কেমন হত, যদি অ্যাডল্ফ হিটলারকে তৎকালীন জার্মানির কোনও বিজ্ঞানী জানাতেন যে, তাঁর ঊর্ধ্বতন চতুর্দশ পুরুষটি ছিলেন সেই ইহুদি সম্প্রদায়েরই মানুষ, যে সম্প্রদায়কে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য হিটলার প্রাণপাত করছেন? কিংবা, উত্তরপ্রদেশের কোনও দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাহুবলী ঠাকুরকে যদি কেউ বলতেন যে, কিছু দিন আগেই যে অভাগা, দলিত ভাগচাষির ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, সেই মানুষটিও আসলে ওই প্রবল প্রতাপশালী ঠাকুরটির মতো একই জিন বহন করছেন নিজের শরীরে, কারণ তাঁদের দ্বাদশ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষটি একই ব্যক্তি ছিলেন?
দু’ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানী দু’জনের লাশ খুঁজে পাওয়া যেত কি না, সন্দেহ! তবে, রাজনীতি বা ক্ষমতার দম্ভ যে সত্যটাকে কখনও স্বীকার করে না, তা হল, যুক্তিবাদী বা বিজ্ঞানীকে হত্যা করলেই বৈজ্ঞানিক সত্যকে পাল্টে দেওয়া যায় না। চামড়ার রং, ধর্ম বা জাতের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির সমস্ত ফন্দির বিরুদ্ধে গলা তুলে, জিনতত্ত্ব আর রাশিবিজ্ঞানের উপর ভর করে সেই সত্য বলছে, আজকের পৃথিবীর কোটি কোটি জীবিত মানুষ আসলে এসেছে কয়েকটি আলাদা আলাদা দম্পতির বংশধারার পথে। এই পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীরা কিন্তু প্রায় ৭০,০০০ বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া হোমো সেপিয়েন্স-দের সেই আদিম অভিভাবকদের তুলনায় কালানুক্রমে অনেকটাই নবীন। এঁরা হয়তো পৃথিবীতে ছিলেন মাত্র ১০০০-১৫০০ বছর আগেই।
জিনতাত্ত্বিক অ্যাডাম চার্লস রাদারফোর্ড ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিতে সহজ একটা অঙ্ক কষেছেন ২০২০ সালে প্রকাশিত তাঁর হাউ টু আর্গু উইথ আ রেসিস্ট: হিস্ট্রি, সায়েন্স, রেস অ্যান্ডরিয়্যালিটি বইটিতে। পৃথিবীর বর্তমান মোট জনসংখ্যা প্রায় ৭৯০ কোটি। এই জনসংখ্যা এখন প্রতি বছর মোটামুটি এক শতাংশ হারে বাড়ছে। এখন, আপনার বাবা এবং মা— দু’জন আলাদা মানুষ— জন্মেছেন তাঁদের দুই জোড়া আলাদা বাবা-মায়ের থেকে, অর্থাৎ ৪ জন মানুষ থেকে (আপনার দিদিমা-দাদামশাই, এবং ঠাকুরমা-ঠাকুরদা)। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, এই ৪ জন এসেছেন তাঁদের চার জোড়া আলাদা আলাদা বাবা-মায়ের থেকে, তা হলে সরাসরি আপনার সঙ্গে জিনগত ভাবে যুক্ত প্র-পিতা ও প্র-মাতার সংখ্যা তিন প্রজন্ম আগে ছিল আট জন, চার প্রজন্ম আগে ছিল ষোলো জন— এবং, এক-একটি করে প্রজন্ম পিছিয়ে গেলে সংখ্যাটিও এ ভাবে প্রতি ধাপে দ্বিগুণ হতে থাকে। পর পর দু’টি প্রজন্মের মধ্যে কম-বেশি ২৫ বছরের ব্যবধান রয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। সুতরাং, এই ভাবে চলতে থাকলে ১০০০ বছর আগে, অর্থাৎ ৪০ প্রজন্মের ব্যবধানে শুধুমাত্র একটি বংশের পূর্বনারী ও পুরুষের মোট সংখ্যাটাই দাঁড়ায় প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার কোটি। এই সংখ্যাটা আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে জন্মানো সমস্ত মানুষ, অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির সর্বকালের মোট লোকসংখ্যার (যেটা আনুমানিক ১১ হাজার কোটি) ১০ গুণ বেশি!
অতএব, আজকের পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের ঊর্ধ্বতন পুরুষ ও নারীরা যদি সবাই আলাদা আলাদা হতেন, তা হলে ১০০০ বছর আগে পৃথিবীর জনসংখ্যা আজকের জনসংখ্যার থেকে প্রায় হাজার কোটি গুণ বেশি হত! অথচ, বিজ্ঞানভিত্তিক ভাবে অনুমান করা হয় যে, হাজার বছর আগের পৃথিবীতে জনসংখ্যা ছিল তিন কোটির আশেপাশে। তা হলে এই ধাঁধার উত্তর কী? উত্তর একটাই, আর সেটা হল এই যে, আমাদের পূর্বপুরুষেরা আদৌ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বংশধারার পথে আসেননি। বরং সময়ের উজানস্রোতে হাঁটলে দেখা যাবে যে, আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ আলাদা পরিবারগুলোর মধ্যেও বিরাট জিনগত সমাপতন রয়েছে। জাতপাত আর ধর্মের ধুয়ো তুলে যারা একে অপরের গলায় ছুরি বসাচ্ছে, সময়ের উল্টোরথে মাত্র আট-ন’শো বছরের ব্যবধানে তাদের পূর্বনারী-পূর্বপুরুষরা হয়তো বড় হচ্ছিলেন একই বাবা-মায়ের কোলে-পিঠে।
আজকের দুনিয়ার অধিবাসীদের শাখাবহুল বংশলতিকাগুলোর এই অভিসারী সমাপতন কতটা ব্যাপক, তার কয়েকটা অবাক করা উদাহরণ দেখা যেতে পারে। রাদারফোর্ড তাঁর বইতে দেখিয়েছেন যে, বর্তমানে জীবিত সমস্ত ইউরোপিয়ানের সাধারণ পূর্বপুরুষটি মাত্র ৬০০ বছর আগেই, অর্থাৎ ১৪০০ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন। এই মানুষটিকে এখনকার সমস্ত ইউরোপীয় পরিবারের বংশলতিকাতেই খুঁজে পাওয়া যাবে। ২০০৪ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধে, এমআইটি-র বিজ্ঞানী ডগলাস রোড ও তাঁর দুই সহকর্মী কম্পিউটার সিমিউলেশন-এর মাধ্যমে দেখিয়েছিলেন যে, বর্তমান মানবজাতির সবার বংশলতিকাতে থাকা কালানুক্রমে প্রবীণতম মানুষটির পার্থিব জীবনকাল ১৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগে হতে পারে না। তার মানে, প্রাচীন মিশরের রানি নেফারতিতি-র রাজত্বকালেই আমাদের এই একমেবাদ্বিতীয়ম্ প্রাক্পুরুষটি পৃথিবীর মাটিতে কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। এর থেকেও কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে গেলে আমরা এমন একটা তারিখে পৌঁছে যাই, যার আগে আমাদের সব পূর্বনারী ও পূর্বপুরুষ ছিলেন অভিন্ন— অর্থাৎ এই সময়বিন্দুর আগে আমাদের বংশলতিকাগুলো একটির বদলে সব ক’টি পূর্বসূরিতে মিলে যেত, বা অভিসারী হয় পড়ত।
জেনেটিক ডেমোগ্রাফি-র পরিভাষায় এই নির্দিষ্ট সময়কে বলা হয় ‘জেনেটিক আইসো-পয়েন্ট’। পৃথিবীর যে কোনও দুই প্রান্তে থাকা সব দিক থেকে আলাদা দুটো পরিবারের বংশধারা এই জেনেটিক আইসো-পয়েন্ট’এ পৌঁছে সম্পূর্ণ জুড়ে যাবে। রাদারফোর্ডের কথায়, কেউ যদি জেনেটিক আইসো-পয়েন্ট’এ বেঁচে থাকেন, তা হলে হয় আজ পৃথিবীর তাবৎ মানুষ তাঁর জিন বহন করছে, না হলে তাঁর বংশধারা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। এমআইটি-র বিজ্ঞানীদের গণনা বলছে যে, এই সময়টা খুঁজতে আমাদের আদৌ কোনও প্রস্তরযুগে ফিরে যেতে হবে না— এই সময়টা ছিল মাত্র খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০০ থেকে ২২০০ অব্দের মধ্যে।
মানবজনগোষ্ঠীগুলোর সুবিপুল আপাত বিভেদ ও বৈচিত্রের শেষ তবে ছিল এতটাই অনতিঅতীতে? বিজ্ঞানভিত্তিক অনুমান সে কথাই বলছে। গাত্রবর্ণ, উচ্চতা, চোখের মণির রং, খুলির গঠনের মতো আপাত বৈচিত্রের মূলে বিভিন্ন পূর্বসূরির জিনের বিষমানুপাতিক মিশ্রণ, জিনের উপর পরিবেশের প্রভাব, মানবজাতির বিভিন্ন শাখার ভৌগোলিক স্থানপরিবর্তন— এ সবেরও চুলচেরা হিসাব করা সম্ভব আধুনিক কম্পিউটারের বিপুল গণনাশক্তি প্রয়োগ করে।
জেনেটিক আইসো-পয়েন্ট সংক্রান্ত এ ধরনের গবেষণার ফল স্বভাবতই চামড়ার রং, রক্তের বিশুদ্ধতা, কিংবা তথাকথিত বংশমর্যাদার অহঙ্কারের মতো ধ্যানধারণাকে খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে নস্যাৎ করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত জাতিবিদ্বেষকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা ইউজেনিক্স-এর মতো অপবিজ্ঞানের বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে রাদারফোর্ডরা নতুন করে সারা পৃথিবীর মানুষকে আত্মীয় বলে ভাবতে শেখান। তাঁদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সামনে বড় বেচারা মনে হয় সেই রাজনীতির কারবারিদের— মানুষে মানুষে ধর্মের রূপকথাগুলোর ভিত্তিতে শত্রুতা আর অবিশ্বাস জিইয়ে রাখাটাই যাঁদের মূলধন।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy