দুর্নিয়তি: সীমান্ত পেরিয়ে নতুন জীবনের সন্ধানে, ১৯৭১।
সবে তখন বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র উৎসব শুরু হয়েছে। অবধারিত পরবর্তী কাজ হিসাবে শুরু হল সংখ্যালঘু হিন্দু বৌদ্ধদের উপর আক্রমণ। তখন ফোন পেয়েছিলাম চট্টগ্রামের এক পরিচিত সাংবাদিকের। সামাজিক প্রতিষ্ঠিত মানুষ, আগের দিনই চট্টগ্রাম শহরে এই আক্রমণের বিরুদ্ধে বিশাল হিন্দু-বৌদ্ধদের মিছিল সমাবেশের এক জন সংগঠক। প্রায় দুই দশক আগে তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলাম দেশভাগের পর চট্টগ্রামে থেকে যাওয়া অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের শেষ বিপ্লবী শতবর্ষ পেরোনো বিনোদবিহারী চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে। দু’জনেই বলেছিলেন, এ আমাদের স্বভূমি, কেন ছেড়ে যাব? সেই সাংবাদিক ফোন করেছেন, আর থাকা যাবে না, অন্তত ছেলেটাকে পাঠিয়ে দেব ঠিক করে ফেলেছি। ফোনে একই কথা বললেন বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক বর্ষীয়ান সংগঠক। বললেন এত বছর অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে, কিন্তু বলেছি দেশ ছাড়ব না, এই প্রথম ভাবতে হচ্ছে এ বার দেশ ছাড়তেই হবে। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাবেন কোথায়, ভারত সরকার তো সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
দেখা গিয়েছে দুর্গাপুজোর উপর আক্রমণ, মূর্তি মণ্ডপ ভাঙা থেকে, চাঁদার হুমকি। বছর কয়েক আগেই বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক জ়াফর ইকবাল ফেসবুকে লিখেছিলেন যে দুর্গাপুজোর সময় এলেই তাঁর দুশ্চিন্তা বেড়ে যায় এ জন্য।
জুলাই মাসের বাংলাদেশে তথাকথিত ছাত্র-আন্দোলন এবং ৫ অগস্ট শেখ হাসিনার দেশত্যাগ ও সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর শুরু হল অভাবনীয় আক্রমণ। কেবল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ নয়, জোর করে কর্মচ্যুত করা হল হিন্দু অধ্যাপক, শিক্ষক থেকে সরকারি কর্মচারীদের। গত ২৬ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের ক্লিন্টন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের বার্ষিক সম্মেলনের ভাষণে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তির নোবেল-বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস কোনও বিভ্রান্তি না রেখে জানিয়ে দিলেন যে, বাংলাদেশের এই ‘বিপ্লব’ ছিল সুচিন্তিত ও পূর্ব-পরিকল্পিত। এই পূর্ব-পরিকল্পনার প্রধান মস্তিষ্ক মাফুজ় আবদুল্লাকে মঞ্চে নিয়ে পরিচয়ও করিয়ে দেন। প্রসঙ্গত, মাফুজ় আবদুল্লা এক জন পরিচিত ইসলামি সংগঠক।
বাংলাদেশে যা হচ্ছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার, ফলে চুপ থাকার কথা অনেকেই বলেন। বলেন বামমার্গী মানবাধিকারবাদীরা, এমনকি দক্ষিণপন্থী সর্বভারতীয় দলের দিল্লির কর্তারা, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাজ্যের নেতারাও। কিন্তু এই অরাজকতায়, ধর্মীয় অত্যাচারে একেবারে রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞায় মান্য শরণার্থীরা যদি ভারতে বাঁচতে আসতে চান তবে আমরা কী করব? এ কোনও তাত্ত্বিক তর্ক নয়, টেলিভিশনের বড় পর্দায়, সমাজমাধ্যমের ছোট পর্দায় আমরা সবাই দেখেছি সীমান্তে দাঁড়িয়ে আছেন শরণার্থীরা। তাঁরা বাঁচতে চান, ভারতে আশ্রয় চান। কিন্তু ভারত সরকার সীমান্ত বন্ধ করেছে, সীমান্ত রক্ষীরা উদ্বাস্তুদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।
আসি ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের ‘প্রথম’ স্বাধীনতার বিষয়ে। পাকিস্তানের অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় বসার কথা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের। সেটা সেনাবাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের না-পসন্দ। ফলে সামরিক শাসন। কিন্তু পাকিস্তানের ভাবনায় ইসলামি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এই চক্রান্তের আসল উৎস হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব। এই হিন্দু সমাজকে একেবারে নির্মূল করে দিতে শুরু হল পৃথিবীর ইতিহাসের এক নৃশংসতম গণহত্যা। একটি উদাহরণই যথেষ্ট যে, খুলনার চুকনগরে ২০ মে ১৯৭১-এ এক দিনে ১০ থেকে ১২ হাজার হিন্দুকে হত্যা করা হয়।
এই নৃশংস অত্যাচারের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় পুরো হিন্দু সমাজই ভারতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। আজকের ভারত সরকারের মতন তিনি সীমান্ত বন্ধ করেননি। সনাতন সংস্কৃতির ধারায় সহস্র বৎসর ধরে এ দেশে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে ইহুদিরা, পার্সিরা। দেশভাগের সময় সব নেতার প্রতিশ্রুতি ছিল অত্যাচারিত হিন্দুদের আশ্রয় দেবে ভারত। ইন্দিরা গান্ধী আশ্রয় দিলেন, উন্মুক্ত সীমান্ত দিয়ে নামল উদ্বাস্তুর ঢল। ভারত সরকারের হিসাব, ক্যাম্প এবং ব্যক্তিগত বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রায় ১ কোটি মানুষ (৯৮ লক্ষ ৯৯ হাজার ২৭৫ জন)। ভারতের জনসংখ্যা তখন প্রায় ৫৫ কোটি। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার ২ শতাংশ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
ঐক্য পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ৫ থেকে ২০ অগস্ট এই পনেরো দিনেই হিন্দু বৌদ্ধদের উপর ২০১০টি আক্রমণ হয়েছে, ২২টি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়া হয়েছে। ভাঙা হয়েছে মাজার, বন্ধ হয়েছে লালন উৎসব। চট্টগ্রামে আক্রান্ত ইসকন মন্দির, লোকনাথ মন্দির, জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে হরিজন কলোনি। আক্রান্ত হচ্ছেন বৌদ্ধ জাতি চাকমা ও অন্যান্যরা। পাকিস্তানিদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করছে ইউনূসের সরকার।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল করতে লেগেছে দশকের পর দশক। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করা কয়েক দশকের কাজ। কিন্তু কয়েক দশক ধরে এই উদ্বাস্তু সমস্যার বোঝা বইতে হলে ভারতের বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনীতি, নিরাপত্তা ভেঙে পড়বে। সুতরাং প্রয়োজন সাহসী সিদ্ধান্ত। ইন্দিরা গান্ধী উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের নয় মাস পরেই, ৩ ডিসেম্বর (১৯৭১) ভারতীয় বাহিনী ঢুকিয়ে আক্রমণ করলেন পূর্ব পাকিস্তান। মাত্র ১৩ দিনে, ১৬ ডিসেম্বর তৈরি করে উপহার দিলেন আজকের বাংলাদেশ। ফিরে গেলেন প্রায় সব উদ্বাস্তুই। বাংলাদেশের বহুনন্দিত মুক্তিযুদ্ধের পিছনে আছে ভারত সরকারের উদ্বাস্তু সমস্যা সমাধানের জন্য সাহসী পদক্ষেপ।
কিন্তু এ বার তো সীমান্ত বন্ধ। ফোন পাচ্ছি, দাদা কাল ইন্ডিয়া এলাম, ১৫ দিনের ভিসা। কিন্তু ফিরব না। এখানে কি নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে? এক কথায় উত্তর, না। কেন? ভারত সরকার মনে করে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশে সব সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তা হলে কী করা যাবে? ৭১-এ কিন্তু এঁদের বাবা কাকারা আশ্রয় পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জন্য উৎসর্গ-প্রাণ বর্ষীয়ান অসুস্থ শাহরিয়ার কবির এখন জেলে। মিথ্যা হত্যার মামলা নিয়ে আশঙ্কার জীবন কাটাচ্ছেন মুনতাসির মামুন, রাণা দাশগুপ্তরা। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা তসলিমা নাসরিনকে তাড়িয়েছিলেন, তাঁরাই কলকাতা থেকে তসলিমাকে তাড়িয়েছেন। তৃণমূল সব দায়িত্ব চাপিয়েছে ভারত সরকারের উপর। সিপিএম তাদের বিবৃতিতে মৌলবাদীদের দোষী বললেও, মৌলবাদী কারা তা বলেনি। ইতিমধ্যে তৃণমূল দলের গুরুত্বপূর্ণ মুখ সিদ্দিকুল্লা যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তাতে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থনের ইঙ্গিত। ইউনূস সরকার ভারত সরকারের কাগুজে প্রতিবাদকে অবজ্ঞা করে কারারুদ্ধ করেছে আজকের বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতিবাদের মুখ সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসকে। ও দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের প্রবেশদ্বারের পথে মাটিতে পদদলিত হল ভারতের জাতীয় পতাকা।
এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে ভারতের সব প্রতিবেশী দেশে ভারতবিরোধীরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। নেপালে মাওবাদী দল, শ্রীলঙ্কায় ঘোষিত ভারতবিরোধী মার্ক্সবাদী লেনিনবাদী দল, চিরশত্রু পাকিস্তান এবং সদ্যশত্রু বাংলাদেশ। ভারতীয় কূটনীতির এমন দুরবস্থা আগে দেখা যায়নি। এই সব দেশের নাগরিকেরা নিশ্চয় দেখছেন যে বৃহৎ স্বঘোষিত শক্তিধর ভারত প্রতিবেশী দেশের অসহায় মানুষদের প্রতি কী উদাসীন। সুতরাং এখনই প্রয়োজন ভারত সরকারের সাহসী সিদ্ধান্তের, শুধু শরণার্থী আশ্রয় ক্যাম্প নয়, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতন ও বিতাড়নের সমাধানে উপযুক্ত কঠোর পদক্ষেপ। কূটনৈতিক, আর্থিক, ভৌগোলিক পদক্ষেপ। নদীর জলে দাঁড়িয়ে হাজার উদ্বাস্তু, পূজামণ্ডপের ভীত পুরোহিত, ঘরের কোণে কিশোরী কন্যা, সকলেই সেই প্রতীক্ষায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy