Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
খারাপ কিছু ঘটতে পারে, জানলে কতখানি সতর্ক হওয়া ভাল
Car Insurance Policy

বিমা করাবেন নাকি?

গাড়ি নিতে গেলে একটা কার ইনশিয়োরেন্স পলিসিও নিতে হবে, তার তিনটে অপশন আছে— এক, প্রিমিয়াম ৫০০ টাকা। দুই, প্রিমিয়াম ১৫০০ টাকা, আর তিন, প্রিমিয়াম ৫,০০০ টাকা।

অমিতাভ গুপ্ত
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৮:২৯
Share: Save:

আপনি তো ডেঞ্জারাস লোক মশাই!” গোপালের দোকানে ঢুকে শিবুদাকে দেখতে পেয়েই বলল শিশির। মাসছয়েক বেপাত্তা থাকার পর আজই গোপালের দোকানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন শিবুদা। গোপাল খাতির করে ডাবল ডিমের অমলেট ভেজে দিয়েছে। তরিবত করে খাচ্ছিলেন শিবুদা— শিশিরের আচমকা আক্রমণে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে মুচকি হাসলেন।

তপেশ আর সূর্যের সপ্রশ্ন চাহনির উত্তরে শিশির বলল, “এ দিকে শিবুদার পাত্তা নেই, ও দিকে আমি আর ঋতুপর্ণা একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। শেষে ইমেল করলাম। তারও কোনও উত্তর নেই। আজ দেখছি, আমার সেই প্রশ্ন নিয়েই উনি ফেসবুকে ভোটাভুটি করছেন! নিজের ওয়ালে, আবার একটা লং ড্রাইভের গ্রুপেও। সারা দিন তপেশকে খুঁচিয়ে চলেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় নষ্ট করার জন্য, আর নিজের বেলায় এই?”

“কোনটা সময় নষ্ট, আর কোনটা ডিপস্টিক রিসার্চ, সেই ফারাক বোঝার মতো বুদ্ধি তপেশের নেই জানতাম। তুইও ওর দলে নাম লিখিয়েছিস দেখছি,” অমলেট শেষ করে চায়ের কাপটা টেনে নিলেন শিবুদা। “তোর প্রশ্নের উত্তর দু’দিন দেরিতে দিলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। ভাবলাম, প্রশ্নটা যখন করেইছিস, তখন পাবলিক কী বলে, এক বার বাজিয়ে দেখি।”

“এই সুদীর্ঘ গৌড়চন্দ্রিকা ছেড়ে প্রশ্নটা বলবেন, না কি ফেসবুকে দেখে নেব?” ধৈর্য হারাল তপেশ।

“দেখতে পাবি না, তোকে ব্লক করে রেখেছি!” শিশিরের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে শিবুদা বললেন, “প্রশ্নটা হল, শিশির কোনও একটা কার রেন্টাল কোম্পানি থেকে দিনসাতেকের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করতে চায়, নিজেই চালিয়ে ঘুরবে। গাড়ি নিতে গেলে একটা কার ইনশিয়োরেন্স পলিসিও নিতে হবে, তার তিনটে অপশন আছে— এক, প্রিমিয়াম ৫০০ টাকা, কিন্তু কোথাও ধাক্কা লাগলে তোকে ৫০০০ টাকা দিতে হবে; দুই, প্রিমিয়াম ১৫০০ টাকা, ধাক্কা মারলে আরও ২০০০ টাকা; আর তিন, প্রিমিয়াম ৫,০০০ টাকা, কিন্তু যত জোরেই ধাক্কা মারিস, আর কোনও টাকা দিতে হবে না। অ্যাক্সিডেন্ট হবে, তার সম্ভাবনা হাজারে এক। শিশির জানতে চেয়েছিল, কোনটা নেওয়া ঠিক হবে। ওকে উত্তর না দিয়ে প্রশ্নটা ফেসবুকে দিয়ে দিলাম। একটা ছোট সার্ভে হয়ে গেল।”

“এটা নিয়ে এত ভাবার কী আছে? এক্সপেক্টেড কস্ট হিসাব করলেই হয়— প্রিমিয়ামের টাকাটা নিশ্চিত ভাবে দিতে হচ্ছে, তার সঙ্গে অ্যাক্সিডেন্ট হলে যে টাকা দিতে হবে, তাকে অ্যাক্সিডেন্টের প্রোব্যাবিলিটি দিয়ে গুণ করে নে, আর এ দুটো যোগ করলেই পেয়ে যাবি তোর প্রত্যাশিত ব্যয়,” শিবুদার কথা শেষ হতেই বলল সূর্য। “প্রথম অপশনে ৫০০ টাকা প্লাস ৫০০০ গুণ ০.০০১ মানে ৫ টাকা, অর্থাৎ প্রত্যাশিত ব্যয় ৫০৫ টাকা; দ্বিতীয়টায় ১৫০২ টাকা; আর তৃতীয়টায় ৫০০০ টাকা। কোনটা বাছবি, সেটা যাকে বলে একেবারে ‘নো ব্রেনার’।”

“তুই ইতিহাস পড়ানো ছেড়ে অর্থনীতিতে চলে আয়, তোর উন্নতি হবে,” শিবুদা বললেন। “ফেসবুকে যত জন আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশ প্রথম বিকল্পটা বেছেছে। বাকি ৫৫ শতাংশ দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিকল্প। মজার কথা হল, তারা তিনটে বিকল্পের মধ্যে যেটাকে বাছছে, সেটা কেন বাছছে, এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিতীয় আর তৃতীয় বিকল্প বেছে নেওয়া লোকদের মধ্যে এক জনও অ্যাক্সিডেন্টের প্রোব্যাবিলিটির কথা উল্লেখ করেনি। স্পষ্ট ভাষায় বলে দেওয়া ছিল এই প্রোব্যাবিলিটির কথা, তবুও তারা সেটাকে গ্রাহ্যই করেনি। ফলে, প্রত্যাশিত ব্যয়ের হিসাবও কষেনি তারা।

“তবে, মজার গল্প এখানেই শেষ নয়। যত জন উত্তর দিয়েছে, তাদের প্রত্যেককে আমি আর একটা বিকল্প দিলাম— কোনও বিমা না-কেনার বিকল্প। বিমা নেই, ফলে প্রিমিয়ামও নেই— কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে দিতে হবে দু’লক্ষ টাকা। এক্সপেক্টেড কস্ট হিসাব কষে দেখ, এটাই সেরা বিকল্প— দু’লক্ষ টাকা গুণ ০.০০১, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ব্যয় ২০০ টাকা। আগের তিনটে বিকল্পের মধ্যে সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত ব্যয় যেটার, সেই প্রথম বিকল্পের তুলনাতেও এটার প্রত্যাশিত ব্যয় ৬০% কম। প্রথম বারে যারা প্রথম বিকল্পটাকে বাছেনি, ধরে নিলাম তারা প্রোব্যাবিলিটি বোঝে না, তাই প্রত্যাশিত ব্যয়ের হিসাব কষতে পারে না— কিন্তু, যে ৪৫% প্রথম বিকল্প বেছেছিল, তাদের মধ্যে কত জন এই কোনও বিমা না কেনার বিকল্পটাকে বাছল, বল দিকি? এক জনও না। প্রত্যেকে জানিয়ে দিল, যেখানে অ্যাক্সিডেন্ট হলে দু’লক্ষ টাকা দিতে হবে, সেখানে বিমা না করানোটা ঝুঁকির হয়ে যাবে।”

“ভুল কী বলেছে? সবার তো আর আপনার মতো ডলার জমানো নেই যে, দু’লক্ষ টাকা দিতে গায়ে লাগবে না!” ফেসবুকে ব্লক করে রাখাটা শুনে ইস্তক চিড়বিড় করছিল তপেশ, এ বার সুযোগ পেয়েই হুল ফোটাল। কিন্তু শিবুদা আজ সদাশিব মেজাজে— ক্ষমার হাসি হেসে বললেন, “তোর বুদ্ধি নিয়ে যে কথাটা একটু আগে বললাম, সেটা প্রমাণ করে দিলি। দুর্ঘটনার ঝুঁকি তো আছেই— হাজারে এক। কিন্তু, সেই ঝুঁকিটাকে ধরে নিয়েই তো প্রত্যাশিত ব্যয় হিসাব করা হচ্ছে। এ বার বল, প্রথম বারে যারা প্রত্যাশিত ব্যয়ের অঙ্ক কষে প্রথম বিকল্পটা বাছল, তার পরের বারে তারাই আর প্রত্যাশিত ব্যয়ের হিসাব কষল না, এটা ইর‌্যাশনাল নয়?”

এ প্রশ্নের উত্তর যে তিন জনের কাছে মিলবে না, শিবুদা বিলক্ষণ জানেন। প্রশ্নটাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে তিনি একটু চুপ করে রইলেন, তার পর বললেন, “এ সব ক্ষেত্রে উত্তর পেতে হলে এক জনেরই শরণ নিতে হয়— ড্যানিয়েল কানেম্যান। বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স-এর দুনিয়ায় তাঁর আর আমস টভস্কির সবচেয়ে বড় অবদান হল প্রসপেক্ট থিয়োরি। আমাদের বিমার ধাঁধার উত্তর আছে সেখানে। পুরো তত্ত্ব বলব না এখন— আগ্রহ থাকলে পড়ে দেখিস, দুর্বোধ্য কিছু নয়— আপাতত দুটো কথা বললেই যথেষ্ট হবে: এক, কোনও লাভ বা ক্ষতিকে মানুষ তার প্রকৃত সম্ভাবনা দিয়ে বিচার করে না, বরং তার উপরে একটা ‘ডিসিশন ওয়েট’ আরোপ করে— মানে, সেই লাভ বা ক্ষতির সম্ভাবনা কত হতে পারে, তা কল্পনা করে নেয়; এবং দুই, লাভ আর ক্ষতির ক্ষেত্রে মানুষের মাথা দু’ভাবে কাজ করে।

“ধর, তুই একটা লটারির টিকিট কাটতে পারিস, যাতে পাঁচ লাখ টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ; আর তোর প্রিয় কারও একটা অপারেশন হবে, যেখানে অপারেশন টেবিলেই মৃত্যুর সম্ভাবনাও এক শতাংশ। ভেবে বল দিকি, দুটো এক শতাংশের গুরুত্ব কি তোর কাছে সমান? যদি বলিস, টাকার সঙ্গে প্রিয় জনের মৃত্যুর তুলনা হয় না, তা হলে ভাব— কোনও কারণে তোর পাঁচ লাখ টাকা ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা এক শতাংশ। তুই কি চাইবি না যে, দশ হাজার টাকা ধরে দিয়ে সেই ক্ষতির সম্ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে? খেয়াল কর, পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতির এক শতাংশ সম্ভাবনা— তোর প্রত্যাশিত ক্ষতি কিন্তু পাঁচ হাজার টাকা। তুই তার দ্বিগুণ দিতে রাজি। কেন?”

আবারও ড্রামাটিক পজ়। তবে, এ বার অকারণে নয়, গোপাল চা দিয়ে গিয়েছে। শিবুদা দু’হাতের তালুতে চায়ের কাপটা ধরে চুমুক দিয়ে তপেশদের দিকে নজর করেন। তার পর বললেন, “এখানেই ডিসিশন ওয়েটের মহিমা। একই পরিমাণ লাভের সম্ভাবনাকে মানুষ যতখানি গুরুত্ব দেয়, ঠিক সমান পরিমাণ ক্ষতির আশঙ্কাকে গুরুত্ব দেয় তার চেয়ে ঢের বেশি— লস অ্যাভারশনের ধর্ম। কানেম্যান বলছেন, কোনও ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শূন্য হলে তার ডিসিশন ওয়েটও শূন্য; আবার যেখানে ঘটনার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ, সেখানে ডিসিশন ওয়েটও ১০০%। অর্থাৎ, হওয়া এবং না-হওয়া, দু’টি নিশ্চিত প্রান্তে ঘটনার প্রকৃত প্রোব্যাবিলিটি, আর মানুষের মনে সে ঘটনা ঘটার কাল্পনিক সম্ভাবনা মানে ডিসিশন ওয়েট, সমান। কিন্তু, তার মাঝখানে সম্ভাবনার যে অনিশ্চিত অংশ— এক শতাংশ থেকে নিরানব্বই শতাংশ— সেখানে প্রকৃত সম্ভাবনা আর কাল্পনিক সম্ভাবনা আলাদা। এবং, প্রকৃত সম্ভাবনা যখন নিতান্ত কম, তখন ডিসিশন ওয়েট সে তুলনায় বেশ বেশি— কানেম্যানদের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, কোনও ঘটনা ঘটার প্রকৃত সম্ভাবনা যখন ১%, মানুষের মনে তার কাল্পনিক সম্ভাবনা ৫.৫%; দু’শতাংশ প্রকৃত সম্ভাবনার ডিসিশন ওয়েট ৮.১%। অন্য দিকে, যে ঘটনার প্রকৃত সম্ভাবনা খুবই বেশি— ৯৯%— সে ক্ষেত্রে ডিসিশন ওয়েট তুলনায় কম, ৯১%।

“ফেসবুকে যারা আমার প্রশ্নের উত্তরে বিমাহীন বিকল্পটি বাছতে রাজি হয়নি, এক্সপেক্টেড কস্ট-এর যুক্তি তার পক্ষে থাকা সত্ত্বেও, তারা নিজেদের অজানতেই দুর্ঘটনার ০.১% প্রকৃত সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্য করে দেখেছে তার ডিসিশন ওয়েটকে। সেই ডিসিশন ওয়েট দুর্ঘটনার প্রকৃত সম্ভাবনার চেয়ে ঢের বেশি। কানেম্যানদের সমীক্ষায় যে ডিসিশন ওয়েট পাওয়া গিয়েছিল, এখানে তার চেয়েও অনেক বেশি। কেন, সে কথা পরে হবে,” উঠে পড়লেন শিবুদা।

“যাওয়ার আগে একটা কথা বলে যান,” বাধা দিল তপেশ, “জীবনে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরলেন না, অথচ আপনি লং ড্রাইভে গ্রুপে ঢুকলেন কী করে?”

শিবুদা বললেন, “তাই তো!”

অন্য বিষয়গুলি:

Car Insurance Insurance Policy Insurance Scheme
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy