অতিমারি-বিধ্বস্ত ভারতীয় অর্থনীতির গভীরে ক্রমশ শিকড় বিস্তার করে চলা স্ট্যাগনেশন বা বৃদ্ধিহীন স্থবিরতার সঙ্গে দেশের একটি বিরাট অংশের মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার বিষয়টি অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বা আন্তর্জাতিক ক্ষুধা-সূচকের নিরিখে ভারতের শোচনীয় পতন ঘটেছে। তার প্রধান কারণ বিপুল অপুষ্টি, বিশেষত মহিলা এবং শিশুদের মধ্যে। দ্বিতীয়ত, অতিমারি পরিস্থিতিতে জীবন জীবিকার বিপুল অনিশ্চয়তায় যখন দেশের একটি বৃহত্তর অংশের মানুষ প্রতিনিয়ত লড়ে চলেছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই, ঠিক সেই সময়ে অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধির হার এবং বিশেষত ভোগ্যপণ্যের মূল্যসূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা জনকল্যাণের ধারাকে প্রতিনিয়ত চরম ভাবে ব্যাহত করে চলেছে।
২০২১-এর এপ্রিল মাসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশব্যাপী লকডাউন চলাকালীন ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার রীতিমতো চড়া থাকার পর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাস নাগাদ বেশ কয়েক ধাপ নামলেও, ২০২১-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ফের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জাতীয় পরিসংখ্যান দফতর ও পরিসংখ্যান মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতের শহর এবং গ্রামাঞ্চল মিলিয়ে এই সূচকের বৃদ্ধির হার জানুয়ারি মাসে যেখানে ছিল ১.৮৯ শতাংশ, সেখানে মার্চ মাসে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৪.৮৭ শতাংশে। খুচরো মূল্যসূচকের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল খাদ্যপণ্যের দাম। অতএব, এই সূচকে বাজারে খাদ্যসামগ্রীর দামের ওঠাপড়ার প্রতিফলন ঘটে। ভারতে আর্থিক বৈষম্য রীতিমতো চড়া, ফলে খাদ্যপণ্যের অ-স্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটলে দেশের সিংহভাগ মানুষের উপর তার কুপ্রভাব পড়ে।
২০১২ সালটিকে বেস ইয়ার বা ভিত্তি-বছর ধরে পরিসংখ্যান মন্ত্রকের প্রকাশিত ভোগ্যপণ্য মূল্যসূচকের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের মধ্যে ভারতের শহর ও গ্রামাঞ্চলকে এক সঙ্গে নিয়ে খাদ্যসামগ্রীর গড় মূল্যসূচকের মান ছিল যথাক্রমে ১৫৬.৭ এবং ১৫৮.১। একই বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় সংখ্যাটা কিছুটা স্বস্তির হলেও ভারতের বুকে দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের সংস্থান করতে না পারা এবং পরিবারের অভুক্ত মানুষগুলোর মুখের দিকে চেয়ে চরম আর্থিক নিরাপত্তাহীনতায় আত্মহত্যার মতো ঘটনা যে দেশে আকছারই ঘটে চলে, সেখানে এই পরিসংখ্যানগুলোর মধ্যবর্তী আপাত ক্ষুদ্র ব্যবধানও রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপের দাবি রাখে।
আন্তর্জাতিক ক্ষুধা-সূচকের নিরিখে ২০২০ অবধি পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৯৪তম। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স অর্গানাইজ়েশন এবং রাষ্ট্রপুঞ্জের দ্য ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজ়েশন-এর স্থির করা নির্ধারকগুলিকে মাথায় রেখে বলা যায় যে, ভারতের এহেন শোচনীয় পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী বিপুল অপুষ্টি এবং গড় ভারতীয়ের দৈনিক খাদ্য তালিকায় প্রয়োজনীয় খাদ্যগুণের অনুপস্থিতি। এ প্রসঙ্গে জনসচেতনতার অভাবের পাশাপাশি (যা দূরীকরণে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ) মানুষের ক্রয়ক্ষমতার কথাটিও উল্লেখ করা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত, এ বছরের এপ্রিল মাসে খাদ্য ও পানীয়ের গড় মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ২.৬৬ শতাংশ— আপাতদৃষ্টিতে খুব একটা বেশি না হলেও এর অর্থনৈতিক তাৎপর্য যথেষ্ট। প্রশ্ন উঠতে পারে যে, যেখানে সচল মূল্যবৃদ্ধি বাজারের কুশলতা বিষয়ে ইতিবাচক বার্তা দেয়, সেখানে কি এই সামান্য মূল্যবৃদ্ধি আদৌ চিন্তার বিষয়? এর উত্তর হিসেবে বলা যায় যে, ভারতের মতো একটি বাজার অর্থনীতি-নির্ভর দেশ তার এক বড় অংশের নাগরিকের কাছে বাজারের এই কুশলতার ব্যবহারিক সুফল পৌঁছে দিতে বস্তুত ব্যর্থ— মূলত বাজারদামের উপর জনকল্যাণমুখী নিয়ন্ত্রণ ও সম্পদের পুনর্বণ্টনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতার কারণে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— মাছ-মাংস, ডিম, ডালশস্য এবং বিভিন্ন আনাজ ও ভোজ্য তেল সুষম খাদ্য তালিকায় অপরিহার্য, অথচ পরিসংখ্যান মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে এই খাদ্য উপাদানগুলির মূল্যবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ১৬.৬৮ শতাংশ, ১০.৫৫ শতাংশ, ৭.৫১ শতাংশ এবং ভোজ্য তেলের ক্ষেত্রে সর্বাধিক, ২৫.৯১ শতাংশ। আনাজের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক (-১৪ শতাংশের কাছাকাছি) হলেও এর কোনও সদর্থক প্রভাব গড় ভারতীয়ের ক্রয়ক্ষমতা-সমর্থিত খাদ্যের ঝুড়ির (ফুড বাস্কেট) উপর পড়ার সম্ভবনা নিতান্ত কম।
ভারতের মতো দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের আলোচনায় জনসংখ্যার একটি বড় অংশের মানুষ যে তাঁদের মৌলিক এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনের আধিকার থেকে বঞ্চিত, সে প্রসঙ্গ বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতীয়রা প্রতিনিয়ত যে বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার হন, সেই সমস্যার এক সার্বিক ও সুদূরপ্রসারী সমাধান সম্ভব সুশাসনের মাধ্যমে, রাষ্ট্রের সুপরিকল্পিত পদক্ষেপের দ্বারা, যা স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও বার বার বহু প্রচেষ্টা সত্ত্বেও অধরাই রয়ে গিয়েছে। অতিমারির মুহুর্মুহু ঢেউয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত, বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বিশেষজ্ঞরা যখন কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা এবং অর্থনীতির হাল ফেরাতে রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে সরব, তখন বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতে দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাওয়ার মতো মৌলিক অধিকারও বৃহৎ অংশের নাগরিকের জন্য সুরক্ষিত নয়। এ অতি দুর্ভাগ্যের বিষয়। আরও দুর্ভাগ্যের হল, এই ব্যর্থতার পিছনে সফল হওয়ার কোনও চেষ্টাও নেই— এ যেন গোড়া থেকেই হার মেনে নেওয়ার অনিবার্য ফল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy