Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Middle Class Family

মধ্যবিত্তের দিকবদল

২০০৯ সালে দি ইকনমিস্ট পত্রিকা ঘোষণা করল, দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ মধ্যবিত্তের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েছে। প্রধানত উঠতি বাজারের বিস্ফোরক বৃদ্ধির কারণেই।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

অতনু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৪ জুন ২০২৪ ০৮:৩৭
Share: Save:

যে  জন আছে মাঝখানে, সেই তো ‘মিডল ক্লাস’, অর্থাৎ মধ্যবিত্ত। শুধু বিত্তের মাপকাঠিতেই নয়, সব কিছুতেই। ‘মধ্যবিত্ত’ ক্রমশ বদলায়— বিত্তে তো বটেই, শিক্ষা, রুচি, রাজনৈতিক দর্শন, সমাজের কাছে চাহিদা, সব কিছুতেই। সেই সঙ্গে আমরাও মধ্যবিত্ত হওয়ার এক নতুন সীমারেখা তৈরি করে চলি, যে গণ্ডির মধ্যে ঢুকে যায় অন্য মানসিকতার নতুন কিছু মানুষ।

২০০৯ সালে দি ইকনমিস্ট পত্রিকা ঘোষণা করল, দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি মানুষ মধ্যবিত্তের চৌহদ্দিতে ঢুকে পড়েছে। প্রধানত উঠতি বাজারের বিস্ফোরক বৃদ্ধির কারণেই। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় না, তাদেরই বলা হল মধ্যবিত্তের নিম্নসীমা। বলা হল, মধ্যবিত্ত হল এমনই এক অর্থনৈতিক শ্রেণি, যারা খাদ্য এবং বাসস্থানের জন্য ব্যয় করার পরও রোজগারের অন্তত প্রায় এক-তৃতীয়াংশ খরচ করতে পারে ইচ্ছেমতো। ভোগ্যপণ্য কিনতে, উন্নততর চিকিৎসা পরিষেবায়, সন্তানের শিক্ষায়।

অর্থনীতির ইতিহাসবিদ পিটার টেমিন তাঁর ২০১৭-র বই দ্য ভ্যানিশিং মিডল ক্লাস-এ দেখিয়েছেন, বিশ্বায়ন, উদার শিল্পনীতি, পুঁজিপতি এবং পেশাদারদের সাহায্যকারী নতুন প্রযুক্তি, ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকা শ্রমজীবীদের সুরক্ষা ইত্যাদির ফলে ক্রমশ দীর্ঘতর হতে থাকে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী এবং পিছিয়ে-পড়া মানুষদের মধ্যে ব্যবধান। এ সবের ফলে আমেরিকায় মধ্যবিত্তের ঘটে যায় অবক্ষয়। ভারত-সহ দুনিয়ার অনেক সমাজেই পরিস্থিতিটা কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত। ২০২৩-এ ‘প্রাইস’ নামক থিঙ্ক ট্যাঙ্কের একটা রিপোর্ট বেশ হইচই ফেলেছিল এ দেশে, যার শিরোনামই ছিল দ্য রাইজ় অব ইন্ডিয়াজ় মিডল ক্লাস। সেই যে ১৯৯১ সালে ভারতীয় অর্থনীতির বন্ধ দুয়ার খুলে গিয়ে কোনও এক মুক্তধারার স্রোত ভাসিয়ে দিল সমাজটাকে, তার পরের তিন দশকেই সমাজে মধ্যবিত্তের অনুপাত দ্বিগুণ হয়ে পৌঁছল ৩০%-এ। ঠিকমতো অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংস্কার হতে থাকলে স্বাধীনতার শতবর্ষে, অর্থাৎ ২০৪৭-এ, নাকি এ দেশে মধ্যবিত্তের অনুপাত পৌঁছবে ৬৩%-এ।

মধ্যবিত্ত ঠিক কারা এবং তাদের সংখ্যা কত, এ বিষয়ে মতভেদ বিস্তর। দেশভেদে, অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে উপলব্ধ সামাজিক পরিষেবা, শিক্ষার মান, ক্রয়ক্ষমতা, সম্পদের বিস্তৃতি ইত্যাদি অনেক কিছুর উপরই নির্ভর করে মধ্যবিত্তের সংজ্ঞা। ২০১৫-য় মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই অর্থনীতিবিদ এ দেশের প্রেক্ষিতে জনপ্রতি দুই থেকে দশ ডলারের মধ্যে খরচ করাকে মধ্যবিত্তের মাপকাঠি হিসেবে বর্ণনা করলেন। সে হিসাবে দেশের অর্ধেক মানুষই এখন মধ্যবিত্ত। আবার ওইসিডি কিংবা বিশ্ব ব্যাঙ্কের হিসাবে, ২০১৫-র মাপকাঠিতে ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে ১০ থেকে ১০০ ডলারের মধ্যে রোজগেরেরা ‘মধ্যবিত্ত’। সমীক্ষক সংস্থা পিউ রিসার্চ-এর ২০২১ সালের সমীক্ষায় কারও রোজগার জাতীয় গড় আয়ের দুই-তৃতীয়াংশ থেকে দ্বিগুণের মধ্যে হলে তাকে ধরা হয়েছে মধ্যবিত্ত। স্পষ্টতই, যে জন আছে মাঝখানে, তাকে চিহ্নিত করার পদ্ধতি অভিন্ন নয়।

আঠারো শতকের মাঝামাঝি জেমস ব্র্যাডশ’র পুস্তিকা ‘আ স্কিম টু প্রিভেন্ট দ্য রানিং অব আইরিশ উল্‌স টু ফ্রান্স’-এ বোধ হয় প্রথম মেলে ‘মিডল ক্লাস’ কথাটির প্রয়োগ। পরের দিকের সামন্ততান্ত্রিক সমাজের প্রেক্ষিতে ফ্রেডরিখ এঙ্গেল্‌স মধ্যবিত্তকে দেখেছেন অভিজাত এবং কৃষক শ্রেণির মধ্যবর্তী সামাজিক শ্রেণি হিসেবে। ‘মধ্যবিত্ত’ শব্দটির প্রথম আধুনিক ব্যবহার অবশ্য ১৯১৩-তে, ব্রিটেনের রেজিস্ট্রার জেনারেলের রিপোর্টে। সেখানে রাশিবিজ্ঞানী টিএইচসি স্টিভেনসন উচ্চশ্রেণি আর শ্রমিক শ্রেণির মাঝখানে থাকা জনগণকে বললেন ‘মধ্যবিত্ত’। এঁদের মধ্যে রয়েছেন পেশাদার, ম্যানেজার, এমনকি প্রবীণ আমলারাও। এবং এঁদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে অনেকখানি মানবসম্পদ।

২০২৩-এর বই দ্য রাইজ় অব দ্য গ্লোবাল মিডল ক্লাস: হাউ দ্য সার্চ ফর দ্য গুড লাইফ ক্যান চেঞ্জ দি ওয়ার্ল্ড-এ ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের হোমি খারাস যেন ধারাবিবরণী দিয়েছেন ভিক্টোরীয় ইংল্যান্ড থেকে শুরু করে আজকের ভারত পর্যন্ত মধ্যবিত্তের বিবর্তনের। আরও ভাল থাকার যে প্রচেষ্টার শুরু দু’শো বছরেরও আগে, তাই এক অপ্রতিরোধ্য রূপ পরিগ্রহ করেছে আজ। হয়ে উঠেছে দুনিয়ার অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের প্রধান অনুঘটক। অর্থনীতিবিদ লেস্টার থুরো মধ্যবিত্তের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, সুস্থ রাজনৈতিক গণতন্ত্রের প্রয়োজন এক সুস্থ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। কেবলমাত্র ধনী এবং দরিদ্রদের সমাহারে নির্মিত সমাজে মধ্যস্থতাকারী এমন কোনও শ্রেণির একান্তই অভাব।

তাঁর বইতে হোমি খারাস প্রকাশ করেছেন উদ্বেগ— আজকের দুনিয়ার ব্যয়বাহুল্য, রাজনীতি, দূষণ, ক্রমবর্ধমান স্বয়ংক্রিয়তা এবং বেকারত্ব, এ সবের চাপ কি সামলাতে পারবে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়? না কি ভেঙে পড়বে তারা? অসাম্য, জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা প্রযুক্তির রমরমার মতো জরুরি সমস্যাগুলি সামলাতে মধ্যবিত্তের জন্য নতুন ইস্তাহারও প্রকাশ করতে চেয়েছেন খারাস।

যা-ই হোক, মধ্যবিত্ত বদলায়। ভেঙেচুরে তৈরি হয় নব্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যা এক সতত-পরিবর্তনশীল সম্প্রদায়। আবার তাকে ‘একটা’ সম্প্রদায়ই বা বলি কী ভাবে! যিনি দৈনিক দু’ডলার খরচ করেন আর যিনি ১০ ডলার, তাঁরা স্পষ্টতই সমাজের ভিন্ন শ্রেণিতে অবস্থান করেন। এই শ্রেণিবিভাগটা বেশ স্পষ্ট। তবু তারা সবাই মিলে আজকের নব্য-মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এ রকম একটা জটিল এবং বিচিত্রধর্মী গোষ্ঠীর রংরূপও বহুমাত্রিক হতে বাধ্য। এই সুবিশাল, ক্রমস্ফীতিশীল, বহুধর্মী গোষ্ঠীর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক রূপরেখা আঁকাও কঠিন। সমাজ এবং তার রাজনীতির কাছে এদের চাহিদাকে প্রকাশ করা, এমনকি তা ঠিক ভাবে বুঝতে পারাও দুষ্কর।

তবু মধ্যবিত্ত প্রবল ভাবে সমাজের সর্ব স্তরে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। মধ্যবিত্তের পরিধি স্ফীত হচ্ছে— কিছুটা অর্থনৈতিক নিয়ম-নীতি, কিছুটা বিশ্বায়ন, খানিকটা প্রযুক্তি আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আর সঙ্গে মধ্যবিত্তের নতুন সংজ্ঞার মিলিত ফলে। তবে কারণ যা-ই হোক, এতটা বড় একটা জনগোষ্ঠীকে বেশি করে প্রশ্রয় দিতেই হবে রাজনীতির তরফে— প্রতিশ্রুতিতে এবং পদক্ষেপে। এদের এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু এদের বহুমাত্রিক চাহিদা এবং সন্তুষ্টির তল পাওয়া কি সহজ? রাজনৈতিক উপদেষ্টারা হিমশিম খেতেই থাকবেন নব্য-মধ্যবিত্তকে বুঝতে। সে বিমূঢ়তা বাড়তে থাকবে মধ্যবিত্তের পরিধির ক্রমবিস্তারের সঙ্গে। অর্থনৈতিক মাপকাঠিতেও মধ্যবিত্ত এক মস্ত উপভোক্তা; তাকে আকর্ষণ করার নতুন নতুন পথ তাই বার করতে চায় অর্থনীতি এবং বাজার।

মোটের উপর, আর কে লক্ষ্মণের ধুতি-শার্ট পরিহিত নির্বাক ‘কমন ম্যান’— মধ্যবিত্তের সনাতন রূপায়ণ— তার থেকে আজকের মধ্যবিত্ত অনেকটাই আলাদা, ও বৈচিত্রপূর্ণ। শুধু এ দেশে নয়, সর্বত্রই। তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে, এই সনাতন চিত্রণ থেকেও মধ্যবিত্ত সরে এসেছে অনেকটা। এবং আগামী দিনে মধ্যবিত্তের আরও অনেকখানি বদল সুনিশ্চিত। কারণ, হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতোই আমরা যেন কোনও এক খরগোশের গর্ত গলে ঢুকে পড়েছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওয়ান্ডারল্যান্ডে। এআই-এর যুগে সব কিছুই অন্য রকম, অপরিকল্পিত, অপরিজ্ঞেয়। প্রযুক্তির অন্যান্য ঐতিহাসিক বিবর্তনের তুলনায় ভিন্ন এর রূপ। সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম ব্যাপক ভাবে কলেজ-শিক্ষিতদের কর্মচ্যুতির কারণ হয়ে উঠেছে যন্ত্র এবং প্রযুক্তি। তৈরি হতে চলেছে এক অজানা ‘এআই অর্থনীতি’। তার ফলে কী ভাবে বদলাবে মধ্যবিত্ত তার শ্রেণি-বৈশিষ্ট্য? কী হবে নবতর মধ্যবিত্তের রূপায়ণ? এক দশক আগে, ২০১৫-র এক প্রভাবশালী গবেষণাপত্রে এমআইটি-র অর্থনীতির অধ্যাপক ডেভিড অটোর বলছিলেন, কম্পিউটার আমেরিকান সমাজের মেরুকরণের জন্য অনেকটাই দায়ী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তখনও হামাগুড়ি দিচ্ছে। আজ এআই-এর রমরমার যুগে কি এই মেরুকরণ আরও স্পষ্ট হবে? আরও ক্ষয়প্রাপ্ত হবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি? শুধুমাত্র আমেরিকায়? না কি অন্যত্রও? অটোর অবশ্য আশাবাদী যে, উল্টে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো ব্যবহৃত হবে মধ্যবিত্তের পুনঃপ্রতিষ্ঠায়।

সেটা হোক আর না-ই হোক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চিচিং ফাঁক মন্ত্রে এক নবতর মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্বর্তন কিন্তু সুনিশ্চিত। আমেরিকায়, ভারতে, সর্বত্র। কেবল তার নির্মীয়মাণ রূপরেখাটা বড্ড অজানা।

অন্য বিষয়গুলি:

Inflation World Economy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy