E-Paper

কল্পনাশক্তির সন্ধানে

সমাজবিজ্ঞানের মূলধারার পদ্ধতি, যেখানে ব্যক্তির ‘কারক’ ভূমিকাটি কেন্দ্রে রাখা হয়। এই দুইয়ের মধ্যে এক প্রকার মিশ্র অবস্থানও অসম্ভব নয়। আমরা এখানে তেমনই একটি দৃষ্টিভঙ্গি নেব।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। —ফাইল চিত্র।

অচিন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৩৯
Share
Save

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রয়াত হলেন, রেখে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক আর্থসামাজিক ইতিহাসের এক টুকরো, একটি ছোট্ট অধ্যায়, যা আমাদের ভাবায়, বিভ্রান্ত করে, স্বস্তি
দেয় না। ব্যক্তি বুদ্ধদেবের সততা, তাঁর সাহিত্যপ্রীতি ও সাংস্কৃতিক পরিশীলন, তাঁর ‘ভদ্রলোক’ত্ব— এ সব নিয়ে চর্চা হয়েছে যতটা, এক জন রাজনীতিক এবং ভারতের একটি রাজ্য সরকারের কর্ণধার হিসাবে তাঁর ভূমিকার নির্মোহ বিশ্লেষণ বোধ হয় তেমন হয়নি। তাঁর প্রয়াণের পর দিন আনন্দবাজার পত্রিকা-র সম্পাদকীয় সেই জরুরি কথাটি মনে করিয়ে দেয়। ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই তাগিদ থেকেই এই বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তবে এও মনে রাখতে হবে যে, ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা মুখ্য না গৌণ তা নিয়ে তাত্ত্বিক তর্কের শেষ নেই। এক দিকে এক ধরনের মার্ক্সীয় বিশ্লেষণ পদ্ধতি, যাকে বলা হয় ‘ঐতিহাসিক বস্তুবাদ’, যেখানে ব্যক্তির গুরুত্ব প্রায় নেই বললেই চলে— সেই তত্ত্ব অনুসারে, সমাজ বদল হয় নির্দিষ্ট দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে। অন্য দিকে, সমাজবিজ্ঞানের মূলধারার পদ্ধতি, যেখানে ব্যক্তির ‘কারক’ ভূমিকাটি কেন্দ্রে রাখা হয়। এই দুইয়ের মধ্যে এক প্রকার মিশ্র অবস্থানও অসম্ভব নয়। আমরা এখানে তেমনই একটি দৃষ্টিভঙ্গি নেব।

বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ২০০৬ সালে বুদ্ধদেব যখন মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তাঁর দ্বিতীয় পর্ব শুরু করলেন, সেখান থেকে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে যে দ্রুততায় রাজনীতির পালাবদল ঘটে গেল পশ্চিমবঙ্গে, তা আজও ভাবার মতো বিষয়। ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে তাকে বিশেষ ব্যতিক্রমী বলা যায় না অবশ্য। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে এমন দ্রুত রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তো কতই হয়েছে। বিশেষত সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের অন্য দেশগুলির কথা প্রথমেই মনে আসে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এই দ্রুত পরিবর্তনের কার্যকারণ সম্পর্ক খুঁজতে গেলে সততই বহুমুখী ও পরস্পর-বিরোধী আখ্যানের ঘূর্ণিস্রোতে পড়তে হয়।

ঘটনার পরম্পরাটি এক বার মনে করা যাক। ২০০৬-এর শেষ দিক থেকে সিঙ্গুর, ২০০৭-এ নন্দীগ্রামে গুলিচালনা ও মৃত্যু, তার পর ২০০৮-এর মে মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফলে বামফ্রন্টের নিদারুণ ক্ষতি, গোর্খাল্যান্ড দাবিতে নতুন করে আন্দোলন, সিঙ্গুর থেকে টাটা মোটরস-এর প্রস্থান, লালগড় আন্দোলন, বামফ্রন্টের পুনরায় আসন হারানো ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ইত্যাদি। এক দিকে সিপিএমের দলীয় আখ্যানে দেখি বিরোধীদের একগুঁয়ে বিরোধিতা, মানুষকে ভুল বোঝানো, ষড়যন্ত্র, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টাকেই বার বার দায়ী করা হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে— ‘ওরা রাজ্যের ভাল চায়নি’। অন্য দিকে, বাম রাজত্বের সমালোচকদের আলোচনায় শাসনসংক্রান্ত নানান ব্যর্থতার সঙ্গে সুবিধাভোগী পার্টি-ঘনিষ্ঠ শ্রেণির উত্থান, ক্ষমতার দম্ভ, জনজীবনে অবাঞ্ছিত খবরদারি ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসে পড়ে।

বুদ্ধদেব এই পর্যায় নিয়ে যেটুকু লিখেছেন, তা ওই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বাইরে যায়নি। কিন্তু যেতে পারত। তাঁর স্মৃতিচারণ ফিরে দেখা শেষ হচ্ছে ২০১১-য় এ ভাবে— ‘কংগ্রেস-তৃণমূল-জামাত-আরএসএস-মাওবাদীরা আপাতত জিতেছে এই রাজ্যে’। জামাত-আরএসএস-মাওবাদীরা নির্বাচনে না লড়েও জিতে গেল কী অর্থে, আর যে অর্থেই তা হোক না কেন, সেই জিতে যাওয়া সম্ভব হল কী ভাবে, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা কোথাও পাওয়ার উপায় নেই। রাজ্যের উন্নয়নে তাঁর আন্তরিকতার অভাব ছিল, এমন কথা হয়তো তাঁর বিরোধীরাও বলবেন না। কিন্তু রাজনৈতিক দর্শনের যে বন্ধ্যাত্ব সরকারি বামপন্থাকে প্রশাসনমুখীনতায় আটকে ফেলছিল, তা যে তাঁর সময়েই আরও প্রকট হতে থাকল, তা সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণায় তখনই উঠে আসতে শুরু করেছে। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে ২০০৩ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে করা সমীক্ষার ভিত্তিতে পার্থ চট্টোপাধ্যায় দ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য এবং অন্যরা এই কথাগুলিই বলেছেন— কী ভাবে সরকার ও পার্টি মিলেমিশে একটি ‘পার্টি-সমাজ’ হয়ে উঠল। ‘আমরা শিল্প আনতে চেষ্টা করেছি, ওরা হতে দিল না’— শুধু এই চিন্তায় আবর্তিত হতে থাকলে সঠিক রাজনৈতিক দিশাটি খুঁজে পাওয়া যাবে, এমন সম্ভাবনা দেখি না। এখানে রাজনৈতিক দিশা বলতে নিছক ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের কৌশলের কথা বলছি না, বলছি প্রথাগত পার্টিতান্ত্রিক শত্রু-মিত্র চিহ্নিতকরণের মধ্য দিয়ে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছনোর যে প্রকল্প, তার বিকল্পের সন্ধান। যে বিকল্পকে প্রকৃত অর্থে মানুষের রাজনীতি বলা যায়।

পরিধানের শুভ্র ধুতি-পাঞ্জাবি হয়ে ওঠে সততার প্রতীক। শেষ দিন পর্যন্ত দু’কামরার ছোট্ট বাসস্থান থেকে নড়েননি। এ সব নিয়ে চর্চা চলতে থাকে নিরন্তর, যা সমর্থকদের তৃপ্তি দেয়, বিশেষত যখন দেখা যাচ্ছে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে সরকারে অধিষ্ঠিত দলটিতে এই শুভ্রতার বেজায় অভাব। শুভ্রতার চিহ্নমূল্যকে আঁকড়ে এই যে শ্লাঘার আধিক্য, তা যেন রাজনীতিক বুদ্ধদেব এবং তাঁর সময়টির যথাযথ মূল্যায়নের বাধা হয়ে ওঠে। তাঁর নিজের লেখাতেই দেখছি, “অনেক বারই মনে হয়েছিল, সামাজিক বাস্তবতা ও আমাদের নীতির মিল হচ্ছে না। কিন্তু আমরা নিরুপায়ের মতো এগিয়েছি। তার ফল ভোগ করছি।” এমন কথা তাঁর আত্মকথা ফিরে দেখা-য় কয়েক বারই এসেছে। কী এক অদৃশ্য শক্তির কাছে যেন অসহায় সমর্পণের মধ্যে দিয়ে এগোনো! এ থেকে তাঁর সংবেদনশীল মনের, তাঁর আত্মবিশ্লেষণের প্রচেষ্টার পরিচয় পেয়ে আমাদের শ্রদ্ধা হয়। আত্মগর্বী কোনও জননেতার বাচন থেকে যা অনেকটাই আলাদা। কিন্তু এ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে যে রাজনৈতিক সামাজিক প্রক্রিয়া শুরু করা যেত, তার কোনও ইঙ্গিত তিনি দেননি। রাষ্ট্রক্ষমতা ঘিরে প্রচলিত বামপন্থার যে বয়ান, তা থেকে বামপন্থাকে মুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন কি না, তাও আমাদের অজানাই থেকে গেল। বুদ্ধদেব নিজের কাছে সৎ থাকার চেষ্টা নিজের মতো করে গেছেন। এমনকি সততার প্রশ্নে সক্ষোভে মন্ত্রিসভা ত্যাগ এবং কয়েক মাস পরে ফিরে আসা— তাও আমাদের মনে আছে।

বামপন্থী রাজনীতির নীতিগুলি থাকে পার্টির দলিলে। বিভিন্ন পার্টি কংগ্রেসে নীতির পরিবর্তন হতেও দেখা যায়, কিন্তু বাস্তবে প্রধান গুরুত্ব পায় রাজনৈতিক কৌশল। অনেকেই মনে করতে পারেন, বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী দলগুলিকে প্রাসঙ্গিক থাকতে গেলে পুরোপুরি বাস্তব রাজনীতির কৌশলের দিকেই মনঃসংযোগ করতে হবে। রাজনৈতিক লব্জে যাকে বলা হয় ‘ইস্যু ধরতে হবে’। নীতি বা কৌশল, যে ভাবেই ভাবি না কেন, রাজনৈতিক ক্ষমতায় বিদ্যমান অতীতের বিনির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত বর্তমান জনবাদী বা পপুলিস্ট রাজনীতির স্বরূপ বুঝতেও বিনির্মাণ সাহায্য করবে। আর্থনীতিক প্রগতির যে প্রথাগত মডেল, তা এখন নানা কারণে প্রশ্নের মুখে। কার লাভ কার ক্ষতি, মানুষ এখন তা বুঝে নিতে চাইছে। এই বোঝাটা কখনও ঠিক কখনও ভুল হতে পারে, কিন্তু একে আবর্তিত করে যে রাজনীতি উঠে আসছে, তাকে রাষ্ট্রিক দৃষ্টি দিয়ে দেখার ভুল থেকে উঠে আসে জনবাদী রাজনীতি। বিনির্মাণ-পুনর্নির্মাণের এই প্রক্রিয়াতে বুদ্ধদেব হয়তো পথ দেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকলেন রাজনীতি থেকে।

বুদ্ধদেব লিখছেন, “পার্টিতে মার্কসবাদের চিরায়ত যে শিক্ষাক্রমে আমরা শিক্ষিত হয়েছিলাম সেখানে ক্ষমতা অর্থাৎ ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা’-র অর্থ সুদূরপ্রসারী।” এই ‘সুদূরপ্রসারী’ শব্দে যে প্রত্যাশা জাগায় তা ধাক্কা খায় পরের বাক্যটিতে— “গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিরঙ্কুশ একাধিপত্য (একনায়কতন্ত্র) প্রতিষ্ঠা করা।” রাজনৈতিক ক্ষমতার অর্থ তা হলে নিরঙ্কুশ রাষ্ট্রক্ষমতা! কার হাতে? অবশ্যই দলের। বামপন্থার মতাদর্শগত আধিপত্যের ধারণাটি সুদূরে প্রসারিত না হয়ে একটি অঙ্গরাজ্যের প্রশাসনিকতায় আটকে পড়াই হয়ে যায় তার ভবিতব্য— রাষ্ট্রক্ষমতার ছোট সংস্করণ, যেখানে আবার পার্টি-ক্ষমতাই থাকে কেন্দ্রে। তাই এই পার্টি-ক্ষমতা যখন দ্রুত আলগা হতে থাকে, তখন আর দিশা পাওয়া যায় না। পালাবদলের পর বামপন্থী অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়কের বিশ্লেষণে দায়ী করা হয় সিপিএমের মামুলি, কল্পনাশক্তিরহিত দৃষ্টিভঙ্গি— ‘মানডেন অ্যান্ড পেডেস্ট্রিয়ান’ রাজনীতিকে।

বুদ্ধদেবের নিজের কথাতেই যে আত্মসমালোচনা রয়েছে, যে ভুল স্বীকার রয়েছে, তাকে গুরুত্ব দিয়ে কি এমন রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করা যেত না, যা এই কল্পনাশক্তিহীনতার গর্ত থেকে রাজনীতিকে বার করে আনতে পারত? কল্পনা করে নিই, বুদ্ধদেব হয়তো ত্রয়োদশ শতকের দার্শনিক রুমির মতো বলছেন, “গতকাল আমি চালাক-চতুর ছিলাম, তাই আমি দুনিয়া বদলাতে গিয়েছিলাম; আজ আমি প্রজ্ঞাবান, তাই আমি নিজেকে বদলাচ্ছি।”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Buddhadeb Bhattacharjee

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।