ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিই আদতে জটিল। কী ভাবে এর পরিমাণ নির্ধারিত হয়? ক্ষতিপূরণে প্রাপ্ত অর্থ কী ভাবে ব্যয় করা হবে, তা কে বা কারা নির্ধারণ করেন?
নামিবিয়ায় জার্মানির ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
এক বছর আগে জার্মানি নামিবিয়াকে একটি বিশেষ কারণে আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে রাজি হয়। এই ক্ষতিপূরণ প্রদানের কারণ— ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী জার্মানি তার তদানীন্তন উপনিবেশ নামিবিয়ায় এক গণহত্যা চালিয়েছিল। সেই ‘ঔপনিবেশিক’ গণহত্যার প্রেক্ষিতেই ক্ষতিপূরণ।
যে পরিমাণ অর্থ আজকের জার্মানি নামিবিয়াকে দিতে চেয়েছিল, তা নিতান্তই নগণ্য (৩০ বছর ধরে জার্মানি নামিবিয়ায় উন্নয়নশীল কর্মকাণ্ড চালানোর জন্য ১.১ বিলিয়ন ইউরো প্রদান করতে চেয়েছিল)। মনে রাখা প্রয়োজন, এই সংক্রান্ত নথিপত্রে কোথাও ‘ক্ষতিপূরণ’ বা ‘রেপারেশন’ শব্দটির উল্লেখ ছিল না। এই ধরনের আপসকে ঘিরে নামিবিয়ার অভ্যন্তরে প্রবল বিরোধিতার সৃষ্টি হয়। এবং এই চুক্তি সম্পাদন শেষ পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়।
অন্য দিকে, গত বছরেই আমেরিকার ইলিনয় স্টেটের ইভানস্টোন শহর তার ১২ হাজার আফ্রো-আমেরিকান বাসিন্দাদের মধ্যে থেকে বাছাই কিছু মানুষকে দাসপ্রথা সংক্রান্ত বিষয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ মিলিয়ন আমেরিকান ডলার প্রদান করে। এই মর্মে এই অর্থ প্রদত্ত হয় যে, অতীতে আবাসন সংক্রান্ত বৈষম্যের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই টাকা দেওয়া হচ্ছে। সমালোচকরা এ ক্ষেত্রেও বলেন যে, এই অর্থের পরিমাণ অতি নগণ্য। ইতিমধ্যে তাঁর নির্বাচনী প্রচারে জো বাইডেন আফ্রো-আমেরিকানদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়ে একটি কমিশন গঠনের বিষয়ে সমর্থন জানাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। আমেরিকার বিভিন্ন সংগঠন এখন তাঁকে এই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নের জন্য চাপ প্রদান শুরু করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে আইন পাশ হওয়া কার্যত দুরূহ।
নামিবিয়ায় জার্মানির ঔপনিবেশিকতার ইতিহাস নিষ্ঠুরতায় পূর্ণ। নামিবিয়ার উপজাতীয় বাসিন্দাদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়, তাঁদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় এবং কালাহারি মরুভূমিতে প্রচুর মানুষকে নিয়ে গিয়ে পানীয় জল না দিয়ে মেরে ফেলা হয়। গণহত্যা তথা গণনির্যাতনের এই সব কৌশলের মধ্যে বেশ কিছু পরে নাৎসিরা অনুসরণ করে (যার মধ্যে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, বন্দিদের অনাহারে রেখে অমানুষিক পরিশ্রম করানো, সাদা চামড়ার মানুষদের জাতিগত উৎকর্ষ প্রমাণের জন্য বন্দিদের উপর চিকিৎসা বিজ্ঞানের নিরীক্ষা চালানো এবং এ সবের সঙ্গে আরও বিবিধ প্রক্রিয়ায় একটি জনগোষ্ঠীকে কার্যত নিশ্চিহ্ন করে ফেলা ইত্যাদি)। এই সব নির্যাতনের বহু কিছুই জার্মান অধিকৃত সেই সময়কার দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকায় সংঘটিত হয়েছিল।
বিশ্ব-ইতিহাসে ক্ষতিপূরণের দাবি নতুন কিছু নয়। বিশেষ করে যুদ্ধ সংক্রান্ত ক্ষতিপূরণের। ১৮৭০-’৭১ সালের ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পরে জার্মানরা ফ্রান্সের কাছ থেকে সেই পরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করে, যা উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নেপোলিয়ন প্রুশিয়ার কাছ থেকে আদায় করেছিলেন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানির কাছ থেকে মিত্রশক্তি ক্ষতিপূরণ আদায় করে। হলোকাস্ট-কালীন ইহুদি গণহত্যা ও তাঁদের সম্পত্তি লুটের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানি ১৪ বছর ধরে তিন বিলিয়ন মার্ক ইজরায়েলকে প্রদান করে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতা এবং দাসপ্রথার প্রেক্ষিত থেকে দেখলে মনে হবে, ‘ক্ষতিপূরণ’ বিষয়টি একান্ত ভাবেই ‘দাস’-দের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছিল। ‘দাসমালিক’-দের থেকে নয়!
বর্তমানে হাইতি নামে পরিচিত ভূখণ্ডে ১৭৯১ সালে ঘটে যাওয়া ইতিহাস-প্রসিদ্ধ দাসবিদ্রোহের (যা কার্যত দাস-ব্যবসার গতিছন্দকেই বদলে দেয়) পরে ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে দশকের পর দশক যুদ্ধ করে ফ্রান্স এমন এক শর্ত বিদ্রোহীদের উপর চাপিয়ে দেয়, যা অতি অদ্ভুত। রণক্লান্ত ফ্রান্স জানায় যে, দাসমালিকদের ‘সম্পত্তি ধ্বংসের’ কারণে যদি হাইতির বার্ষিক উৎপাদনের তিন গুণ প্রদান করা হয়, তবে তারা বিদ্রোহীদের রেয়াত করবে। ফ্রান্সকে ৭৫ বছর ধরে এই অর্থ (সুদ ও আসল সমেত) প্রদান করতে হয়েছিল। পরে হাইতি আমেরিকার অধিকারে গেলেও দু’দশক ধরে এই ক্ষতিপূরণ প্রদান অব্যাহত থাকে।
সেই বিপুল পরিমাণ অর্থ নির্গমণের কারণে হাইতির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। বর্তমানে হাইতি বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির একটি। ফরাসি অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি তাঁর সাম্প্রতিকতম গ্রন্থ ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব ইক্যুয়ালিটি’-তে এই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন যে, এই মুহূর্তে যদি ফ্রান্স সেই অর্থ হাইতিকে ফিরিয়ে দেয়, তা হলে কী হবে? পিকেটি হিসেব কষে দেখেছেন, হাইতির সাম্প্রতিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তিন গুণ হল ৩০ বিলিয়ন ইউরো (যা ফ্রান্সের জিডিপি-র ১ শতাংশ)। এ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা ও বিতর্কের ঢল নেমেছে। কিন্তু পিকেটির যুক্তি এই যে, তাতে প্রসঙ্গটিকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
দাসমালিকরা যে 'অপরাধী নয়' বরং তারাই ‘অবিচারের শিকার’— এমন একটি ধারণা দাসপ্রথা সংক্রান্ত বিতর্কে বেশ ভাল ভাবেই প্রবিষ্ট। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ফরাসি দার্শনিক মন্তেস্কু (১৬৮৯-১৭৫৫) প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, মুক্তিপ্রাপ্ত দাসেরা যদি কম পারিশ্রমিকে ১০ থেকে ২০ বছর কাজ করে, তবে দাসপ্রথা উচ্ছেদের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দাসমালিকরা যথাযথ পরিমাণে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্ত হবেন। ১৯ শতকে যখন বিভিন্ন দেশে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা শুরু হয়, তখন ব্রিটেন এবং অন্যান্য দেশ দাসমালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান করেছিল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে মুক্তিপ্রাপ্ত দাসেদের ইউনিয়নের পক্ষে লড়াই করতে এই বলে রাজি করানো হয় যে, যুদ্ধ শেষ হলে তাদের প্রত্যেককে ৪০ একর জমি এবং একটি করে খচ্চর প্রদান করা হবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি কখনই পূরণ করা হয়নি।
ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিষয়টিই আদতে জটিল। কী ভাবে এর পরিমাণ নির্ধারিত হয়? ক্ষতিপূরণে প্রাপ্ত অর্থ কী ভাবে ব্যয় করা হবে, তা কে বা কারা নির্ধারণ করেন? যদি এই অর্থ বণ্টন করে দেওয়া হয়, তা হলে কে কী পরিমাণ পাবেন? নগদে, নাকি অন্য খাতে (যথা, শিক্ষা) তা দেওয়া হবে? যদি ইউনিয়ন কার্বাইড ভোপাল গ্যাস দুর্ঘটনার কারণে সরকারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে থাকে এবং এই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা দুর্দশার মধ্যেই থেকে যান, তা হলে কি বিষয়টি শেষ পর্যন্ত খুব সুখকর হবে?
ভারত ও চিনের মতো বৃহদায়তন দেশের ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক শক্তি যে পরিমাণ ক্ষতি করেছে, তা মাথায় রাখলে দেখা যাবে, কোনও ক্ষতিপূরণই যথেষ্ট নয়। এমনকি, যখন পরিবেশ অথবা বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তিগুলির প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে বিরক্তির সঙ্গে সামান্য ‘ছাড়’ দেওয়া হয়, তখন কেউ কি আশা করেন যে সেই সব ‘ছাড়’ ঔপনিবেশিকতা-প্রসূত ক্ষয়-ক্ষতির নিরিখে যথাযথ? সুতরাং একদা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি যদি তাদের কর্মকাণ্ডে স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকে অঙ্গীভূত করে, তা হলে কি তাদের উপনিবেশকে শোষণ করে ধনী হয়ে ওঠার বিষয়টি বিস্মৃতির আড়ালে চলে যাবে? কে, কী পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা লাভবান— এই প্রশ্নটি কিন্তু থেকেই যায়। এই মুহূর্তে ইতিহাস থেকে ঔপনিবেশিক কর্মকাণ্ডের এই সব দিকগুলিকে রং চড়িয়ে মেরামতির কাজ শুরু হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy