E-Paper

শিকল গড়ার কারখানা

গত দু’দশক ধরে ভারতে মহিলাদের সবেতন কাজে অংশগ্রহণ করার প্রবণতা ক্রমাগত কমেছে। যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় খুবই আলাদা।

অরিজিতা দত্ত

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৩৪
Share
Save

মিছিলে হাঁটছিল শর্বরী। ওর মেয়ে একটা সরকারি মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন, ৩৬ ঘণ্টা একটানা ডিউটি মেয়ের কাছে জলভাত। বেশি রাত পর্যন্ত ডিউটি থাকলে শর্বরী বলত, “হাসপাতালে থেকে যাস, ভোরে ক্যাব নিয়ে চলে আসিস।” কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে শর্বরীর মতো অনেক মাকে। কাজের জায়গাটা কি মেয়েদের জন্যে এতটাই অসুরক্ষিত হয়ে গেল? তা হলে মেয়েরা বাড়ির বাইরে কাজে বেরোবে কী করে? অনেকে আশঙ্কা করছেন, এই ভয়ঙ্কর ঘটনা মেয়েদের কর্মক্ষেত্র থেকে আরও দূরে ঠেলে দেবে।

গত দু’দশক ধরে ভারতে মহিলাদের সবেতন কাজে অংশগ্রহণ করার প্রবণতা ক্রমাগত কমেছে। যা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় খুবই আলাদা। কোনও মেয়ে রোজগার করবে, না কি কাজ ছেড়ে দেবে, তার পিছনে মেয়েটির শিক্ষাগত যোগ্যতা, বয়স, বিবাহ, পরিবারের আর্থিক অবস্থা, পরিবারতন্ত্র, স্বামীর শিক্ষার স্তর ইত্যাদির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে, বেশি শিক্ষিত মহিলারা বেশি শিক্ষিত পুরুষকে বিয়ে করে, স্বাভাবিক ভাবেই সেই পুরুষের আয় করার ক্ষমতা বেশি হয়। ফলে সেই বাড়িতে মহিলাদের উপার্জন অপ্রয়োজনীয় ধরে নেওয়া হয়, ফলে মেয়েদের উপার্জন করার প্রবণতা কমে যায়। এই যুক্তির সত্যতা কিছুটা হলেও মেনে নিতে হয় যখন দেখি যে, শহুরে উচ্চশিক্ষিত পরিবারগুলির মধ্যে মেয়েদের উপার্জন করার প্রবণতা সবচেয়ে কম।

তবে এ ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব পায় বৃহত্তর সামাজিক অবস্থা। যে সমাজ মনে করে যে, বাইরে গিয়ে উপার্জন করা পুরুষের কাজ, আর বাড়ির অন্তঃপুরে থেকে সন্তান পালন, বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবা করা, বাড়ির যাবতীয় কাজ সামলানোর দায় সবটাই মেয়েদের, সেখানে স্বাভাবিক ভাবে মেয়েদের কাজে বেরোনো কঠিন হয়। তখনই মেয়েরা উপার্জনে বেরোয়, যখন সংসারে অনটন, হাঁড়ি চড়ে না। এই সামাজিক নিয়ম কিন্তু আপাত-আধুনিক ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও প্রবল।

তা হলে কি লেখাপড়া শিখেও মেয়েরা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারছে না? না কি, তারা কাজ করবে কি না, করলে কত ক্ষণ করবে, সে বিষয়ে তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নেয়? সম্প্রতি এ বিষয়ে আলোকপাত করেছে একটি গবেষণাপত্র। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) আর সুকন্যা সরখেলের (সেন্ট জেভিয়ার’স বিশ্ববিদ্যালয়) গবেষণা দেখাচ্ছে, মহিলারা অনেক সময়ই তাদের নিজেদের কাজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের মূলে যে বিবেচনাকে তারা সর্বাধিক গুরুত্ব দেয় তা হল, তারা বাড়ির কাজ করাটাকে কতটা প্রাথমিক দায়িত্ব বলে মনে করে। যদি তাদের কর্মক্ষেত্র অনেক দূরে হয়, বা দিনের অনেকটা সময় বাইরে কাজ করে, তাতে তাদের বিচারে কাজ করার ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থাৎ তারা হয়তো কাজ করে, কিন্তু তার থেকে পুরো উপযোগিতা পায় না, কারণ তারা বাড়ির কাজ কম করে। এই অসুবিধাটা স্বভাবতই বেশি হয় যদি পরিবারে পিতৃতন্ত্রের চাপ বেশি হয়। সে ক্ষেত্রে তাদের নানা অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়।

২০১১-১২’র ইন্ডিয়া হিউম্যান ডেভলপমেন্ট সার্ভে-র (আইএইচডিএস) তথ্য ব্যবহার করে গবেষকরা পরিবারতন্ত্রের একটা সূচক বার করেন। তার মধ্যে রয়েছে এই নির্ণায়কগুলি— বাড়ির জিনিসপত্র কেনা, সন্তানসংখ্যা, সন্তানের অসুখ করলে কোথায় চিকিৎসা হবে, আর ছেলেমেয়েদের বিয়েতে কী কী হবে, এ সব বিষয়ে বাড়ির মহিলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। এই সূচকে কোনও মহিলার স্থান কম হলে তাদের বাইরে কাজ করার সম্ভাবনা কম থাকে, বা কাজ করলেও বাড়ির কাছে এবং কম বেতনের কাজ নেওয়ার প্রবণতা বেশি। সেই কাজ অনেক সময়ই তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা বা দক্ষতার সমতুল হয় না। ফলত বাড়তে থাকে লিঙ্গভিত্তিক বেতনের ফারাক। অর্থাৎ সামাজিক নীতি শুধু নিয়োগকর্তার সংস্কৃতি নির্ধারণ করে না, মহিলাদের নিজেদের সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করে— কারণ তারা পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক রীতিনীতির আত্তীকরণ করে, এবং বিশ্বাস করে যে, তাদের প্রধান কাজ বাড়ির ও বাড়ির লোকেদের খেয়াল রাখা। এই বক্তব্যের অনেকটা মিল পাই যখন নানা বয়সের মহিলার সঙ্গে কথা বলে দেখি যে, যাদের সন্তান ছোট, তারা বাইরে কাজ করতে গেলে অপরাধবোধে ভোগে। তারা ভাবে, তারা শিশুর যত্ন নিতে পারছে না বা বাড়ির সকলকে অবহেলা করছে।

ফিরে আসি সমাজের অপরাধ প্রবণতা সম্পর্কে। যে কোনও সময় অপরাধ হতে পারে, এমন আশঙ্কা যেখানে বেশি, সেখানে মেয়েদের স্বাধীন চলাফেরা নিয়ে ভয়ও বেশি। সেই সঙ্গে, পরিবারের সামাজিক অবস্থানও নির্ধারণ করে, বাড়ির মেয়েরা কাজে যাবে কি না। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০১৪ থেকে ২০২২-এর মধ্যে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে প্রায় ৩১%, সবচেয়ে অসুরক্ষিত শহর দিল্লি, মুম্বই আর বেঙ্গালুরু। অঙ্কিতা মিশ্র এবং সহ-লেখকদের গবেষণা (২০০১) প্রমাণ করে, যে সব জায়গায় অপরাধ-প্রবণতা বাড়ে, সেখানে শুধু মহিলাদের কাজ করার উৎসাহ কমে তা নয়, সঙ্গে বাড়ে পুরুষদের নিয়োগ করার প্রবণতা, ফলত বাড়ে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গ-ভিত্তিক বৈষম্য। অন্য একটি গবেষণা জানায় যে, মহিলাদের উপরে অপরাধ এক শতাংশ বাড়লে, মহিলাদের বাড়ির বাইরে কাজ করার প্রবণতা কমে যায় ৯.৪%।

বাড়ির কাজ আর শিশুর দেখাশোনা করার জন্যে অনেক মহিলা বাড়িতে থাকতে চায়। তাই চাইল্ড কেয়ার লিভ, মেটারনিটি লিভ ইত্যাদি দিয়ে সরকার চেষ্টা করে কর্মনিযুক্ত মেয়েদের আয়ে ঘাটতির ক্ষতিপূরণ করতে। এই নীতি ভারত সরকারও গ্রহণ করেছে বেশ কিছু দিন আগে। কিন্তু যদি মহিলাদের প্রতি হিংসা, হয়রানি বেশি হয়, তা হলে নিরাপদে কাজে পৌঁছনো এবং সেখানে সুরক্ষিত থাকার খরচটা অনেকখানি বেশি হয়ে ওঠে? আমার বন্ধুর মতো অনেক বাবা-মা মেয়েকে বলেন, ট্রেন বা বাসে যাতায়াত এড়িয়ে গিয়ে, একটু বেশি খরচ করে অ্যাপ ক্যাব নিতে। কিন্তু এ ভাবে সুরক্ষিত যাতায়াতের খরচ বাড়তে থাকলে কাজকে আর লাভজনক মনে হবে না। অনেক মহিলাই নিজে থেকে, বা পরিবারের আদেশে, কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

অর্থাৎ সামগ্রিক ভাবে, নিয়োগকর্তা যেমন মহিলাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেন, তাদের অনেক কাজ করিয়েও কম বেতন দেন, তেমনই পরিবারতন্ত্রের চাপে মেয়েরা নিজেরাই এমন কাজ খুঁজে নেয়, যেটা তাদের বাড়ির কাজের সঙ্গে করতে সুবিধা হবে। বেশির ভাগ সময়েই যা কম বেতনের কাজ। অনেকেই শিক্ষকের চাকরি খোঁজে শিক্ষকতাকে ভালবেসে না, অনেক ছুটি পাবে এই আশায়। তাতে বাড়ির লোকেদের সুবিধা হবে। আর যেখানে অপরাধ বেশি, সেখানে লাঞ্ছিত হওয়ার ভয়ে অনেক মেয়ে কাজে যাওয়া ছেড়েই দেয়। আর জি কর কাণ্ডের পরে তাই মহিলাদের মধ্যে বাইরে বেরোনোর বিষয়ে অস্বস্তি, বা সন্ধ্যার পর কাজ করার বিষয়ে আশঙ্কা বাড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাইরে অপরাধের সম্ভাবনা আর বাড়িতে পিতৃতন্ত্রের রক্তচক্ষু, উভয়ই বহু দিন ধরে মহিলাদের কাজের জগৎ থেকে দূরে রেখেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আর্থিক উন্নয়নের পাশাপাশি ভারত এই দুই সমস্যা যথেষ্ট কমাতে পারেনি। তাই মহিলাদের শ্রমের বাজারে যোগদান বাড়ার চেয়ে নিম্নমুখী হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Safety Women Security Workplace Women Harassment RG Kar Medical College and Hospital Incident

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।