Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
ক্ষয়িষ্ণু বর্তমানে দাঁড়িয়েও ‘বেঁধে বেঁধে থাকা’র মন্ত্রটুকুই ভরসা
Sankha Ghosh

আজীবন সত্যানুসন্ধানী

কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হবে কাল, ২১ এপ্রিল। পরিপূর্ণ বয়সে প্রয়াত এক কবির অভাব প্রতি দিন অনুভব করি কেন?

দীপেশ চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৩০
Share: Save:

কবি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণের এক বছর পূর্ণ হবে কাল, ২১ এপ্রিল। পরিপূর্ণ বয়সে প্রয়াত এক কবির অভাব প্রতি দিন অনুভব করি কেন? তার প্রধান কারণ, আজ আর তাঁর মতো মান্য কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর নেই। এমন কেউ নেই, যিনি লিখতে পারেন, “এখন আর আমাদের কোনো অশান্তি নেই/ কেননা আমরা দল বদল করেছি/ হয়ে গেছি ওরা,” অথবা, “তুমি বলেছিলে দল হবে দল হবে/ দলের বাইরে থাকবে না কিছু আর/ অনুগত হলে সহজে পেরিয়ে যাবে/ দুর্গম গিরি দুস্তর পারাবার।”

সংবাদমাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের যে ছবি নিয়ত ফুটে ওঠে— হয়তো সে ছবি সম্পূর্ণ নয়, হয়তো ‘যা রটে তার কিছু বটে’ ধরে নিয়েই এগোতে হয় আমাদের— সেই ‘কিছু’র ভিতর দিয়েও আমাদের সমাজের অন্তরে এক পচনশীল ক্ষত এমন নগ্ন ভাবে ধরা পড়ে যে, আমাদের আর দুঃখ রাখার জায়গা থাকে না। কারণ আমরা জানি যে, এই ‘কিছু’ বা ‘কয়েক’-এর শেষ নেই। যাঁদের ঘর পুড়িয়ে দগ্ধ করা হল, যে নাবালিকাকে অকথ্য অত্যাচার করে মেরে ফেলা হল, যে রাজনীতিমনস্ক যুবককে ছাদ থেকে ঠেলে দেওয়া হল নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাতে— তাঁরা শুধু ব্যক্তিবিশেষ নন; আজ যে রিজ়ওয়ানুর, কাল সে আনিস হয়ে গত কয়েক দশক ধরে সার বেঁধে এসে আমাদের অনুভূতিবাহী স্নায়ুগুলোকে আরও নিথর ও নিস্পন্দ করে দিয়ে যাবে। আমরা মনে মনে প্রতি দিন প্রস্তুত হব দলতন্ত্রের হাতে গণতন্ত্রের মৃত্যু দেখতে। এই মুহূর্তটিতে মনে পড়ে শঙ্খ ঘোষের পঙ্‌ক্তি— “আত্মঘাতী ফাঁস থেকে শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন দল/ রাতে ঘুমোবার আগে ভালবাসবার আগে প্রশ্ন করো কোন্‌ দল তুমি কোন্‌ দল।” এখন হয়তো প্রশ্ন করব, দলের ভিতরে তুমি কার গ্রুপ, কোন গোষ্ঠী তুমি?

বোঝা যায়, আমাদের সমাজের এখন গভীর কোনও অসুখ— যা আমাদের রাত্রিদিন পোড়ায়, অথচ যার সমাধান ক্রমশই যেন নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সেই অসুখের কারণে জাত আমাদের অসহায়তা, নিষ্ফল বিদ্রোহ ও ক্ষোভ, ও সর্বোপরি আমাদের সকলের শুভবুদ্ধির সামূহিক পরাজয়ের অনুভবকে শঙ্খ ঘোষের কবিতায় প্রতিধ্বনিত হতে শুনি। তাঁর শ্লেষের মধ্যে কোনও ব্যঙ্গ ছিল না,

কারণ কোনও নিষ্ঠুরতা ছিল না তাঁর মননে। এই পরাজয়ের বাইরে যে তিনিও নন, সে কথা তিনি জানতেন, জানতেন যে সে লজ্জা তাঁর নিজেরও— “আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা/ লজ্জা লুকোই কাঁচা মাটির তলে।” আবার এ-ও সত্যি যে, এই পরাজয়কে তিনি চিরকালীন বলে ভাবেননি। তাঁর ভবিষ্যতের আশা বা স্বপ্নকে পর্যুদস্ত করতে পারেনি পরাজয়ের এই স্বীকৃতি। পরের লাইনেই লিখছেন, “গোপন রক্ত যা-কিছুটুক আছে আমার শরীরে, তার/ সবটুকুতেই শস্য যেন ফলে।” এই কবিতারই আরও একটা পঙ্‌ক্তি— “মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে/ অস্ত্র গড়ো, আমায় করো ক্ষমা।”

তাঁর ভক্ত ছিল অগুনতি, রাজনৈতিক মতামতের স্রোত তাঁকে ছুঁয়ে যেত, কিন্তু কোনও দল ছিল না তাঁর। বরং তাঁর মৃদুভাষী, স্মিতহাস্যময়, স্নেহশীল উপস্থিতিই আমার মতো মানুষের স্মৃতিতে খচিত হয়ে থাকে। আমাদের এমন দলাদলি-বিধ্বস্ত সমাজে মান্যতা কী করে পেলেন কবি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একদা লিখেছিলেন, “আমি তাঁর কবিতার ভক্ত, তাঁর ব্যক্তিত্বের ভক্ত, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অলিখিত নেতৃত্বের ভক্ত।” কী ভাবে জয় করে নিতেন এই শ্রদ্ধা বা ভক্তি? দ্বিতীয় এমন মানুষ নেই আজ, তাই তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের বিপন্নতার বোধ বাড়ায়। দলের উপরে উঠে আজকের ক্ষয়িষ্ণু বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমাদের সঙ্কট, সংশয়, দোলাচলকে ভাষা দিয়েও আমাদের ‘বেঁধে বেঁধে থাকার’ মন্ত্র শেখাবেন কে?

কী ভাবে নিজের ব্যক্তিত্ব ও কবিতার মধ্যে এক গভীর সংযোগসূত্র তৈরি করেছিলেন কবি, তার কোনও সর্বাঙ্গীণ বিশ্লেষণ এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিহাসের পড়ুয়া, ও সেই সূত্রে তথ্য ও সত্যের সামান্য ব্যাপারী হিসেবে শঙ্খ ঘোষের চিন্তার একটি দিক আমাকে ভাবায়। এখানে তার নামমাত্র আলোচনা করে প্রসঙ্গটি তুলি— ভবিষ্যতে কোনও সুযোগ পেলে বিষয়টির গহনে প্রবেশ করা যাবে। এই দিকটি হল, তথ্যের ও সত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ। ‘সত্য’ কথাটির অর্থ যত বিচিত্র ভাবেই বুঝি না কেন, কবি ছিলেন আজীবন সত্যানুসন্ধানী। দল, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির উপরে ছিল সত্য। তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা সঙ্কলনের ভূমিকায় বলছেন, “সত্যি কথা বলা ছাড়া আর কোন কাজ নেই কবিতার।”

সত্যি কথা কী? প্রশ্নটি জটিল ও অবশ্যই বিশদ আলোচনার অপেক্ষা রাখে। নিঃশব্দের তর্জনী-র কিছু প্রবন্ধ পড়লে বোঝা যায় যে, কবির বিচারে সত্যের কিছুটা প্রকাশ ভাষার ব্যবহারের সঙ্গে কবির জীবনচর্যার সম্পর্কের মধ্যে— “আমাদের জীবনযাপনকে ঘিরে ধরেছে পঙ্গপালের মতো শব্দাবলি, কিন্তু ক্রমে টের পাই অল্পে অল্পে তার পরিবহণ গেছে নষ্ট হয়ে। নিষ্ফলা কথায় দিন কাটে... অভ্যাসবশে কথা বলার আর মিথ্যে বলার এই সমূহ সর্বনাশ শিল্পেও তার চিহ্ন রেখে যায়, কবিতারও অবয়ব হয়ে ওঠে কলরবময়, বার্তাবিহীন, অভ্যাসতাড়িত।” ‘নির্মনা, নিরনুভব শব্দপ্রয়োগের বহুলতা’-র বৃত্তের ও বৃত্তির বাইরে কোথাও কবিতার ভাষাগত সত্যের অবস্থান। তার মানে এই নয় যে, কবিকে দৈনন্দিনের বাইরে গিয়ে মাইকেল মধুসূদনের কায়দায় অভিধান ঘেঁটে নতুন শব্দ খুঁজতে হবে। তা নয়। শঙ্খ ঘোষ বলছেন, ‘নতুন শব্দের সৃষ্টি’ নয়, ‘শব্দের নতুন সৃষ্টিই [কবিতার] মূল’।

বলা বাহুল্য যে, কবির কাছে সত্য একমাত্রিক নয়। একরঙাও নয়। আবার সম্পূর্ণ ভাবে তথ্যবিচ্ছিন্নও কিছু নয় সত্য। উর্বশীর হাসি গ্রন্থের— যার অনেকটা জুড়েই আছে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন ও সাহিত্য বিষয়ের কয়েকটি তথ্য’— ভূমিকায় লিখছেন, পাঠক ভাবতেই পারেন যে, তথ্যসংক্রান্ত ও তথ্যবহুল বই ‘সাহিত্যপাঠের দিক’ থেকে নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু কবি সেই মনোভাবকে প্রশ্ন করে লিখছেন, “সত্য তো একেবারে তথ্যনিরপেক্ষ নয়। অনেক সময়েই তথ্য আমাদের পায়ের তলার মাটি। সে মাটি সরে গেলে দাঁড়াবার আর জায়গা থাকে না কোনো।” তথ্যে ভুল থাকলে সত্যের কোনও গভীর অর্থে পৌঁছনো যাবে না। তাই এই বইয়ে রবীন্দ্রজীবনের তথ্যের প্রশ্নে ভ্রম নিরসনের কাজে ব্যাপৃত হয়েছেন কবি। রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করে লিখছেন, “দ্বার বদ্ধ করে দিয়ে ভ্রমটিকে রুখি/ সত্য বলে, আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি?” তাই রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের প্রতি কবির প্রভূত শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও তাঁর শেষ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ গীতবিতান: কালানুক্রমিক সূচি গ্রন্থে বেশ কিছু তথ্যপ্রমাদের প্রতি আমাদের নজর ফিরিয়েছেন। আসলে তথ্য সরবরাহের ব্যাপারেও এক ‘নির্মম তন্ময়তা’ দাবি করতেন কবি। তাই পম্পা মজুমদারের রবীন্দ্রসংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস গ্রন্থটির প্রশংসা করার উপলক্ষে এই ‘তন্ময়তা’ কথাটিই ব্যবহার করেন তিনি, বইটির বর্ণনা করেন ‘আত্মনিরপেক্ষ এক তন্ময় বিবরণ’ হিসেবে।

‘তন্ময়’— তদ্‌গত হওয়া— কথাটির এই ব্যবহার থেকে বোঝা যায়, তথ্যের সত্যই হোক, বা কবিতার ভাষার সত্য হোক, সত্য এমন কিছু যা দৈনন্দিন জীবনের অবশ্যম্ভাবী বিক্ষিপ্তচিত্ততার বাইরে কোনও কিছুতে আমাদের মগ্নতা দাবি করে, অথচ তা অলীক নয়, নইলে কবি বলবেন কেন যে, সত্য একেবারে তথ্যনিরপেক্ষ নয়, তথ্যই আমাদের পায়ের তলার মাটি? এই বস্তুগত ও বিচিত্র পৃথিবীর তথ্যের বিশেষ থেকে কোনও এক সাধারণ উপলব্ধিতে পৌঁছনোর প্রচেষ্টাতেই প্রকাশ পেত কবির সত্যানুরাগ। ‘সত্য’ কথাটি যতই ‘মিস্টিক’ শোনাক, দলতন্ত্র ঠেকাতে গেলে তথ্য ও সত্যের প্রতি জনজীবনে দায়বদ্ধ থাকা যে কত জরুরি, আমাদের এই সঙ্কটের মুহূর্তে, কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তা আমরা আবার স্মরণ করতে পারি।

ইতিহাস বিভাগ, শিকাগো ইউনিভার্সিটি

অন্য বিষয়গুলি:

Sankha Ghosh India Bengali Poet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy