Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
সাঁকোটা দুলছে…
BJP

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে পরীক্ষায় ফেলেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি

দলের শিকড়ে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতেই থাকবে। বিজেপির ভিতরের ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ তো এখন এটাই।

অতীত: ময়দানের জনসভায় (বাঁ দিক থেকে) বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য, দিলীপ ঘোষ ও কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কলকাতা, ফেব্রুয়ারি ২০১৭।

অতীত: ময়দানের জনসভায় (বাঁ দিক থেকে) বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য, দিলীপ ঘোষ ও কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কলকাতা, ফেব্রুয়ারি ২০১৭।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২১ ০৫:৩০
Share: Save:

ভোট মিটেছে আড়াই মাস আগে। সেই থেকে এ পর্যন্ত বিজেপির কর্মকাণ্ড কী? এটা এত দিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে যে, নির্বাচিত তৃণমূল সরকারকে যে কোনও প্রকারে উত্ত্যক্ত করে রাখাই এখন তাদের মূল কর্মসূচি। সন্দেহ নেই, এর মধ্যে সুস্থ রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি আছে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার মানসিকতা। যে ভোটে হারিয়েছে, তাকে এক দিনও কাজ করতে না দেওয়ার পরিস্থিতি ক্রমাগত সৃষ্টি করে যাওয়া তারই ফলিত রূপ। নইলে মুখ্যমন্ত্রীর শপথের আগের দিন থেকেই সরকারকে বরখাস্তের উদ্যোগ দেখা যেত না।

এর পিছনে আরও একটি কৌশল আছে বলে মনে হয়। সেটা হল, শাসককে পাল্টা পদক্ষেপ করতে প্ররোচিত করা। সরকার বা শাসক দল তেমন পথে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই জট বাড়তে থাকবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে গড়াবে। আদালতে যাওয়া পর্যন্ত নানা অবস্থা তৈরি হবে। আর সেই ফাঁকে কলকাতার রাজভবন থেকে দিল্লির নর্থ ব্লক পর্যন্ত জাল বিছিয়ে দেওয়ার কাজটিও করে ফেলা সহজ হয়ে যাবে। বিন্যাস সেই রকম।

তার আঁচও কিন্তু মিলতে শুরু করেছে। যেমন, ভোটের কিছু দিন আগে থেকে কেন্দ্রীয় তদন্তকারীদের সক্রিয়তা বেড়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। এ বার তৃণমূল ক্ষমতায় ফেরার পরেই অকস্মাৎ নারদ-মামলায় মন্ত্রী-নেতাদের গ্রেফতার করা হল। তার জেরে খোদ মুখ্যমন্ত্রীও অভিযোগে জড়ালেন। সে সব আদালতে বিচারাধীন। পাশাপাশি রাজ্যে ভোট-পরবর্তী ‘হিংসা’ দেখতে চলে এল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। রাজ্যপাল বললেন, স্বাধীনতার পর থেকে এমন সন্ত্রাস হয়নি।

এ হল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যের সিআইডি-র অনুরূপ তৎপরতা। তাদের বিভিন্ন তদন্তের নিশানায় প্রধানত রাজ্যের বিরোধী দলনেতা। এখানেও নতুন করে সামনে আসছে অনেক পুরনো অভিযোগ। সব মিলিয়ে এটা পারস্পরিক লড়াইয়ের চেহারাই পাচ্ছে। যার যেখানে ক্ষমতা, সে সেখানে নিজের ‘অস্ত্র’ ব্যবহার করছে।

সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী পক্ষের গুরুত্ব স্বীকৃত। বিরোধীরা শাসকের ছিদ্র খুঁজে বেড়াবেন, প্রতিবাদ করবেন, আন্দোলন করবেন। এমনকি তাতে শাসকরা নাজেহাল হবেন, সেটাও বিরোধীদের অধিকার। কিন্তু কোনও নির্বাচিত সরকারকে কাজ শুরু করার দিন থেকেই ছলে-বলে উৎখাত করার যে প্রচেষ্টা এখন নজরে পড়ছে, তা কত দূর গণতন্ত্রসম্মত? বাংলায় বিরোধী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি আজ এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

মনে রাখা দরকার, ক্ষমতার ধারেকাছে পৌঁছতে না পারলেও বিজেপি বিধানসভায় সওয়া দু’কোটির বেশি ভোট পেয়েছে। অর্থাৎ ধরে নিতে হবে, এত সংখ্যক মানুষের সমর্থন তাদের সঙ্গে আছে। তা হলে তাঁদের কাছেই বা কী বার্তা যাচ্ছে? ভোটে হেরে গিয়ে তালেগোলে খিড়কি দিয়ে সিংহাসনে পৌঁছনোর প্রয়াস কি ওই ভোটাররা সমর্থন করেন? তাঁরা কি এটাই দেখতে চান? সেই জন্য কি তাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছিলেন?

গণতন্ত্র মানলে জনগণের রায় মাথা পেতে নিয়ে বিরোধী আসনে বসার শিক্ষাও অর্জন করতে হয়। ভোটে নেমে সবাই বলে, আমরাই জিতছি! আসলে জেতে তো কোনও একটি দল বা জোট। সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল সবাই এ ভাবেই সরকারে এসেছে এবং তার আগে বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরোধী-আসনে বসার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

দিল্লির খুঁটির দাপটে বিজেপি বোধ হয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, তারা এক লাফে ডবল প্রোমোশন পেয়ে যাবে। লোকসভার আঠারো আসন থেকে সোজা উঠে পড়বে নবান্নের চোদ্দো তলায়! দলকে রণাঙ্গনে চাঙ্গা রাখতে এই ভাবে মনোবল বাড়ানোর দাওয়াই দেওয়া নিশ্চয়ই খুব ভাল কাজ। কিন্তু, বিষয়টি যখন ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’-এর জায়গায় চলে যায়, তখন সেই ধাক্কা এক প্রকার মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে। বিজেপির উপর থেকে নিচুতলা পর্যন্ত সেই অস্থিরতা ছড়িয়ে গিয়েছে।

এর প্রভাব এতটাই নেতিবাচক যে, আজ আড়াই মাসের মধ্যে এই দলটি তাদের পরাজয়ের কারণ নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও পর্যালোচনাই করেনি। যারা ক্ষমতায় বসার বাজি ধরেছিল, বিরোধী আসনে বসার কারণ অনুসন্ধানে তাদের এই নিস্পৃহতা কি খুব স্বাভাবিক? উত্তর তাদের কাছে। তবে এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে, সেই আলোচনা হলে তাতে কঠোর বাস্তবতার যে চিত্র সামনে আসবে, বিজেপি নেতৃত্ব তার মুখোমুখি হতে কুণ্ঠিত এবং শঙ্কিত।

লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির কাছে ধাক্কা খাওয়ার পরে তৃণমূল কিন্তু দ্রুত পর্যালোচনা করেছিল। তা থেকে দলের বিভিন্ন স্তরে অনেক নেতা-জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছিল। সেখান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির সূচনা।

সব কিছুই সব সময় ঠিক হবে, ঠিক থাকবে বা ঠিক রাখতে দেওয়া হবে, তা বলছি না। বস্তুত, অনেক কিছুই ‘ঠিক’ হয় না। কিন্তু হেরে যাওয়া বা ধাক্কা খাওয়া কোনও দল যদি উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে থেকে আত্মানুসন্ধানের চেষ্টাটুকুও জনসমক্ষে তুলে ধরতে না পারে, তা হলে তার পক্ষে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের আস্থা অর্জন করা খুব সহজ হয় কি?

আসলে শাসক, বিরোধী, জনগণ সবাই একটি সাঁকোর এ পার-ও পার। সেটা মজবুত না থাকলে গোড়ায় গলদ হয়ে যায়। দেখা যাচ্ছে, সেই সাঁকো হঠাৎ কেমন যেন নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। সাঁকোটা দুলছে!

এখানেই বলব দিলীপ ঘোষের কথা। তিনি রাজ্যের প্রধান এবং কার্যত একমাত্র বিরোধী দলের সভাপতি। অনেকেই জানেন, ভোটের আগে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় যে ভাবে দল ভাঙিয়ে স্রোতের মতো লোক ঢোকানো হচ্ছিল, তাতে তাঁর খুব সায় ছিল না। এখন ভোট-পরবর্তী বাংলায় তাঁর বিবিধ বক্তব্য এবং পর্যবেক্ষণ থেকেও তিনি এটা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন, যা হয়েছিল, তা ঠিক হয়নি। যা হচ্ছে, তা-ও ঠিক
হচ্ছে না।

কথাবার্তায় বরাবরই তিনি বেশ ডাকাবুকো। কারও মন রাখতে খুব তেলে ভেজানো কথা তিনি বলেন না। আজ বিপরীত স্রোতের ধাক্কা খেতে থাকা বিজেপির অন্দরে দিলীপ ঘোষের নানা মন্তব্যের অর্থ কত দূর প্রসারিত হতে পারে, সেটা বোঝাও তাই কঠিন নয়।

দলে তাঁর উপরওয়ালারা তাঁকে কী বলবেন, জানি না। তবে সঙ্ঘ এবং সংগঠনে দিলীপবাবুর অভিজ্ঞতা কম দিনের নয়। তাই রাজ্যে তৃণমূল স্তরের বিজেপির মধ্যে তাঁর ওই সব কথার ‘প্রভাব’ পড়বে না, ভাবা হয়তো ঠিক হবে না।

বস্তুত দিলীপবাবুরও বোধ হয় সেটাই লক্ষ্য। কারণ, বিজেপিতে এখন ‘নব্য’দের নিয়ে বিপরীতমুখী দু’টি স্রোত। বড় পদে, বড় দায়িত্বে যাঁদের বসানো হচ্ছে, তাঁদের দাপটের কাল। আবার কিছু পেতে এসে হালে পানি পাননি যাঁরা, তাঁদের বিজেপি-বিরোধী ক্ষোভের উদ্গিরণ। পুরনো নেতা-কর্মীদের পক্ষে দু’টিই পীড়াদায়ক। আর সংগঠনের সেই অংশেই পৌঁছে যাচ্ছে দিলীপ ঘোষের ‘বার্তা’।

দলের রাজ্য সভাপতি হলেও নব্য ক্ষমতাবানদের কাজকর্ম, আসা-যাওয়া ইত্যাদি বিষয়ে তাঁকে যে ওয়াকিবহাল রাখা হয় না, সেই কথা দিলীপবাবুর মুখে ইতিমধ্যেই শোনা গিয়েছে। এ বার আরও এক ধাপ এগিয়ে তিনি বলে দিলেন, “এক গাছের ছাল অন্য গাছে লাগে না!”

শুধু বলা নয়, এতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে এক পরীক্ষার মুখেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। কী করবেন তাঁরা? কথাটি মেনে নিলে ‘দায়’ আক্ষরিক অর্থেই গায়ে মাখতে হবে। অন্যথায়, দলের শিকড়ে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতেই থাকবে। বিজেপির ভিতরের ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ তো এখন এটাই।

দু’পারে দুই পক্ষ। সাঁকোটা এখানেও দুলছে!

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Dilip Ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy