকেও অভিষেক করানো হয়েছিল আপাতদৃষ্টিতে দুধ-ভাত আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে। যাতে আগুনে গতিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নেহাতই খোকাদের দুমড়ে দেওয়া যায়। পাশাপাশিই তরুণ পেসারকে খানিকটা ঠেলে দেওয়া যায় স্বপ্নময় অভিষেকের দিকে।

হল না। সম্ভবত স্নায়ুর চাপ। সম্ভবত দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হওয়ার মুহূর্তের বিস্ফোরণজনিত অভিঘাতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারা। সম্ভবত এক্সপ্রেস গতিতে বিপক্ষের ব্যাটারকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার ফাস্ট বোলার সুলভ বাসনা। বাইশের তরুণের বোঝা বাকি ছিল, এ তাঁর জন্য ভারতীয় আবহাওয়ায় তৈরি উইকেট নয়। যেখানে সুইং তুলনায় কম। তাঁর বীভৎস গতিতেও যে সুইং খানিক নিয়ন্ত্রণে থাকে। আয়ারল্যান্ডের কনকনে এবং স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়ায় পাঁচ ওভারের পুরনো বল সুইং করে অনেক বেশি। গতির সঙ্গে নিয়ন্ত্রণটা জরুরি। সম্ভবত আরও বেশি জরুরি। নইলে তাঁর একটা বল ভয়াবহ সুইং করে অনসাইড দিয়ে বেরিয়ে যেত না। বা পঞ্চম ডেলিভারিতে যে বোলার্স ব্যাকড্রাইভটা উমরান খেলেন (বলা হয়, তা গলি ক্রিকেটের পেসারের পক্ষেও সবচেয়ে অপমানজনক), সেটাও সম্ভবত হত না।

সতীর্থদের সঙ্গে।

সতীর্থদের সঙ্গে। ছবি: বিসিসিআই

আশ্চর্য নয় যে, এক ওভারে ১৪ রান দেওয়ার পর উমরান দৃশ্যতই ভেঙে পড়লেন। তাঁর কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন সহ-খেলোয়াড়েরা। আর ম্যাচের শেষে অধিনায়ক হার্দিক বললেন, ‘‘আইপিএল ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ও দারুণ খেলেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়, ও একটু পুরনো বলে বেশি স্বচ্ছন্দ হবে। এটা নিয়ে আমি ওর সঙ্গে কথাও বলেছি। আসলে আয়ারল্যান্ড এত দুর্ধর্ষ ব্যাট করছিল যে, আমাদের নিয়মিত বোলারদেরই দ্বারস্থ হতে হল। আশা করি, পরের ম্যাচগুলোয় উমরান আরও বল করার সুযোগ পাবে।’’

অর্থাৎ, উমরান নতুন বলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছেন। পুরনো বলেই তিনি তুলনায় বেশি স্বচ্ছন্দ হবেন। অর্থাৎ, তিনি এখনও ‘নিয়মিত’ বোলার নন। এবং অর্থাৎ, ওই এক দুঃস্বপ্নময় ওভারেই উমরানের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার সঙ্কটাপন্ন হয়ে পড়েনি।শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ঠিকই তো! ঠিকই তো বলেছেন অধিনায়ক। এই ভরসার হাতটা তো ছেলেটার কাঁধে রাখা উচিত।

আরও মনে হচ্ছিল, ছেলেটার সঙ্গে থাকা উচিত সারা দেশের। ছেলেটার নাম ‘উমরান’ বলেই থাকা উচিত। যে দেশে এক রাজনৈতিক দলের নেতা বিনা দ্বিধায় লতা মঙ্গেশকরের শেষ শয্যায় শাহরুখ খানের অন্তিম ‘দুয়া’কে থুতু ছেটানো বলে দেগে দিতে পারেন, সে দেশে এই এক ওভারে ১৪ রানও না আবার কোনও ‘দেশদ্রোহিতা’ হয়ে আবির্ভূত হয়। বিশেষত, সে ছেলে যদি জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দা হয়! এক ওভার, ১৪ রান। আন্তর্জাতিক অভিষেক একবারই আসে জীবনে। স্বপ্নের অপমৃত্যু। জানি। তবু ছেলেটার স্বপ্নের সঙ্গে আরও কিছু পথ হাঁটি না হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Umran Malik IPL Cricket Fast Bowler
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy