রঙ্গিত নদীর ধারে একটা ছোট জনপদ বিজনবাড়ি। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে চলেছে নদী। পর্যটকদের জন্য বানানো হয়েছে বাঁশ দিয়ে তৈরি রিসর্ট। মনোরম পরিবেশে অনেকেই ছুটি কাটাতে যান। এক দিকে যখন আনন্দ-উল্লাস চলে, অন্য দিকে সন্তান ও পরিবারের লোকজন নিয়ে রোজ নদীর ধারে আসেন ডোমা। নদী থেকে বড় পাথর তোলেন, তার পর সেগুলো ভাঙা হয়, বস্তায় পোরা হয়। চল্লিশ বস্তা ভরলে ঠিকাদার লোক দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। তিন দিন কাজ করলে চল্লিশ বস্তা পাথর ভরা শেষ হয় ডোমার পরিবারের। বস্তা গুনে নিয়ে ১৬০০ টাকা দেয় ঠিকাদার। সেই পাথরের সঙ্গে কিছু পাথরের ধুলোও বস্তায় ভরে আনে ডোমার ছেলেমেয়েরা। এখন ডোমার বয়স প্রায় ৩০, সন্তানদের বয়স ১২ এবং ১০। ডোমার মা, বয়স ৬৭, তিনিও রোজ আসেন, পরিবারের সবার জন্য খাবার নিয়ে। বেশি রোদ উঠলে বা বৃষ্টি হলে কয়েকটা ছাতা তিনি পাথরের মধ্যে গুঁজে দেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৩টে অবধি এই একই রুটিন তাঁদের। বারো মাস, রোজ দিন।
আগে বাচ্চারা দূরের একটা সরকারি স্কুলে পড়তে যেত। গত দু’বছর ধরে তা বন্ধ। বাড়িতে একটামাত্র ফোন, তা-ও তা দিয়ে ক্লাস করা যায় না। ডোমা নিজে মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন, কিন্তু তিনি আর কোনও আশা দেখতে পাচ্ছেন না তাঁর বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে। অনলাইন ক্লাস তাঁদের কাছে কল্পনার মতো। বাড়িতে একটা টিভি আছে, সেখানে থেকেই খবরে ডোমা জেনেছেন যে, নতুন করে কোভিডের সংক্রমণ বাড়ছে, ফলে আবারও স্কুল বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। যদিও ডোমার সন্তানদের যা বয়স, তাদের স্কুল আদৌ খোলেইনি, কিন্তু একটু বড় ছেলেমেয়েদের খুলেছিল বলে ডোমা আশা করেছিলেন— ছোট বাচ্চাদের স্কুলও খুলবে, তাঁর সন্তানেরাও আবার স্কুল যাবে। তারা যতটুকু যা পড়াশোনা শিখেছিল, সব ভুলে গিয়েছে, বাড়িতে যে পুরনো বই আছে, এখন সেখান থেকে আর দেখে দেখেও পড়তে পারে না ওরা। ডোমা জানেন, তাঁর সন্তানেরা যদি স্কুলে যায়, তা হলে পরিবারের অন্য সদস্যদের পক্ষে ওই চল্লিশ বস্তা পাথর ভেঙে ভর্তি করতে হয়তো আরও দুটো দিন সময় বেশি লেগে যাবে, এখন তিন দিনে ১৬০০ টাকা রোজগার হয়, সে ক্ষেত্রে পাঁচ দিনে হবে। তবুও তিনি চান, সন্তানেরা স্কুলে যাক।
ডোমা জানেন না, কিন্তু বুঝতে পারেন যে, এই সমস্যা শুধু তাঁর সন্তানদের নয়, আশেপাশের আরও অনেক বাচ্চারই। বেশির ভাগই পারিবারিক কাজে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। কোনও কোনও বাড়ির মেয়েদের বিয়েও দিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু ডোমা তা চান না। তিনি চান, তাঁর সন্তানেরা দল বেঁধে স্কুলে যাক। স্কুলের পড়াশোনা বন্ধ হলে ডোমার ছেলেমেয়েরা এই দু’বছরে তিনি বার দুয়েক ছেলেমেয়েদের স্কুলে গিয়েছেন— মিড-ডে মিলের খাবার নিতে, চাল-ডাল-ছোলা আর মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার দিয়েছেন স্কুলের দিদিমণিরা। ডোমা প্রশ্ন করেছে তাঁদের— “আচ্ছা দিদি, তোমাদের ছুটি লাই?” দিদিমণিরা জানিয়েছেন, তাঁদের দায়িত্ব বরং আরও বেড়েছে। মিড-ডে মিল দেওয়া, বাচ্চারা পড়াশোনা করতে চাইছে না কেন অঞ্চলের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে তা জানা, বুঝিয়েসুঝিয়ে কী করে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যবস্থা করা, যাদের কাছে স্মার্টফোন আছে তাদের একটু-আধটু পড়াশোনার জিনিস পাঠিয়ে তার উত্তর কী করে লিখতে হয় তা শেখানো। এর পর আবার বিডিও অফিস থেকে বলা হয়েছে, ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সিদের টিকার ব্যবস্থা করতে হবে হবে। ডোমার মনে হচ্ছে, এগুলো কি আদৌ দিদিমণিদের কাজ? আর, এই কাজ করলে তাঁরা পড়াবেন কখন?
আর কয়েক বার ডোমা গিয়েছেন বাচ্চাদের স্কুলে— তখন সরকার তাঁর ‘দুয়ারে’ এসেছিল। এক বার স্বাস্থ্যসাথীর কার্ডের জন্য লাইন দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় বার লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা পাওয়ার ফর্ম ভর্তি করতে। মাসে-মাসে ৫০০ টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে আসে, বুঝতে পারেন ডোমা, কিন্তু সেই টাকায় হাত দিতে দেননি কাউকে। বলেছেন, ওই টাকা জমা থাক, পরে যদি কখনও স্কুল খোলে, তা হলে বাচ্চাদের জামা, ব্যাগ কিনতে কাজে লাগবে।
ডোমার এক দিদি থাকেন পুরুলিয়াতে। ফোনে সে দিন খবর দিয়েছেন, ও দিকেও স্কুল বন্ধ, কিন্তু কোনও এক গ্রামে নাকি দিদিমণি আর স্যরেরা মিলে বাড়ির উঠোনে বাচ্চাদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। বাচ্চারা উৎসাহিত হয়ে সেই নতুন রকমের স্কুলে যাচ্ছেও। স্কুল মানে তো বিদ্যার আলয়— যেখানে সবাই পড়তে পারে। এই আজকের ‘ই-স্কুল’-এ তো শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত মানুষের সন্তানেরাই পড়তে পারছে। ‘বিদ্যালয়’ হলে ডোমার মতো গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরাও কিছু শিখত। ডোমার এখন একটাই ইচ্ছে, দুয়ারে সরকার নয়, দুয়ারে শিক্ষা আসুক। তাঁর বাচ্চারাও পড়াশোনা করুক। করোনার কারণে স্কুলবাড়ি বন্ধ রাখা হলে বিকল্প শিক্ষার ব্যবস্থা সরকারকেই করতে হবে। দিদিমণি বা স্যরেরা পড়াতে চাইছেন, সবাই মোটেই আর বাড়ি বসে মাইনে নিতে চাইছেন না, অন্তত স্কুলে গিয়ে কথা বলে ডোমার তা-ই মনে হয়েছে। তা হলে যে সরকার তাঁর দোরগোড়ায় এসে পরিষেবা দেওয়ার কথা ভাবছে, গত দু’বছরে কি তারা বাচ্চাদের পড়াশোনা করাতে একটা বিকল্প শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও চিন্তা করতে পারত না?
এই ভাবতে ভাবতে আবার পাথর-ভাঙা রুক্ষ খসখসে হাত দুটোর দিকে তাকায় ডোমা। বিকল্প তৈরি না হলে যে তাঁর বাচ্চাদেরও ওই কাজে যুক্ত হতে হবে, সারা জীবনের মতো। রঙ্গিতের জলের দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়, যদি তৃষ্ণা পায়, আর জল খাওয়ার কোনও পাত্র না থাকে, তা হলে কি সে জল খাবে না? কেউ কি এগিয়ে আসবে না বিকল্প নিয়ে? চোখ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে হাতুড়ির উপর, আবার শব্দ শুরু হয়। পাথর ভাঙার শব্দ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy