সরযূর ঘাট সে দিন হাজার হাজার প্রদীপে সেজে উঠেছিল। অযোধ্যা নতুন গিনেস রেকর্ডের অপেক্ষায়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ অযোধ্যায় দীপোৎসবের আয়োজনে ব্যস্ত। গত দীপাবলিতে অযোধ্যার সেই সন্ধ্যায় আরও একটি বিষয় নজরে পড়েছিল— ২০২৫-এর মহাকুম্ভ নিয়ে তখন থেকেই আদিত্যনাথ প্রচারে নেমে পড়েছিলেন। লখনউ থেকে অযোধ্যার সড়ক জুড়ে বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপনে সে সময় থেকেই গোটা দেশকে মহাকুম্ভে আসার আহ্বান। সঙ্গে ‘একটি কিনলে একটি ফ্রি’-এর মতো উত্তরপ্রদেশে যোগী সরকারের কাজের খতিয়ান।
দেশের আনুমানিক ১৪০ কোটি মানুষের মধ্যে যদি ৪০-৪৫ কোটি মানুষ একটি মেলায় গিয়ে হাজির হন, সেখানে রাজনীতির কারবারিরাও যে পসার সাজিয়ে বসবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কুম্ভমেলাও তার ব্যতিক্রম নয়। উত্তরপ্রদেশ সরকারের হিসাবে, এখনও পর্যন্ত ৩৮ কোটি মানুষ কুম্ভে পুণ্যস্নান করেছেন। তিনটি শাহি স্নান হয়ে গিয়েছে। এর পরে ফেব্রুয়ারির শেষে মাঘী পূর্ণিমার শাহি স্নান বাকি। শিবরাত্রিও আসছে। কুম্ভমেলার আরও ২০-২১ দিন বাকি। সব মিলিয়ে কুম্ভমেলায় হাজির পুণ্যার্থীর সংখ্যা ৪৫ কোটি ছাপিয়ে যাবে বলে সরকারি অনুমান।যোগী আদিত্যনাথ হয়তো এটাই চেয়েছিলেন। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির খারাপ ফলের ব্যর্থতা মহাকুম্ভ আয়োজনের সাফল্য দিয়ে ঢেকে দেওয়া। একই সঙ্গে দেশের মানুষের সামনে নিজেকে নতুন ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ হিসেবে তুলে ধরা। দু’বছর পরে, ২০২৭-এ, উত্তরপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচন। সেই বিধানসভা ভোটে জিতলে ‘গোরক্ষপুরের মহারাজজি’ নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরি হিসাবে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদারের দৌড়ে বাকি সবাইকে পিছনে ফেলে দিতে পারেন।
গত ২২ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশ সরকারের গোটা মন্ত্রিসভা যখন সঙ্গমে ডুব দিচ্ছে, তখনই কুম্ভমেলাকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর শুভ মহরত হয়ে গিয়েছিল। এর পরে অমিত শাহ কুম্ভে গিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী কুম্ভে পুণ্যস্নানের জন্য দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিনটিকেই বেছে নিয়েছেন। গত ২৬ বছর ধরে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে জয় বিজেপির অধরা। এর মধ্যে ১১ বছর নরেন্দ্র মোদী দিল্লির প্রধানমন্ত্রীর মসনদে। এ বার সঙ্গমে ডুব দিয়ে দিল্লির বিধানসভা ভোট জয়ের মোক্ষলাভ হবে কি না, তা সময় বলবে। কুম্ভমেলায় বিজেপির আসল লক্ষ্য বৃহত্তর।
বিজেপি-আরএসএস গোটা হিন্দু সমাজকে এককাট্টা করতে যে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর মন্ত্র আওড়ায়, তাতে গত লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের সংবিধান হাতে প্রচার হুল ফুটিয়েছিল। বিজেপিকে দলিত-ওবিসি’বিরোধী প্রমাণ করতে নরেন্দ্র মোদীর ‘অব কি বার, চারশো পার’-এর স্লোগানই ছিল বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার। বিজেপি লোকসভায় চারশোর বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় ফিরলে সংবিধান বদলে দেবে, এই আশঙ্কা ছড়াতে দেরি হয়নি। কারণ বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরাই সে কথা বলছিলেন।
এ বারের কুম্ভমেলা তাই ফের বিজেপির সামনে হিন্দু সমাজকে এককাট্টা করার পরীক্ষা। ব্রাহ্মণ, নিষাদ ও মৌর্য— উচ্চবর্ণ, দলিত, অনগ্রসর এক হয়ে কুম্ভে স্নান করছে, তা তুলে ধরার আয়োজন। মহাকুম্ভের প্রয়াগরাজে যোগী আদিত্যনাথ একটি ছবি নিয়ে বিজ্ঞাপন করছেন। ২০১৯-এর কুম্ভে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাফাই কর্মীদের পা ধুইয়ে দিচ্ছেন— সেই সাফাই কর্মীরা মূলত দলিত বা অনগ্রসর সমাজের মানুষ। বিজেপি এখন মহাকুম্ভে দলিত সাফাই কর্মীদের মধ্যে সংবিধানও বিলি করেছে। উত্তরপ্রদেশ সরকারের বিজ্ঞাপনে রামের পাশে নিষাদরাজের ছবি ব্যবহার করা হচ্ছে। যোগী আদিত্যনাথ প্রয়াগরাজে কুম্ভমেলার সময় নিষাদরাজ পার্কের উদ্বোধন করেছেন। নরেন্দ্র মোদীকে কুম্ভমেলাকে ‘ঐক্যের মহাযজ্ঞ’ বলে তকমা দিয়েছেন। লোকসভা নির্বাচনে দলিত-ওবিসি ভোটের অনেকখানি অংশ বিজেপির থেকে সরে যাওয়ার পরে এ আসলে ফের হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করতে মোদী-যোগীর মহাযজ্ঞ।
হিন্দুত্বের রাজনীতি কোনও ভাবেই হিন্দু-মুসলিমের মেরুকরণ ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। তাতে সংখ্যালঘু মুসলিম সমাজের স্বঘোষিত প্রতিনিধিদের একাংশই নিয়ম করে ইন্ধন জুগিয়ে থাকেন। এ বার যেমন মৌলানা শাহবুদ্দিন রজ়বী বরেলভি নামে এক ধর্মগুরু দাবি করেছেন, কুম্ভমেলা যে জমিতে হচ্ছে, তার ৫৫ বিঘা এলাকাই ওয়াকফের সম্পত্তি। মুসলিমদের হৃদয় অনেক বড়। তাই এতে কেউ আপত্তি করেননি। সর্বভারতীয় আখড়া পরিষদ পাল্টা দাবি তুলেছে, কুম্ভমেলায় মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনও মুসলিম যাতে কুম্ভমেলায় পসরা সাজাতে না পারেন, হিন্দুরা যাতে মুসলিমদের থেকে কিছু না কেনেন, তারও আহ্বান জানিয়েছে পরিষদ।
যোগী আদিত্যনাথ হয়তো এটাই চেয়েছিলেন। তিনি পত্রপাঠ জানিয়ে দিয়েছেন, ওয়াকফ বোর্ড আসলে জমি মাফিয়াদের আড্ডা। উত্তরপ্রদেশে ওয়াকফের নামে যে সব জমি দখল করা হয়েছে, তাঁর সরকার সেই জমির প্রতিটি ইঞ্চি পুনরুদ্ধার করবে। তাঁর বক্তব্য, অতীতে দেশের বহু মানুষ অত্যাচারের মুখে ইসলাম ধর্মগ্রহণে বাধ্য হয়েছিলেন। তাঁরা এখনও ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে গর্ববোধ করেন। তাঁদের কেউ যদি রীতিনীতি মেনে গঙ্গা স্নান করতে আসেন, তাতে কোনও বাধা নেই। তবে কুম্ভমেলায় জমির দাবি তোলা চলবে না।
সাধুসন্তদের একাংশ এই মহাকুম্ভের রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টার বিরুদ্ধে। তাঁদের মতে, ‘কুম্ভ আসলে ভারতের আধ্যাত্মিক ঐক্যের প্রতীক। তা নিয়ে যে কোনও দলেরই রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টা নিন্দনীয়’। বিজেপি আমলে হিন্দু ধর্মের যে কোনও অনুষ্ঠানেরই এমন রাজকীয় আয়োজন হয়, যে তার সঙ্গে ভিড়ের রেকর্ড তৈরির চেষ্টাও জুড়ে যায়। যত ভিড় বাড়ে, ততই ভিভিআইপি-দের জন্য পৃথক ব্যবস্থা তৈরির প্রয়োজনও বাড়ে। নতুন নতুন বিজ্ঞাপনী মোড়কও তৈরি হয়। এ বার যেমন প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ মকর সংক্রান্তি, মৌনী অমাবস্যার পুণ্য স্নানকে ‘অমৃত স্নান’ বলে তকমা দেওয়া হচ্ছে কেন? মৌনী অমাবস্যার ‘অমৃত স্নান’-এর সময় হুড়োহুড়িতে পদপিষ্ট হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু সেই ‘ভিভিআইপিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা’ তৈরি করতে যাওয়ারই পরিণাম বলে বিরোধীদের অভিযোগ।
এটা ঠিক, মহাকুম্ভে মৌনী অমাবস্যার দুর্ঘটনা যোগী আদিত্যনাথকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তাঁর কুম্ভ আয়োজনের সাফল্যের দাবিতে খুঁত ধরা পড়েছে। কিন্তু বিরোধীদের সামনে বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতির সামনে বরাবরই যে প্রশ্ন ওঠে, এ বারও সেই প্রশ্ন উঠেছে— কুম্ভকে কেন্দ্র করে বিজেপির রাজনৈতিক ফয়দা তোলার চেষ্টার কি নিন্দা করা হবে? না কি বিরোধীরাও রাজনৈতিক ফয়দা তুলতে গঙ্গায় ডুব দেবেন?
কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে প্রশ্ন তুলেছিলেন, গঙ্গায় ডুব দিয়ে দারিদ্র দূর হবে কি না? বলেই তিনি মানুষের আস্থায় আঘাত দেওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদবরা কুম্ভের অব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। বিজেপি-আরএসএস যে ভাবে কুম্ভমেলাকে সামনে রেখে আধ্যাত্মিক ঐক্য ও হিন্দু সমাজের ঐক্যকে গুলিয়ে দিতে চাইছে, তার পাল্টা রণকৌশল কী হবে, এখনও বিরোধীদের জানা নেই।
ভুললে চলবে না, ২০০১ সালে স্বয়ং সনিয়া গান্ধী কুম্ভমেলার সময় ইলাহাবাদের সঙ্গমে গঙ্গায় ডুব দিয়েছিলেন। তখন অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে এনডিএ সরকার ক্ষমতায়। ২০০৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে সনিয়ার সেই সিদ্ধান্তের পিছনে দুটো কারণ ছিল। এক, তাঁর নিজের বিদেশি পরিচিতি নিয়ে বিজেপির তির ভোঁতা করে দেওয়ার চেষ্টা; দুই, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ খারিজ করতে নরম হিন্দুত্বের পথে হাঁটা। গঙ্গা স্নানের পরে সনিয়ার হাতে বাঁধা লাল সুতোর ছবি নিয়ে সে সময় চুলচেরা রাজনৈতিক বিতর্ক হয়েছিল। কংগ্রেসে সে সময় সনিয়া গান্ধীর উপদেষ্টারা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, জওহরলাল নেহরু কুম্ভ স্নানে যেতেন। ইন্দিরা গান্ধীও কুম্ভমেলায় আনন্দময়ী মায়ের শিবিরে হাজির হতেন।
নরেন্দ্র মোদী, যোগী আদিত্যনাথের কুম্ভ-রাজনীতির মোকাবিলায় কি তা হলে নরম হিন্দুত্বই একমাত্র কৌশল? ‘শিবভক্ত’ রাহুলও কি এ বার তাঁর মায়ের মতো মহাকুম্ভের সঙ্গমে ডুব দিতে যাবেন?
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)