—প্রতীকী চিত্র।
নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে নারীদের লক্ষ্মীর ভান্ডার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তৃণমূলের ভোটশক্তির অন্যতম উৎস বলা হচ্ছে নারীদের, যাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডার তথা নানা সমাজকল্যাণমূলক ভাতার প্রাপক। বিরোধীরা কেউ নারীদের আরও বেশি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, কেউ প্রাপকদের ‘আত্মমর্যাদাহীন ভিখারি’ বলছেন। ভাবা প্রয়োজন, তুরুপের তাসটি কী এবং কেন?
নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে, ২০১৯-এর থেকে ২০২৪-এ প্রতি হাজার পুরুষে নারী ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও মেয়েদের ভোটে অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক। রাজ্যে যে ২৫টি লোকসভা কেন্দ্রে পুরুষের চেয়ে নারী-ভোটার ছিলেন বেশি, তার মধ্যে তৃণমূল জিতেছে ১৫টি। ২০১৯-এ লোকসভা ভোটে ২২-১৮ আসনের উনিশ-বিশ টক্কর হয়েছিল তৃণমূল-বিজেপির। কিন্তু সে বছরও ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভলপিং সোসাইটিজ়’-এর তত্ত্বাবধানে ‘লোকনীতি সংস্থা’ ভোট-পরবর্তী সমীক্ষায় জানায়, তৃণমূল পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের ভোট পেয়েছে বেশি।
কোনও নির্দিষ্ট জাতি, বর্ণ বা লিঙ্গগোষ্ঠীর জন্য রাজনৈতিক দল যখন নানা পদক্ষেপ করে তখন বোঝা যায়, ভোটার হিসেবে এই গোষ্ঠী ‘দৃশ্যমান’। মুসলমান বা দলিতরা নানা দলের ভোটব্যাঙ্ক হয়েছেন নানা রাজ্যে। কিন্তু একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত রাজনৈতিক ইস্তাহারে নারী-ভোটারকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস স্পষ্ট ছিল না। পরিবারের পিতৃপ্রতিম পুরুষ যে দলের ভোটার, নারীরাও সে দলেই ভোট দেবেন, এ-ই ছিল দস্তুর। অথচ এখন ‘নিঃশব্দ ভোটার’ হিসেবে নারীরা বড়সড় বদল ঘটাচ্ছেন ইভিএম-এ। ‘নিঃশব্দ’, কারণ ঘোমটা ভেদ করে এঁদের মত দর্শাতে এক্সিট পোল প্রায়শ ব্যর্থ হয়।
এ রাজ্যে মেয়েরা সবুজশ্রী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী ইত্যাদি পেয়ে থাকেন। তৃণমূলের আরও দু’টি সফল চাল: স্বাস্থ্যসাথী নামক জনস্বাস্থ্য বিমা কার্ডটি বাড়ির মহিলার নামে দেওয়া। স্বামী-পুত্র বিমার সুবিধা পাবেন, কিন্তু তাঁদের ব্যবহার করতে হবে স্ত্রী/মায়ের নাম। দ্বিতীয়, লক্ষ্মীর ভান্ডার নামে মেয়েদের মাসোহারার ব্যবস্থা। ২৫-৬০ বছর বয়সি মেয়েরা মাসিক ১০০০ টাকা (অসংরক্ষিত) বা ১২০০ টাকা (তফসিলি) পান। এই মাসোহারার আশু কারণ শিক্ষা বা স্বাস্থ্য নয়, এমনকি বিয়ের মতো পিতৃতান্ত্রিক কারণও দেখা যাচ্ছে না (যেমন রূপশ্রী-তে)। অতএব একে ‘ঘুষ’ বা ‘ভিক্ষা’ বলে হেয় করা সহজ।
প্রসঙ্গত, এই প্রচেষ্টা বর্তমানে নানা রাজনৈতিক দলেই দেখা যাচ্ছে। ২০২৩-এ তামিলনাড়ুতে এম কে স্ট্যালিন এবং কর্নাটকে কংগ্রেস মেয়েদের মাসোহারা চালু করেন। সেই সময় এআইসিসিটিইউ নামক শ্রম সংগঠন তাদের ওয়েবসাইটে প্রশ্ন রেখেছিল, এটা কি দারিদ্র-নিবারক ভাতা না গৃহশ্রমের মজুরি? এই প্রশ্নের কারণ, স্ট্যালিন নিজেই বার বার বলেছিলেন, এ দান নয়, মেয়েদের প্রাপ্য।
শ্রেণি-অসাম্যের মতো লিঙ্গ-অসাম্যও যে বাস্তব, সেই বোধ থেকে শ্রম আন্দোলন দূরে থেকেছে বহু দিন। শ্রেণি-রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়-রাজনীতিকে মেলাতে ছিল অনীহা। পুরুষ-শ্রমিকের কাজের জগৎ কারখানাতেই শেষ, নারী-শ্রমিকের কাজ ঘরে ও বাইরে। কিন্তু ঘরের অসাম্যকে ‘অসাম্য’ না বলে ‘ঘরোয়া সমস্যা’ বলার চল ছিল। অস্পষ্ট ভাবে হলেও, এই অসাম্যের ক্ষতকে তাক করেছে নানা সংসদীয় দল। দিল্লিতে আপ বা মধ্যপ্রদেশে বিজেপিও (লাডলি বহেনা) মেয়েদের মাসোহারার ব্যবস্থা করেছে। এই প্রবণতা আরও বাড়বে।
এই প্রতিটি যোজনার থেকে তৃণমূলের লক্ষ্মীর ভান্ডার আলাদা একটি ক্ষেত্রে। অন্য যোজনাগুলিতে টাকা পান পরিবার-পিছু এক জন। লক্ষ্মীর ভান্ডার পান পরিবারের একাধিক জন। তবে সরকারি বেতন, পেনশন ইত্যাদির প্রাপক ও ট্যাক্সদাতার পরিবারের মেয়েরা এই টাকা পান না। অন্য রাজ্যেও পারিবারিক আয় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ লক্ষ্য: নিম্নবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত নারী-ভোটার। ফল হাতেনাতে।
প্রচারে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারী বলেছিলেন, হাজার টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার করবেন। বাম সমর্থকরা ভোটের ফলের পর লক্ষ্মীর ভান্ডারকে ‘ভিক্ষা’ বলতে শুরু করতেই রাজ্য সম্পাদক কড়া ধমক দিয়েছেন। অর্থাৎ পাঁচন গিলতে হচ্ছে সবাইকে, কিন্তু কেন গিলছে, তা নিয়ে বোঝাপড়ার অভাব রয়েছে। তৃণমূলের নিজস্ব বক্তাকেও টিভিতে দেখা যায়, লক্ষ্মীর ভান্ডারকে কটাক্ষ করা হলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে উন্নয়নের কথা বলতে। সরকারি কর্মচারী ডিএ না পেলে লক্ষ্মীর ভান্ডারকে দোষ দেন, যেন ডিএ প্রাপ্য কিন্তু লক্ষ্মীর ভান্ডার উৎকোচ। ভোটে হারলে বিজিত বলেন, মেয়েরা ‘ক্রীত’ হয়েছেন। অর্থাৎ টাকা মেয়েরা পাচ্ছেন, কিন্তু সেই হক সামাজিক ভাবে মানা হচ্ছে না।
যখন এর সপক্ষে বলা হচ্ছে, তখনও ধরনটা গোলমেলে। বাম প্রার্থী বলেছেন, তাঁরা লক্ষ্মীর ভান্ডারের বিরোধী নন, কিন্তু ভেবেছিলেন এই টাকার চেয়ে ছেলে চাকরি পেলে মা বেশি খুশি হবেন। মায়ের বেশি খুশি হওয়া বাধ্যতামূলক কেন? মা কি নিজের অর্থে খুশি হতে পারবেন না? সংসারে শ্রমদান করে যে নারী খাওয়া-পরা পাচ্ছিলেন মাত্র, তাঁকে যখন স্বামী-পুত্রের কাছে যে কোনও প্রয়োজনে নগদের জন্য হাত পাততে হচ্ছে না, তখন খুশি হওয়া তাঁর হক। বাজারের সঙ্গে নিত্য প্রত্যক্ষ বোঝাপড়া করার ক্ষমতা জন্মাচ্ছে তাঁর। সেই টাকা তার পর তিনি যখন সংসারেও খরচ করেন, বা হাসপাতালে যখন তাঁর নামাঙ্কিত স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ব্যবহৃত হয়, তখন তথাকথিত রোজগেরেদের সামনে তাঁর মাথাটি উঁচু হয়। এখানেই সরকারের দায়িত্ব ফুরোয় না। কিন্তু এটুকু ন্যূনতম দায়।
মার্ক্সিস্ট নারীবাদীরা বলেন, নারী ‘রিপ্রোডাক্টিভ শ্রম’ না দিলে বহির্বিশ্বে তথাকথিত ‘প্রোডাক্টিভ শ্রম’ থমকে যাবে। তাই সার্বিক উৎপাদনে অবৈতনিক রাঁধা-বাড়া-কাপড় কাচারও গুরুত্ব আছে। কিন্তু কে দেবে পারিশ্রমিক? বেশির ভাগ তার্কিক এই দায় রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে বলেন। উল্টো পিঠও আছে। এতে গৃহশ্রম লিঙ্গায়িত হতে পারে। বিতর্ক চলছে। আপাতত মজুরি নয়, হাতখরচের তুল্য কিছু টাকা পাচ্ছেন বিত্তহীন নারী।
ভারতের প্রেক্ষাপটে নারীর মাসোহারাকে ‘গৃহশ্রমের মূল্য’ বলা হয় না। বরং ‘কল্যাণকামী পিতৃতন্ত্র’-এর আদর-মাখা কিছু নাম রাখা হয়: গৃহলক্ষ্মী, লাডলি বহেন বা লক্ষ্মীর ভান্ডার। একমাত্র ২০২০-তে কমল হাসন এমএনএম দলের প্রতিশ্রুতিতে ‘গৃহশ্রমের পারিশ্রমিক’ কথাটি ব্যবহার করেন। সম্ভবত এই নীরবতা ইচ্ছাকৃত। প্রাপ্যের হিসাব করতে গেলে আসবে দৈনিক শ্রমঘণ্টা, আসবে শ্রম আইন। দেখা যাবে, প্রাপ্যের তুলনায় প্রাপ্তি যৎসামান্য। বিরোধীদের কাজ হতে পারত সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরি। কিন্তু তাঁদের নিজেদেরই সচেতন হওয়া বাকি। উপভোক্তা মেয়েদের অন্তত বুঝতে হবে, এ দয়া নয়, প্রাপ্যের সামান্য অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy