সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের সময় নয়াদিল্লির কিছু বরিষ্ঠ আইএএস আধিকারিক অভিমত প্রকাশ করেছেন: পশ্চিমবঙ্গ-সহ কোনও কোনও রাজ্য তাদের আর্থিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন জনমোহিনী প্রকল্পে এতটাই লাগামছাড়া খরচ করছে যে, আশঙ্কা হয়, অচিরেই তাদের দশা শ্রীলঙ্কার মতো হবে। এই বরিষ্ঠ রাজপুরুষদের মতো অনেক সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালিও আজকাল মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর্থিক আগ্নেয়গিরির শিখরে বসে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে খয়রাতি চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার বুঝতে পারছে না, যে কোনও দিন অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গিয়ে সরকারের পুরো আর্থিক ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়তে পারে।
অনুমান করা যায়, এই আশঙ্কার একটা কারণ অনুদান-ভিত্তিক সামাজিক প্রকল্পে রাজ্য সরকারের অভূতপূর্ব ব্যয়বৃদ্ধি। অন্য সম্ভাব্য কারণ, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের অপারগতা। সবার উপরে, বিপক্ষ দলগুলির সরকার-বিরোধী প্রচার তো আছেই। এই সব মতামত, ধারণা বা প্রচারের কতটা ঠিক, আর কতটা কল্পিত?
বিরোধীরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার আয়ের তুলনায় এতটাই বেশি ব্যয় করছে যে, অদূর ভবিষ্যতে কর্মচারীদের বেতন, অবসরকালীন সুযোগ-সুবিধা বা ঋণ-ফেরতের কিস্তির মতো দায়বদ্ধ খরচগুলো সামলাতেও সমস্যা দেখা দেবে। যে হেতু রাজ্য সরকার টাকা ছাপাতে পারে না, তাই তার আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হলে, ঋণ নিয়ে ফাঁকটা পূরণ করতে হয়। কাজেই, বিরোধী অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার করার জন্য সরকারি ঋণের দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার দিকে তাকাতে হবে।
কিন্তু শুধু ঋণের দিকে তাকালে চলবে না, ঋণশোধের ক্ষমতা কতটা আছে, সেটাও দেখতে হবে। যার ঋণশোধের ক্ষমতা বেশি, সে বেশি ঋণ নিতেই পারে। এখন, ঋণশোধের ক্ষমতা নির্ভর করে সরকারের কর আদায়ের উপর, কর আদায় নির্ভর করে আর্থিক লেনদেনের উপর। আর্থিক লেনদেন বাড়া-কমার সঙ্গে যে হেতু রাজ্যের মোট আয় সরাসরি ভাবে জড়িত, তাই রাজ্যের মোট আয়ের দিকে তাকালে ঋণশোধের ক্ষমতার ভালই আন্দাজ পাওয়া যাবে। অতএব শুধু ঋণ নয়, আমরা ঋণ-আয় অনুপাতের দিকে তাকাব। প্রত্যেক বছরের মার্চ মাসে রাজ্যের মোট বকেয়া ঋণকে সেই আর্থিক বছরের মোট আয় দিয়ে ভাগ করব। অর্থশাস্ত্রে এটাই ঋণগ্রস্ততা বোঝার চালু রীতি। বামফ্রন্ট সরকারের শেষ দুটো বছর থেকে শুরু করে একেবারে ২০২১ অবধি আমাদের প্রকৃত বিচার্য সময়। ২০২২-এর সংখ্যাটি এ বছরের বাজেট-অনুমিত।
সংলগ্ন রেখাচিত্রটির দিকে তাকিয়ে একাধিক মন্তব্য করা প্রয়োজন। প্রথমত, বাম আমলের তুলনায় বর্তমান আমলে পশ্চিমবঙ্গের ঋণ-আয় অনুপাত ২০১৯ অবধি মোটামুটি ধারাবাহিক ভাবে কমেছে। ২০২০ এবং ২০২১ সালে কিছুটা যে বেড়েছে, সেটা স্পষ্টতই অতিমারির কারণে। কিন্তু এই বৃদ্ধিকে কিছুতেই লাগামছাড়া বলা যাবে না। মোটের উপর বলা চলে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। বামফ্রন্ট আমলে যেমন ছিল, তার তুলনায় পরিস্থিতির বরং কিছুটা উন্নতিই হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই উন্নতির পিছনে ফিসকাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট (এফআরবিএম) আইনের একটা ভূমিকা যে আছে, তাতে সন্দেহ নেই। এফআরবিএম আইন রাজ্যগুলিকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাদের ঋণ-আয় অনুপাত কমাতে সাহায্য করেছিল। এক বছরে মোট আয়ের আড়াই শতাংশের বেশি ঋণ কোনও রাজ্য নিতে পারত না। সম্প্রতি কোভিডের কারণে সেই নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু এফআরবিএম আইনই হোক বা রাজ্যের নিজস্ব আর্থিক শৃঙ্খলা, ফল একটাই— আয়ের তুলনায় ঋণের পরিমাণ কমে যাওয়া।
তৃতীয়ত, প্রশ্ন উঠবে, ঋণ-আয় অনুপাতের নিরিখে ভারতের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের অবস্থান ঠিক কোথায়? ভারতের অধিক ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলির তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ অবশ্যই আছে। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, তালিকাটি কিন্তু নেহাত ছোট নয়, অর্থাৎ এই ঈর্ষা অনুদ্রেককারী তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের মতো আরও অনেকেই আছে। তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের থেকেও প্রতিকূল ঋণ-আয় অনুপাতের রাজ্য পঞ্জাব (৪৭.০৪), রাজস্থান (৪০.৮৬) বা উত্তরপ্রদেশ (৩৮.৮৬) যেমন আছে, তেমনই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের থেকে কম কিন্তু কাছাকাছি ঋণ-আয় অনুপাতের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ (৩৬.২২), বিহার (৩৪.৪৯), ত্রিপুরা (৩২.৪৭), ঝাড়খণ্ড (৩২.৩১), কেরল (৩১.১৪), হরিয়ানা (৩০.৫৯), মধ্যপ্রদেশ (৩০.৩৬)।
এই তালিকা দিয়ে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের ঋণগ্রস্ততার কোনও মান্যতা দাবি করছি না। কিন্তু দুটো জিনিস এখানে বলব। এক, এই সরকার একটা বিপুল পরিমাণ ঋণ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিল। যে হেতু আজকের ঋণের বোঝা বহুলাংশে নির্ভর করে গত কালের ঋণের উপর, তাই বারো বছরে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত ঋণ-আয়ের অনুপাত যে ১৫-১৬ শতাংশ-বিন্দু কমানো গিয়েছে, সেটা কম কথা নয়। দুই, বাকি ভারতের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে জমি-প্রতি-বসবাসকারী-মানুষের হার তিন গুণেরও বেশি। মানুষের সংখ্যা বেশি হলে সরকারি পরিষেবার খরচও বেড়ে যায়। অতএব ইচ্ছা থাকলেও খরচ যথেষ্ট পরিমাণে কমানো যায় না।
ঋণগ্রস্ত থাকার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল প্রতি বছর মোট খরচের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পুরনো ধার এবং সেই ধারের উপর সুদ মেটাতে চলে যায়। এই অংশটা উন্নয়নের কাজে লাগে না। ২০২২ সালের বাজেটে দেখা যাচ্ছে যে, মোট খরচের ২৩.৯৫% পুরনো ধার এবং তার উপর সুদ মেটাতে চলে যাচ্ছে। অন্য ভাবে দেখলে, নতুন যে ধার নেওয়া হচ্ছে তার ৮৯.৩২% চলে যাচ্ছে পুরনো ধার এবং সুদ মেটাতে। তা সত্ত্বেও চল্লিশ হাজার কোটি টাকার বেশি— মোট খরচের ১৩.৮৭%— লক্ষ্মীর ভান্ডার, কৃষকবন্ধু, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, শস্যবিমা ইত্যাদি তেরোটি উন্নয়ন-প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়েছে। এ ছাড়াও একশো দিনের কাজ, মিড-ডে মিল-এর মতো আরও কিছু পুরনো কল্যাণমূলক প্রকল্পের খরচ কৃষি, শিক্ষা ইত্যাদি দফতরের বরাদ্দে ঢুকে আছে। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, ধার শোধ করার পরেও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্যে সরকার নানা রকম প্রকল্পে মোটা টাকা খরচ করছে। আবার একই সঙ্গে ঋণ-আয় অনুপাতও কমাচ্ছে। এর পাটিগণিতটা কী?
সরকারের রাজস্ব আদায় কিছুটা বেড়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই দিয়ে বাজেট পাটিগণিতের পুরোটা ব্যাখ্যা করা যাবে না। সত্যিটা হল, ধার শোধ করতে গিয়ে এবং গরিব মানুষের জন্যে নানা রকম প্রকল্পে টাকা বাড়াতে গিয়ে সরকারকে কিছু কিছু খাতে খরচ কমাতে হয়েছে। স্থায়ী নিয়োগের বদলে বহু ক্ষেত্রে চুক্তি-কর্মীদের দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এর ফলে যেমন কর্মচারীপিছু খরচ কমছে, তেমনই এক জন স্থায়ী কর্মীর জায়গায় একাধিক চুক্তি-কর্মীকে কাজ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।
আর একটা খরচ বাঁচানোর জায়গা মহার্ঘ ভাতা। কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা না পাওয়া নিয়ে সরকারি কর্মচারীদের যথেষ্ট ক্ষোভ আছে। তাই ব্যাপারটা তলিয়ে বিচার করা দরকার। ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ চালু হওয়ার আগে এক কিস্তি মহার্ঘ ভাতা দিতে মাসে ২৫ কোটি টাকা লাগত। ষষ্ঠ বেতন কমিশনে মূল বেতন বেড়েছে ২.৫৭ গুণ, ফলে এক কিস্তি মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার মাসিক খরচও সেই অনুপাতে বেড়ে হওয়া উচিত ৬৪.২৫ কোটি টাকা— অর্থাৎ, বছরে ৭৭১ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে অবশ্য স্থায়ী পদে লোক নিয়োগ কমেছে, ফলে ধরে নিচ্ছি, এক কিস্তি মহার্ঘ ভাতা দিতে বছরে ৭৫০ কোটি টাকার বেশি লাগবে না। কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের তুলনায় রাজ্য সরকারের কর্মচারীরা ৩১ কিস্তি মহার্ঘ ভাতায় পিছিয়ে আছেন। পুরোটা দিতে গেলে আমাদের হিসাব অনুযায়ী সরকারের বার্ষিক খরচ হবে ২৩,০০০ কোটিরও বেশি। যদি এই খরচটা করা হত, পিছিয়ে পড়াদের জন্য কল্যাণমূলক খাতে যে ৪০,০০০ কোটি বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটা অর্ধেকেরও বেশি কমে যেত। সেটা ঠিক হত, না ভুল, তা বিচার করার জায়গায় বর্তমান প্রতিবেদক নেই। সেই বিচারটা একমাত্র একটা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই করতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy