হদিস: হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে আগে এক জনসভায় রাহুল গান্ধী ও রাজ্যের জাঠ নেতা ভূপেন্দ্র সিংহ হুদা, হিসার। ২৬ সেপ্টেম্বর। ছবি: পিটিআই।
দিল্লির রাজাজি মার্গে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গের সরকারি বাসভবন। বাংলোর দেখাশোনার কর্মী, গাড়ির চালক, মালিদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঘাসের লনেই খেলে বেড়ায়। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে তাদের দারুণ দোস্তি। রাহুল গেলেই তারা দেখা করতে আসে। রাহুল তাদের জন্য পকেটে করে টফি-লজেন্স নিয়ে যান।
হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের অপ্রত্যাশিত হারের পরে রাহুল গান্ধী কংগ্রেস সভাপতির বাড়িতে ভোটের ফল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। বৈঠক সেরে বার হতেই খুদেরা হাজির। তারা তখন লুকোচুরি খেলছে। রাহুল গান্ধী এক জনের চোখ হাত দিয়ে চেপে ধরলেন। বাকিরা বাংলোর আনাচে-কানাচে লুকিয়ে পড়ল।
রাহুল গান্ধীর সমস্যা হল, কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারাও তাঁর সঙ্গে এমন প্রায়ই লুকোচুরি খেলেন। কংগ্রেসের সংগঠনের হাল নিয়ে তাঁরা রাহুলের সামনে ভুল ছবি তুলে ধরেন। রাহুল অধিকাংশ সময়ই তা টের পান। কিন্তু সব সময় যে কিছু করে উঠতে পারেন, তা নয়। আর তার ফলেই হরিয়ানার ভোটে কংগ্রেসের ‘নিশ্চিত জয়’ সত্ত্বেও বিজেপির কাছে হেরে যেতে হয়। এ বার যেমন হরিয়ানার জাঠ নেতা ভূপেন্দ্র সিংহ হুডা থেকে দলিত নেত্রী কুমারী শৈলজা, আর এক জাঠ নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা রাহুল গান্ধীর সঙ্গে গোটা হরিয়ানার ভোটে লুকোচুরি খেললেন। হুডা বুঝিয়েছিলেন, তিনি একাই হরিয়ানায় কংগ্রেসকে জিতিয়ে আনবেন। কিন্তু তিনি এটা কংগ্রেস হাই কম্যান্ডকে জানাননি যে গত ১২ বছর ধরে হরিয়ানার মতো রাজ্যে কংগ্রেসের জেলা ও ব্লক সভাপতি নেই। যে কোনও দলের জেলা ও ব্লক কমিটি দলের সংগঠনের প্রধান ভিত। তার সঙ্গে নির্বাচনের সময় দলের বুথ কমিটির ভূমিকা অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে। কারণ বুথ কমিটিই নিশ্চিত করে যে দলের সমর্থকরা ভোটগ্রহণের দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে ভোট দিতে যাবেন। কংগ্রেস এখানেই পিছিয়ে থেকেছে।
উপরন্তু হরিয়ানায় হুডার হাতেই সব ‘দায়িত্ব’ (পড়ুন ক্ষমতা) দেখে শৈলজা, সুরজেওয়ালার মতো বাকি নেতানেত্রীরা কার্যত হাত গুটিয়ে ফেলেন। জাঠ নেতা হুডাই কংগ্রেসের মুখ হয়ে ওঠায় বিজেপি ভয় দেখিয়েছিল, জাঠরা ক্ষমতায় এলে তাদের ঝুলিতেই যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা চলে যাবে। এই প্রচারে জাঠ ছাড়া বাকি সব সম্প্রদায় বিজেপির পিছনে এককাট্টা হয়। এই কৌশলেই বিজেপি হারা ম্যাচ জিতে বেরিয়ে যায়।
চার বছর আগে কংগ্রেসের ২৩ জন নেতা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে দলের হালচাল নিয়ে সনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেছিলেন। রাহুল গান্ধী তার আগেই ২০১৯-এ লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবি নিয়ে সভাপতির দায়িত্ব ছেড়েছেন। সনিয়া অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর দায়িত্বে। জি-২৩ বনামে বিখ্যাত হয়ে ওঠা সেই বিক্ষুব্ধ কংগ্রেস নেতাদের অভিযোগ ছিল, কংগ্রেস শীর্ষনেতৃত্ব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তাঁদের প্রশ্ন ছিল, ইন্দিরা গান্ধী সাতাত্তর সালে হারের পরে কংগ্রেসের হাল ফেরাতে ভারত সফরে বেরিয়ে পড়েছিলেন। রাহুল গান্ধী তাঁর ঠাকুমার দেখানো সেই পথে হাঁটছেন না কেন? তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী জোটকে এককাট্টা করছেন না কেন? কেন তিনি বিজেপি-আরএসএস নামক রাজনৈতিক যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়বার মতো কংগ্রেসের সংগঠন তৈরি করছেন না?
চার বছরে কংগ্রেসের অন্দরমহলে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। রাহুল গান্ধী দু’বার ভারত জোড়ো যাত্রা করেছেন। এক বার কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর। দ্বিতীয় বার মণিপুর থেকে মহারাষ্ট্র। তাতে রাহুলের নিজস্ব ভাবমূর্তি বদলেছে। তিনি নিজেও আত্মবিশ্বাস পেয়েছেন। কংগ্রেসের থেকে যে ভোটাররা একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, তাঁরা আবার উৎসাহিত হয়েছেন। লোকসভা ভোটের আগে তাঁর সংবিধান হাতে প্রচার, জাতগণনার দাবি দলিত, জনজাতি, ওবিসি ভোটব্যাঙ্কে প্রভাব ফেলেছিল। বিজেপির বিরুদ্ধে সমস্ত বিরোধী দলকে এককাট্টা করে ইন্ডিয়া জোট গঠনেও সব রকম চেষ্টা করেছিলেন রাহুল। লোকসভা ভোটে বিজেপিকে যে বিরোধীরা ধাক্কা দিতে পেরেছেন, বিজেপি যে একার জোরে সরকার গঠনের সংখ্যা জোগাড় করতে পারেনি, তা সেই সব প্রচেষ্টারই ফল। ভোটের পরে তিনি লোকসভায় বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব নিয়েছেন।
এখনও রাহুল গান্ধীর আর একটি কঠিন কাজ বাকি। তা হল, কংগ্রেসের সংগঠনের হাল ফেরানো ও রাজ্যে রাজ্যে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে লাগাম পরানো। বিগত লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের আসন বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু যে সব রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির সরাসরি লড়াই, সেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, কর্নাটকে কংগ্রেস মোটেই আশানুরূপ ফল করতে পারেনি। কংগ্রেস এই রাজ্যগুলিতে বিজেপির সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে ভাল ফল করতে পারলে বিজেপির আসন আরও কমত। এনডিএ-র পক্ষে সরকার গঠনই সম্ভব হত না। হরিয়ানায় লোকসভা ভোটে কংগ্রেস দলিত, ওবিসি ভোট নিজের দিকে টানতে পেরেছিল। বিধানসভা ভোটে তা আবার হাতছাড়া হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যে কংগ্রেস ভাল ফল করেছে মূলত শরিক দলগুলির কাঁধে ভর করে। এ বার হরিয়ানায় হেরে গেলেও জম্মু-কাশ্মীরে কংগ্রেসের ভাল ফলের পিছনে অনেকখানি কৃতিত্ব জোটসঙ্গী ওমর আবদুল্লার ন্যাশনাল কনফারেন্সের। লোকসভা নির্বাচনের পরে সংসদে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন, তা হল: কংগ্রেস ইন্ডিয়া-র শরিকদের কাঁধে ভর করে ডঙ্কা বাজাচ্ছে।
কংগ্রেস যে লোকসভা ভোটে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকে ভাল করতে পারেনি, কিংবা হরিয়ানার বিধানসভা ভোটে হেরে গিয়েছে, তার কারণ হল সাংগঠনিক দুর্বলতা ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। রাহুল গান্ধী, মল্লিকার্জুন খড়্গেরা যেখানেই কমল নাথ, অশোক গহলৌত বা ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার মতো এক জনের কাঁধে যাবতীয় দায়িত্ব সঁপে দিয়ে ভোটে জিততে চেয়েছেন, সেখানেই কংগ্রেস ডুবেছে। কারণ বাকি কংগ্রেস নেতারা তখন নিষ্ক্রিয় হয়ে থেকেছেন। হরিয়ানায় রাহুল গান্ধী শত চেষ্টা করেও ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার সঙ্গে কুমারী শৈলজাকে মাত্র এক বার এক মঞ্চে আনতে পেরেছিলেন। কংগ্রেসের হাল যতই করুণ হোক, রাজ্যে রাজ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের অভাব নেই। অনেক নেতাই ভোটের সময় শুধু নিজের এলাকা, নিজের আসনে জয় বা নিজের পরিবারের সদস্য বা অনুগামীদের জেতাতে ব্যস্ত থাকেন। আর সাংগঠনিক দুর্বলতার মাপকাঠিতে কংগ্রেসের রাজ্যের মুখিয়ারা একে অন্যকে রীতিমতো প্রতিযোগিতায় ফেলে দিতে পারেন।
রাহুল গান্ধীর এ সব অজানা নয়। ২০১৯-এ কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার সময়ও তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন, দলের নেতারা নিজের স্বার্থসিদ্ধিতে ব্যস্ত ছিলেন। কেউ শুধু নিজের আসন জিততে, কেউ বা ছেলেকে জেতাতে ব্যস্ত ছিলেন। এ বার হরিয়ানা নির্বাচনে কংগ্রেসের হারের ময়নাতদন্ত করতে বসেও বৈঠকের মধ্যে রাহুল গান্ধী বলেছেন, হরিয়ানায় তাঁর দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে লড়াইতে ব্যস্ত ছিলেন। নিজের দলের নেতাদের দিকে আঙুল তুলে তিনি বলেছেন, তাঁরা সবাই নিজের স্বার্থের কথা ভেবেছেন। দলের স্বার্থের কথা ভাবেননি।
আঙুল তুলে অবশ্য রাহুল গান্ধী নিজের দায়িত্ব সেরে ফেলতে পারেন না। কংগ্রেসের হাল ফেরাতে তাঁকেই ভারত জোড়ো যাত্রা করতে হয়েছিল। সংগঠনের হাল ফেরাতে হলে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রাশ টানতে হলে তাঁকেই লাগাম ধরতে হবে। কারণ, কার্যত এক মাস পরেই মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচন। মহারাষ্ট্রেও বিজেপি জোট চাপের মুখে। তা সত্ত্বেও যদি বিজেপি জিতে যায়, তা হলে লোকসভা ভোটের পরে বিজেপি তথা মোদী সরকারের উপরে যে চাপ তৈরি করতে পেরেছেন বিরোধীরা, তা অনেকটাই আলগা হয়ে যাবে। এই মহারাষ্ট্রেও কংগ্রেস গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ। শরদ পওয়ার, উদ্ধব ঠাকরের মতো জোট শরিকরা ইতিমধ্যেইকংগ্রেসকে এ নিয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি কি মহারাষ্ট্রের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা সামলাতে পারবেন! রাহুল গান্ধীর সামনে এখন এটিই নতুন পরীক্ষা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy