সোমালিয়া মানব সভ্যতার অন্যতম দুই অভিশাপেরই – যুদ্ধ এবং উষ্ণায়ন – শিকার। ছবি: এএফপি।
মিশরের শার্ম এল-শেখে ২০২১ সালে সব থেকে বেশি দূষণ সৃষ্টি করা প্রথম ৪টি দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত। বাকি ৩টি দেশ হল চিন, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ভারত এ নিয়ে প্রতিবাদও করেছে। প্রতিবাদের মূল যুক্তি সোজা। পৃথিবীর উষ্ণায়নের মূলে রয়েছে উন্নত দেশগুলির স্বেচ্ছাচারিতা। তাদের সঙ্গে এক আসনে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশকে বসিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়।
এ লড়াই নতুন নয়। ভারতের মতো দেশগুলির সঙ্গে উন্নত দুনিয়ার উষ্ণায়নের দায়ভার নিয়ে যুদ্ধও বহু দিনের। উন্নয়নশীল দেশগুলির এই বিরোধিতাকে উড়িয়েও যেমন দেওয়া যায় না, ঠিক তেমনই আবার এ লড়াই পাশে রেখে মানবসভ্যতা বাঁচানোর লড়াইয়ে এককাট্টা হওয়ার প্রয়োজনীয়তাও উপেক্ষা করা যায় না। বিশেষ করে সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের, যা বিশ্বের চোখের আড়ালে ভয়ানক আকার নিয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে। সোমালিয়া চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে উষ্ণায়নের ফলে কী হতে পারে।
অমর্ত্য সেন ইতিহাসকে সাক্ষী করে বলেছিলেন যে দেশে কার্যকর গণতন্ত্র আছে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। পঁচিশ বছরের রাজনৈতিক নৈরাজ্যের শিকার হর্ন অব আফ্রিকার বা আফ্রিকার শৃঙ্গের ৪টি দেশের একটি এই সোমালিয়ার গত দশ বছরের মধ্যে এই দ্বিতীয় খাদ্য সঙ্কটকে অমর্ত্য সেনের এই উক্তির অন্যতম প্রমাণ হিসাবে ধরাই যেতে পারত যদি না গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো উষ্ণায়নও দায় নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ত।
সোমালিয়ায় এই মুহূর্তে ৭০ লক্ষ মানুষের (জনসংখ্যার ২০ শতাংশ) পেটের ভাত জুটছে না। সাড়ে দশ লক্ষের উপর শিশু ভুগছে তীব্র অপুষ্টিতে। বিশ্বের সাহায্যকারী সংস্থাগুলি কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বিভিন্ন শাখা সংস্থাগুলিও কাজ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করার যে মাপকাঠি রয়েছে তার দরজায় দাঁড়িয়েও সোমালিয়া এখনও প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত। ২০১১ সালের মতোই এই মাপকাঠিতে যতদিনে সোমালিয়াকে দুর্ভিক্ষ নিপীড়িত বলে মেনে নেবে বিশ্ব ততদিনে যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়ে যাবে।
অমর্ত্য সেনের যুক্তিকেও সত্যি প্রমাণ করেছে সোমালিয়া। দীর্ঘ তিন দশকের রাজনৈতিক অরাজকতার কারণে বিশেষ করে সোমালিয়ার উত্তরাঞ্চলে সবুজ শুধু ধ্বংস হয়েছে তাই নয়, কোথাও কোথাও সবুজ বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। সোমালিয়ার আয়ের অন্যতম উৎস পশুপালন। সবুজ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তা শুধু এই অর্থনীতিকেই ধ্বংস করেছে তাই নয়, ধ্বংস হয়েছে জঙ্গল ও পরিবেশও।গত চার বছর ধরে টানা খরা, যা পঞ্চমবারও হতে চলেছে বলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, কিন্তু হয়েছে বিশ্বের উষ্ণায়নের কারণেই। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য বিশ্বের যে ক’টি দেশ প্রথমেই উষ্ণায়নের শিকার তাদের মধ্যে প্রথম দু’টি স্থানের অন্যতম হল সোমালিয়া। অপরটি নাইজ়ের। আর সোমালিয়া মানব সভ্যতার অন্যতম দুই অভিশাপেরই – যুদ্ধ এবং উষ্ণায়ন – শিকার।
সোমালিয়ার নিজের ব্যবহারের জন্য কৃষিজ উৎপাদন খুব কম। নিজেদের প্রয়োজনের গমের অর্ধেকের বেশিই আমদানি করতে হয়। তার অন্যতম সূত্র হল রাশিয়া। ইউক্রেনের যুদ্ধের জন্য সেই সরবরাহ সূত্রও নড়বড় করছে। গমের দাম ছুঁয়েছে আকাশ। অন্যান্য খাদ্যপণ্যের দামও তথৈবচ। কারণ প্রয়োজনের ৮০ শতাংশ খাদ্যপণ্যই আমদানি করতে হয় দেশটিকে। বিশ্ব জুড়ে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। তার অভিঘাত সোমালিয়ার উপর এতটাই বেশি যে বেশির ভাগ নাগরিকের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উষ্ণায়নের অভিশাপ – খরা।
উষ্ণায়নের আলোচনায় উঠে এসেছে উন্নত দেশগুলির হাতে পরিবেশের ক্ষতির কারণে সোমালিয়ার মতো যে দেশগুলিকে মূল্য চোকাতে হচ্ছে তাদের ক্ষতিপূরণের কথা। মিশরের এই আলোচনাতেও তা উঠে আসার কথা। কিন্তু তা আদৌ হবে কিনা তা আগামীতে জানা যাবে। তবে আশার কথা ট্রাম্পের আমলে পরিবেশ নিয়ে আলোচনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে এসেছিল। বাইডেনের আমলে আবার তারা ফিরেছে এবং বেরিয়ে যাওয়াটাও যে ঠিক হয়নি তাও স্বীকার করে নিয়েছে। তাতে রাজনীতি আছে ঠিকই, কিন্তু আলোচনার টেবিলে উপস্থিতিটা জরুরি। এবং তা ঘটেছে।
ফেরা যাক সোমালিয়ায়। মাথায় রাখতে হবে পরিবেশ দূষণে বনজ সম্পদ নষ্ট করা সত্ত্বেও তুলনামূলক ভাবে সোমালিয়ার অবদান প্রায় কিছুই নয়। অথচ মূল্য চোকাতে হচ্ছে সে দেশের অসহায় নাগরিকদেরই। দুর্ভিক্ষ নিপীড়িত হিসাবে চিহ্নিত হতে গেলে সোমালিয়াকে তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। ক) দেশের এক তৃতীয়াংশের বেশি শিশুকে অপুষ্টির শিকার হতে হবে। খ) দেশের ২০ শতাংশ মানুষের কাছে খাদ্য অমিল হবে। গ) প্রতিদিন প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত দুজনকে অনাহারে মারা যেতে হবে।
২০১১ সালে এই একই অবস্থার বলি হয়েছিল সোমালিয়া। দুর্ভিক্ষ নিপীড়িত বলে যখন স্বীকৃতি মিলল, ততদিনে বহু শিশু ও নাগরিক বলি হয়ে গিয়েছিলেন দুর্ভিক্ষের। এই স্বীকৃতির পরেই কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম সোমালিয়া। একই অবস্থা ফিরে এসেছে সোমালিয়ায়। আগামীতে তা আরও ভয়াবহ হবে বলে পরিবেশবিদদের আশঙ্কা।
আমরা যদি মনে করি নাইজ়ের আর সোমালিয়াতেই পরিবেশ ধ্বংসের অভিঘাত আটকে থাকবে তা হলে ভুল করব। উষ্ণায়নের মূল্য কিন্তু আমরা সবাই চোকাতে শুরু করেছি। ভারতে বাড়ছে ঝড়ের সংখ্যা। ঠান্ডা গরমের অঙ্ক গুলিয়ে গিয়েছে। বৃষ্টিও হচ্ছে অসময়ে। ইউরোপেও গরম কাল অসহনীয় হয়ে উঠছে। কিন্তু তবুও আমাদের জ্ঞানচক্ষু ফুটছে না। রাজনৈতিক স্বার্থ পাশে সরিয়ে গোটা বিশ্ব কিন্তু পরিবেশ রক্ষায় এখনও একজোট হতে পারছে না। তবে এটাও ঠিক যে মরার ভয়ের গুঁতো হালকা হলেও লাগছে। কিন্তু সোমালিয়ার অবস্থান নিয়ে যে রকম, সেই এক ভাবেই আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হতে আরও দেরি হয় তা হলে পৃথিবী থাকবে কিন্তু আমরা ডাইনোসরের রাস্তাতেই হাঁটব। অনেকেই বলছেন সে যাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy