অধিকারী: নিজের মত প্রকাশের জন্যে ধৈর্যসহকারে অপেক্ষা, খাগাড়িয়া, বিহার, ৭ মে। ছবি পিটিআই।
বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা নদীর জল দেখেছেন? সেই জলে বড়-বড় ঢেউ থাকে না। জল অন্যত্র বয়েও যায় না। এ বারের লোকসভা নির্বাচন সেই বাঁধ দিয়ে আটকে রাখা জলের মতো। ঢেউ নেই। নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে নেই। রাহুল গান্ধী তথা ইন্ডিয়া জোটের পক্ষেও নেই।
এখন নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে কোনও ‘ওয়েভ’ বা ঢেউ নেই বলে যদি ধরে নেন, এ বারের ভোটে তাঁর কোনও ভূমিকা নেই, বা তিনি কোনও ‘ফ্যাক্টর’ নন, তা হলে ভুল করবেন। কারণ ওই যে নিস্তরঙ্গ জল, তা বাঁধ দিয়ে বিজেপির পক্ষে ধরে রাখার কাজটি করছেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪-য় তিনিই বিজেপির হয়ে ভোট টেনেছিলেন। ২০১৯-এও বিজেপির হয়ে আগের থেকেও বেশি ভোট টেনেছিলেন মোদী। এ বার তাঁর কাজ, বাঁধের মতো বিজেপির সেই ভোট আগলে রাখা।
আর মাত্র চার দিন পরেই ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ভোটগণনা। যদি দেখা যায়, বিজেপি ‘চারশো পার’ করতে না পারলেও ২০১৯-এর মতোই শ’তিনেক আসন পেয়ে ফের সরকার গড়তে চলেছে, তা হলে সেই কৃতিত্ব নরেন্দ্র মোদীর। এবং বিজেপির সাংগঠনিক ক্ষমতার। আর তা না হলে সেই দায়ও হয়তো নরেন্দ্র মোদীকেই নিতে হবে।
এ বারের লোকসভা ভোট শুধু নিস্তরঙ্গ নয়, নিশ্চুপও। সাধারণ ভোটাররা কারও পক্ষেই জোর গলায় মুখ খুলছেন না। উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতের জেলায় জেলায় ঘুরলে একটা বিষয় স্পষ্ট। তা হল, গত দশ বছরে মোদী সরকারের প্রতি নানা কারণে ক্ষোভ জন্মেছে। বেকারত্ব নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। সেনায় মাত্র চার বছরের জন্য নিয়োগের অগ্নিবীর প্রকল্প তরুণদের মধ্যে প্রবল হতাশা তৈরি করেছে। মূল্যবৃদ্ধি, রান্নার গ্যাস, পেট্রল-ডিজ়েল থেকে ওষুধের দাম গৃহস্থের চিন্তা বাড়িয়েছে। কোথাও কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ছোট ব্যবসায়ীরাও ক্ষুব্ধ। বিরোধীরা প্রথমে একে সরকার বিরোধী ‘আন্ডারকারেন্ট’ বা চোরাস্রোত বলছিলেন। বাস্তবে সাত দফা ভোটের প্রথম দিকে যে সরকার বিরোধী ক্ষোভ চোরাস্রোতের মতো বইছিল, এখন অনেক জায়গাতেই তা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। রাস্তাঘাটে মানুষ নিজেদের সমস্যার কথা প্রকাশ্যে বলছেন। বিরোধী মঞ্চ ইন্ডিয়া-র নেতারা হয়তো এই ক্ষোভ আগে টের পাননি। তা হলে রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদবরা এখন যে পরিশ্রম করছেন, তা অন্তত ছয় মাস আগে থেকে শুরু করতেন।
প্রশ্ন হল, মানুষের এই ক্ষোভ কি ক্রোধে পরিণত হয়েছে? ভোটাররা কি এতটাই রেগে গিয়েছেন যে তাঁরা যে কোনও উপায়ে নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে চান? না কি ক্ষোভ থাকলেও কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর পদে নরেন্দ্র মোদীর আর কোনও বিকল্প দেখতে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সেই মোদীর পক্ষেই ভোট পড়বে? ‘নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বিরক্তি রয়েছে, কিন্তু বিকল্প কোথায়’— এই দ্বিধা থেকেই মানুষ সেই ভাবে ভোট দিতে বার হচ্ছেন না?
এতে কোনও সংশয় নেই, দশ বছর আগে নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে উন্মাদনা ছিল, সেই উন্মাদনা আর নেই। বিজেপি নেতাদের কেউ-কেউ একে ‘লয়ালটি ফেটিগ’ বলছেন। অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদীকে খুবই পছন্দ করতে করতে মানুষ ক্লান্ত। তাই তাঁকে নিয়ে উন্মাদনা কম। তবে সেটা অপছন্দের জায়গায় চলে যায়নি। এ বারের নির্বাচনে তাই সব থেকে বড় প্রশ্ন, বিজেপির থেকে ভোট বিরোধীদের দিকে সরবে কি না? সেখানে যদি নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প দেখতে না পেয়ে মানুষ শেষে বিজেপিকেই ভোট দেন, তাতেও মোদীর সাফল্য।
এখানে আরও একটি প্রশ্ন জরুরি। তা হল, বিজেপির থেকে ভোট সরলেও কতখানি সরবে? ২০১৪-য় বিজেপি প্রায় ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে লোকসভায় ২৮২টি আসন জিতেছিল। ২০০৯-এর থেকে বিজেপির ভোট বেড়েছিল ১২ শতাংশের বেশি। ২০১৯-এ বিজেপি আরও ৬ শতাংশের বেশি ভোট বাড়িয়ে ৩০৩টি আসন জেতে। এই ৩০৩টি আসনের মধ্যে ১০৫টি আসনে বিজেপি ৩ লক্ষের বেশি ভোটের ব্যবধানে জিতেছিল। ৪৪টি আসন জিতেছিল ৪ লক্ষের বেশি ভোটে। ১৫টি আসনে বিজেপির জয়ের ব্যবধান ছিল ৫ লক্ষের বেশি। যার অর্থ, বিজেপির থেকে অনেকখানি ভোট সরলে তবেই বিজেপি হারতে পারে, নচেৎ নয়।
এ বারের লোকসভা ভোট আরও একটি কারণে অন্য বারের থেকে আলাদা। তা হল, এই নির্বাচনে ‘সব কিছু ছাপিয়ে যাওয়া’ কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয় নেই। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে বাকি সব প্রশ্ন পিছনে সরিয়ে ইউপিএ সরকারের প্রতি ক্ষোভ ও নরেন্দ্র মোদীর ‘অচ্ছে দিন’-এর স্বপ্ন মূল বিষয় হয়ে উঠেছিল। ২০১৯-এ পুলওয়ামায় সিআরপি কনভয়ে হামলার পরে বালাকোটে বায়ুসেনার হানায় নোট বাতিলের সময়ের হেনস্থাও ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। এ বার তেমন কোনও জাতীয় স্তরের বিষয় নেই। গত জানুয়ারি মাসে রামমন্দিরের প্রাণপ্রতিষ্ঠার পরে বিরোধীরা ধরে নিয়েছিলেন, এ বার রামমন্দিরের আবেগে নির্বাচনের বাকি সব প্রশ্ন সরযূর জলে ভেসে যাবে। চার মাস পরে রামমন্দির আবেগ যে কাজ করছে না, তা বিজেপি শিবিরও মেনে নিচ্ছে।
এই কারণেই দিল্লিতে বসে থাকা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে এ বারের ভোটের ফল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন হয়ে উঠছে। কোনও জাতীয় বিষয় নেই। ফলে স্থানীয় সমস্যা, স্থানীয় স্তরে জাতপাতের সমীকরণ, স্থানীয় সাংসদের জনপ্রিয়তা বা ব্যর্থতা বড় হয়ে উঠছে। নির্বাচনের মাঠে-ময়দানে ঘুরলে বোঝা যাচ্ছে, প্রায় সব রাজ্যেই কোথায় কাকে প্রার্থী করা হয়েছে, টিকিট না পেয়ে কে ক্ষুব্ধ, সেই ক্ষুব্ধ প্রার্থী ভোট কাটবেন কি না, শাসক বা বিরোধীদের ভোট কাটার জন্য অন্য কোনও দল প্রার্থী দিয়েছে কি না, এ সব প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। একটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে আর একটি লোকসভা কেন্দ্রে সমীকরণ পাল্টে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, এক-একটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যেও জাত, সম্প্রদায়, এলাকা ভিত্তিক বিপরীতমুখী মনোভাব ফুটে উঠছে।
এ ক্ষেত্রে বিজেপি নিজের সাংগঠনিক শক্তি ও ভোটব্যবস্থাপনায় বিরোধীদের টেক্কা দিতে পারে। যেমন রায়বরেলীতে বিজেপির প্রার্থী নিয়ে স্থানীয় বিধায়করা ক্ষুব্ধ বলে অমিত শাহ নিজে তাঁদের বাড়ি গিয়ে বা প্রচারের মঞ্চে পাশে বসিয়ে অন্তর্বিরোধ কাটানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ বার ভোটারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব পরিবারের মধ্যেও বিভাজন তৈরি করছে। উত্তরপ্রদেশের কোনও পরিবারের বড় ভাই হয়তো বিজেপি সরকারের কাজে সন্তুষ্ট। মোদী সরকারের থেকে বিনামূল্যে রেশন মিলছে। যোগী সরকারের আমলে আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়েছে। অথচ সেই বাড়ির ছোট ভাই সেনায় চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সে অগ্নিবীর প্রকল্পে হতাশ। কোনও বাড়ির ছেলে মোদী সরকারের মুদ্রা-প্রকল্পে ঋণ পেয়ে ব্যবসা শুরু করেছে বলে খুশি। তার মা রান্নার গ্যাসের চড়া দাম বা মোদীর মঙ্গলসূত্র নিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টায় বিরক্ত। দেশের রাজধানী দিল্লি দূরে থাক। রাজ্যের রাজধানীতে বসেও তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে না।
হয়তো বিজেপি আগেই টের পেয়েছিল, স্থানীয় বিষয় এ বারের নির্বাচনে বড় হয়ে উঠবে। তাই গত লোকসভা ভোটে জিতে আসা ৩০৩ জন সাংসদের মধ্যে ১৩২ জনকেই প্রার্থী করেনি বিজেপি। অর্থাৎ গত বারের জেতা আসনের প্রায় ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী বদল করেছে। ২০১৯-এ অমিত শাহ একই টোটকা প্রয়োগ করে সাফল্য পেয়েছিলেন। সে বার বিজেপি যে সব আসনে সাংসদ বদল করেছিল, তার মধ্যে ১০টির মধ্যে ৯টি আসনেই বিজেপি সাফল্য পেয়েছিল। আবার বিজেপি যে সব আসনে সাংসদ বদল করেনি, সেখানেও বিজেপির জয়ের হার প্রায় একই রকম ছিল।
এখানেই বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি ও ভোটব্যবস্থাপনার সাফল্য। বিজেপির নিচু তলায় সংগঠন মজবুত বলেই টের পেয়েছে, কোথায় কোন সাংসদ জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, আর কোথায় কার ভোটব্যাঙ্ক এখনও অটুট। এর সঙ্গে ভোটব্যবস্থাপনার জোরে বিজেপি বিরোধীদের, বিশেষ করে দুর্বল সংগঠনের কংগ্রেসকে টেক্কা দিতে পারে। সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ ভোটাররা যদি ভোট দিতে উৎসাহ না দেখান, তা হলে নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ককে বুথ পর্যন্ত টেনে আনতে পারলেই বিজেপির সাফল্য বাঁধা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy