Advertisement
২৪ ডিসেম্বর ২০২৪
বন্ধু, অথবা প্রতিদ্বন্দ্বী
Indian Army

যোদ্ধারূপে দেবীর আরাধনা হয়, কিন্তু মেয়েদের মানতে নারাজ

ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনও নারী সেনার জন্য প্রবেশদ্বার উদার হাতে খুলে দেয়নি। এতে যে তার নৈতিক স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, সে কথা বোঝা কিন্তু একান্তই দরকার।

সাহসিনী: ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলা যোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ চলছে বেঙ্গালুরুর ক্যাম্পে। মার্চ ২০২১।

সাহসিনী: ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মহিলা যোদ্ধাদের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ চলছে বেঙ্গালুরুর ক্যাম্পে। মার্চ ২০২১। গেটি ইমেজেস।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২১ ০৬:০২
Share: Save:

এক পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এক প্রৌঢ়া, কার্যত বিনা চিকিৎসায় মারা গেলেন ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। বাংলা তো বটেই, দেশময় ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল শোক। কিছুই হল না। অথচ, এই প্রাণবতী মহিলা ছাত্রী-জীবন থেকে প্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন ভারতের মুক্তি সংগ্রামে। ‘ছাত্রীসঙ্ঘ’-তে কাজ করেছেন। বিপ্লবী শশধর আচার্যের সহায়তায় নকল দাম্পত্য সাজিয়ে চন্দননগরে আশ্রয় দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিপ্লবের পলাতক যোদ্ধাদের। চার্লস টেগার্ট যখন তাঁদের বাড়ি আক্রমণ করেন, তখন বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহিদ এবং গ্রেফতার হন বিপ্লবীরা। এই নারীও তাঁদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে গ্রেফতার হন। হিজলি জেলে আটক ছিলেন অনেক দিন। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন না। তবু তার সৈনিককে আশ্রয় দিতে গিয়ে ফের গ্রেফতার হন।

বিপ্লবীদের কাছে আদরের সেই ‘পুটুদি’র আসল নাম সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়। আমাদের দেশের ‘স্বাধীনতা’ পঁচাত্তুরে বৃদ্ধ হতে চলল। সুহাসিনীদের মতো নারী বিপ্লবীর লড়াই কিন্তু অকথিত এবং অজানা হয়েই রইল। কারণ ‘ঐতিহ্যময়’ ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘দেশপ্রেম’ বা ‘দেশরক্ষা’য় পুরুষের একচ্ছত্র অধিকার। ঝাঁসির রানি যতই ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করুন, ‘আইএনএ’-র নারী যোদ্ধারা যতই রক্তের অক্ষরে মেটান মুক্তিসংগ্রামের দাবি, প্রীতিলতা যতই নেতৃত্ব দিন ‘ইউরোপিয়ান ক্লাব’ আক্রমণের, ভারতের শাসক সে কথা ভুলে যাবেনই। তাঁর বইতে কেবল জ্বলজ্বল করবে ‘জহর’। তাই ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনও নারী সেনার জন্য প্রবেশদ্বার উদার হাতে খুলে দেয়নি। এতে যে তার নৈতিক স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে, সে কথা বোঝা কিন্তু একান্তই দরকার।

হাল্লা রাজার দাস হয়ে ‘যুদ্ধু যুদ্ধু’ খেলার কোনও অর্থ হয় না। অকারণ হিংস্রতার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। কিন্তু দেশের প্রকৃত প্রতিরক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে স্বীকৃতি না দিয়ে উপায় নেই। সেই বাহিনীর আবার ‘নারী যোদ্ধা’কে স্বীকৃতি দিতে ঘোরতর আপত্তি। এমন আপত্তি যে, দেশের শীর্ষ আদালতের গঞ্জনা বারংবার সহ্য করেও নানা অজুহাত খাড়া করা চলেছেই। এ সবের পিছনে প্রচ্ছন্ন সরকারি মদতের রহস্য শিশুও বুঝবে। আমাদের ‌‘প্রতিরক্ষা মন্ত্রী’ মহিলা হতে পারেন, ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’-এর প্যারেডে বিদেশি অতিথিদের চমক দিয়ে নারীকে নেতৃত্ব দিতে দেখা যেতে পারে, মন্ত্রী সান্ত্রিকে ‘নারী সেনা’ বিষয়ে নানা অঙ্গীকার করতেও শোনা যেতে পারে। তবু ভারতীয় সেনাবাহিনী নারীর অন্তর্ভুক্তিকে এখনও আণুবীক্ষণিক করেই রেখেছে। বিচারপতি ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছেন, ‘পশ্চাদ্‌গামী মানসিকতা’। কিন্তু জলপাই পুরুষতন্ত্র নারী সহযোদ্ধাকে স্বাগত জানাতে এখনও তৈরি নয়। মেডিক্যাল ইউনিট, লিগাল সেল, ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বা অফিসে যা-ও বা নারীর স্থান হয়, কিন্তু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ? সে তো পুরুষের কাজ!

তবু ভারত একটি গণতান্ত্রিক দেশ। এখানে স্বৈরাচারী নিয়ম যুক্তির সমর্থন পায় না। এ দেশের নারীরাও ব্যক্তিজীবনে কম লড়াকু নন। কাজেই শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার শীর্ষ আদালতকে জানিয়েছে যে, ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি’-তে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকবে না। বাহিনীতে মেয়েদের ‘স্থায়ী কমিশন’ দেওয়ার কথা বলেছে আদালত। তবুও নেতিবাচক অজুহাতের স্রোত যেন বন্ধ হওয়ার নয়। এখন যেমন বলা হচ্ছে, পরিকাঠামো প্রস্তুত নয়। কিন্তু এই অজুহাতের পিছনে পুরুষতন্ত্র, সামাজিক মৌলবাদ, নারী বিদ্বেষ ইত্যাদিও কম নেই। যাঁরা ‘সমকাম’, ‘পরকাম’ প্রভৃতি শব্দকেই ‘অশুচি’ মনে করেন, নারীর হাতে দেশের প্রতিরক্ষার ভার দেওয়ার ধারণাকে ধারণ করার মতো বৌদ্ধিক এবং চেতনাগত আধার স্বাভাবিক ভাবেই তাঁদের নেই।

২০২০ সালে শীর্ষ আদালতকে আমাদের বাহিনী জানিয়েছিল, আমাদের পুরুষ সেনারা নাকি নারীর কমান্ড মানতে পারবেন না। কেন? কারণ তাঁরা অনেকেই গ্রামে থাকেন। গ্রামে নাকি মহিলাদের প্রাধান্য স্বীকার করতে মানুষ অভ্যস্ত নন। এই যুক্তি কি গ্রামের মানুষের পক্ষে সম্মানজনক? আর এই স্বাধীন, গণতান্ত্রিক দেশে ‘বৈষম্য’কে যদি ‘সংস্কৃতি’ বলে মানতে হয়, তা হলে তো পঞ্চায়েতে মহিলা প্রধানদেরও পদচ্যুত করা উচিত? এর পরের যুক্তি হল, মহিলাদের মূল দায়িত্ব সন্তান, স্বামী ও সংসারের প্রতি। ‘দেশরক্ষা’ তার পরে। এই চরম অবৈজ্ঞানিক পুরুষতান্ত্রিকতাকে প্রতিষ্ঠা দেবেন আমাদের ‘স্বাধীনতার রক্ষক’রা? আধুনিক যুদ্ধ নাকি ক্ষিপ্র। নারী সেনার কর্ম নয়। আধুনিক সামরিক সরঞ্জাম বরং নারীর কাজকে সহজই করেছে।

তা ছাড়া, ভারতীয় নারী সেনার ‘অক্ষমতা’কে পরীক্ষিত প্রতিবন্ধকতা প্রমাণ করতেও যেটুকু সদিচ্ছার দরকার ছিল, তাও কি দেখানো হয়েছে? যেখানে সামান্যতম সুযোগ মিলেছে, সেখানে মহিলা সেনা কিন্তু আত্মপ্রতিষ্ঠায় চূড়ান্ত সফল। কার্গিলের উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্রে হেলিকপ্টার নিয়ে জিনিস পৌঁছে দিয়েছেন নারী। যুদ্ধ বিমান উড়িয়ে আকাশ চিরেছেন। সম্পূর্ণ ভাবে নিজেদের পরিচালিত জলযান নিয়ে বিশ্বভ্রমণে সাফল্য পেয়েছেন নারী।

ভারতীয় মেয়েরা তবু ‘যোদ্ধা হওয়ার উপযুক্ত’ নন। এক বাঙালি (প্রাক্তন) সেনাপ্রধান পদে বসেই মত প্রকাশ করেছিলেন, দেশে যথেষ্ট পুরুষ আছে। সেনাবাহিনীতে নারীর প্রয়োজনই নেই। নেতাজির কথা ভুলে গিয়েছিলেন সম্ভবত। সেই বিস্মৃতির রোগ এখনও সারেনি। নারী যদি চাইলেই ‘মাতৃত্বকালীন ছুটি’ না পান, তা হলেই নাকি হইচই করে উঠবেন। তখন তাঁর কমান্ডে থাকা সেনাদের কী হবে? আমরা তেমন হইচইয়ের কথা শুনিনি। কেবল সমস্যাকে কবর খুঁড়ে বার করতে দেখেছি, সমাধানকে সমাধিস্থ করে। তাই সমগ্র ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মাত্র ৬.৫ শতাংশ মহিলা রয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ‘নেভি’তে— মাত্র ৭০৪ জন। বিমানবাহিনীতেও সরাসরি বাহিনীর কাজে অংশ নেন যাঁরা, তাঁদের মাত্র ১.০৮ শতাংশ মহিলা। স্থলসেনাতে এই পরিসংখ্যান ০.৫৬ শতাংশ।

আমেরিকা, এরিট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্ক, ইজ়রায়েল, ফ্রান্স, নিউ জ়িল্যান্ড, নরওয়ে— এমন বহু দেশেই নারী সেনাবাহিনীর বহু কাজে অংশগ্রহণ করেন। ভারতীয় নারী কি তাঁদের তুলনায় অক্ষম? সমস্যা নিশ্চয় আছে। সদিচ্ছা থাকলে তার সমাধানও থাকবে। আসলে মূল সমস্যাই হল আমাদের মরচে ধরা ‘দর্শন’ যা নারীর ‘উর্যা’কে নিয়ন্ত্রণে রাখার কথা বলে। যত দিন যাচ্ছে, ‘নারী স্বাধীনতা’র বিষয়ে আমরা পিছিয়েই চলেছি। ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা, গার্হস্থ হিংসা ইত্যাদিতে মেডেল পেয়েই চলেছি। কাজেই মামলার পর মামলা ঠুকে সেনাবাহিনীতে নারীর প্রবেশে বাধা সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলতেই থাকবে। আদালতের রক্তচক্ষু যদি কতিপয় নারীকে বাহিনীতে যোগ দিতেও দেয়, তাঁদের কলমপেষার কাজে আটক রেখে প্রাণহীন করে ফেলার প্রথাও সহজে বন্ধ হওয়ার নয়। নারী সেনা যদি যুদ্ধবন্দি হন, কষ্ট সহ্য করতে পারবেন কি? ভারতে কষ্ট সহ্য করার রেকর্ড তো মেয়েরা ঘরে, পথে, কর্মক্ষেত্রে সর্বত্রই সর্ব ক্ষণ গড়ছেন। যদি তাঁরা ধর্ষিত হন? পুরুষ সেনা শারীরিক ভাবে অত্যাচারিত হলে ‘বীর’, নারী ধর্ষিত হলেই ‘নষ্ট’! গোবলয় যে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। নিজের বাহিনীর পুরুষের কাছেই হয়তো সহযোদ্ধা নারী নিরাপদ নন? তা-ও সেই নির্যাতিতারই দোষ। শাস্তি তাঁরই হবে। নির্যাতকের ক্ষেত্রে হয়তো এ কেবল ‘পুরুষসুলভ’ আচরণ! অন্য দেশে এমনটা ঘটে। এ নিয়ে ভাবনাচিন্তাও চলছে। কিন্তু আমরা আবার পবিত্র জাতি কিনা? ও সব ঝামেলায় যাব কেন?

এত প্রতিকূলতার পরও খবরের কাগজের পাতায় প্রিয়া ঝিঙ্গম, শান্তি টিজ্ঞা, পদ্মাবতী বন্দ্যোপাধ্যায়, গুঞ্জন সিংহ, অবনী চতুর্বেদীদের নাম উঠে আসে। কারণ নারী এক অপ্রতিরোধ্য সত্তা। কারণ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে যান তাঁর সত্যিকারের পুরুষ সহযোদ্ধারা। আর যে পুরুষতন্ত্র নারীকে ‘সংসারবদ্ধ জীব’-এর জীবনে আটক রাখতে চায়, তার আত্মাভিমানের অপর পিঠে আছে চূড়ান্ত ভীতি। প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে পরাজিত হওয়ার ভয়। হৃদয়ের কুরুক্ষেত্রে অর্জুন চিরকাল কর্ণের কাছে পরাজিত হয়েছেন, কারণ কর্ণকে যুদ্ধেই নামতে দেওয়া হয়নি। ভারতীয় নারী মোটেই ‘কর্ণ’ হতে চান না। তাঁকে লড়তেও হবে, জিততেও হবে। পুরুষ তাঁকে বন্ধু ভাবলে ভাল, প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবলেও পরোয়া নেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Indian Army
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy