Advertisement
২৬ অক্টোবর ২০২৪
যে আনন্দের উন্মাদনা মানব-সংবেদনকে অসাড় করে দেয়
Firecrackers and Dogs

শব্দবাজির ‘রাত দখল’

আইন করে এর সুরাহা হওয়া মুশকিল। উৎসব একটা গুরুত্বপূর্ণ ‘সাইকোট্রপিক’ ব্যবস্থা, অর্থাৎ আরাম ও আনন্দের উৎস, যা মানবসভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ।

অনুরাধা রায়
শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪ ০৮:৪৩
Share: Save:

দেওয়ালি যত এগিয়ে আসে, আতঙ্কে ভুগি। গত বছর, দেওয়ালিতে ঠিক নয়, তার ক’দিন আগে ইডেনে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে খেলায় ভারতের বিজয় উদ্‌যাপক বাজির উল্লাসে পুলিশের একটি ঘোড়া হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়। দেওয়ালির রাতে আমাদের প্রতিবেশীর কুকুর দোতলার বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মারাত্মক ভাবে আহত হয়। আমাদের বাড়ির কুকুরটি পাগলের মতো দৌড়াদৌড়ি, চেঁচামেচি করতে থাকে। বেশ ক’দিন তার খাওয়াদাওয়াও বন্ধ ছিল। বাড়িতে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে হঠাৎই কামড়ে দেয়। বছরের পর বছর দেওয়ালির সময়ে ‘নামানুষ’ প্রাণীদের প্রচণ্ড যন্ত্রণা দেখেছি। গৃহপালিতরা তবু একটু আশ্রয়, আরাম পায়। বাইরের নিরাশ্রয় প্রাণীগুলির কষ্ট অবর্ণনীয়। তার উপর পথকুকুরের লেজে জ্বলন্ত ছুঁচোবাজি বেঁধে দেওয়ার ‘বীভৎস মজা’ তো আছেই। নামানুষদের কথা যদি বাদও দিই, মানুষের জন্যও ‘প্রাণী-শ্রেষ্ঠ’ মানুষের সংবেদনা কতটুকু? ক্যানসারে শয্যাশায়ী প্রতিবেশীর জানলার পাশেই শব্দবাজির তাণ্ডব দেখেছি। বাড়ির চিকিৎসককে কত বার যে দেওয়ালির রাতে হাসপাতালে দৌড়তে দেখেছি বার্ন কেস সামলানোর জন্য। বয়স্ক মানুষ যাঁদের স্নায়ু ও হৃদ্‌যন্ত্র দুর্বল, তাঁদের অনেকের পক্ষেই প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে দীপাবলির উৎসব।

আইন করে এর সুরাহা হওয়া মুশকিল। উৎসব একটা গুরুত্বপূর্ণ ‘সাইকোট্রপিক’ ব্যবস্থা, অর্থাৎ আরাম ও আনন্দের উৎস, যা মানবসভ্যতার অপরিহার্য অঙ্গ। ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হলে তা ‘ডাবল সাইকোট্রপি’ হয়ে ওঠে। কিন্তু উৎসবের উন্মাদনা মানুষের সংবেদনাকে অসাড় করে দিতে পারে। আমার আনন্দ যে অপরের যন্ত্রণার কারণ হচ্ছে, এমনকি শেষ পর্যন্ত আমারও ক্ষতি করতে পারে, সেটা ভুলে যাই। পশুর প্রাণ কোন ছাড় (পশুবলি তো প্রায়শ ধর্মীয় উৎসবের অঙ্গ), মানুষের প্রাণও যে উৎসবের কাছে তুচ্ছ, এ মনোভাব তো আজ রাষ্ট্রনেতাদের সৌজন্যে ‘পাবলিক পলিসি’ হিসেবেই গৃহীত। সমাজমানসেও তার সমর্থন আছে বইকি!

পশুই হোক কিংবা মানুষ, যাদের ‘অপর’ মনে করি তাদের বোঝার চেষ্টা, তাদের জন্য সমবেদনা আমাদের কাছে অবান্তর। পশুরা সর্বাধিক অপর। তাদের কষ্ট মোটেই আমাদের বিবেচ্য নয় (পোষ্যদের ভালবাসা আর মোটের উপর কিছু সীমিত ‘ওয়েলফেয়ারিজ়ম’ বাদ দিলে)। মস্তিষ্কের অতি দ্রুত বিবর্তন তথা ‘কগনিটিভ রেভলিউশন’-এর সাহায্যে এই পৃথিবীর দখল নিয়ে মানুষ অন্য প্রাণীদের উপর যথেচ্ছ অত্যাচার করে এসেছে। প্রজাতির পর প্রজাতি ধ্বংস করে ‘সিরিয়াল কিলার’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে (দ্রষ্টব্য ইউভাল নোয়া হারারি, স্যাপিয়েন্স)। এমনকি বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় হোমো স্যাপিয়েন্সদের সঙ্গে প্রায় তফাত করা যেত না যে নিয়ানডার্থালদের, তাদেরও নিকাশ করেছে। আবার স্বপ্রজাতির প্রাণীদের পীড়নেও এই মস্তিষ্কগর্বী সংস্কৃতিমান প্রাণীটি অন্য সবার থেকে এগিয়ে।

এ সবই মানুষের অতি দ্রুত বিবর্তিত হয়ে খাদ্যশৃঙ্খলের চূড়ায় উঠে আসার ফল। সিংহ যত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে, হরিণ তত দ্রুত দৌড়তে শিখেছে। কিন্তু মানুষ নামে প্রাণীটির হাত থেকে অন্য প্রাণীদের বাঁচানোর জন্য ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ প্রকৃতি তৈরি করতে পারেনি। তা ছাড়াও মনে রাখা ভাল যে, মানুষ শুধু খাদ্য (বা বিনামূল্যের শ্রমিক) হিসেবে অন্য প্রাণীদের ব্যবহার করে না, ধর্মের নামে বা নিছক বিনোদনের জন্যও তাদের উপর অত্যাচার করে। বিবর্তনের দ্রুততা হেতু স্বপ্রজাতির প্রতি হিংসার ক্ষেত্রেও তেমন কোনও প্রতিরোধক মানুষের মস্তিষ্কে তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। বাঘ-সিংহের মতো নখীদন্তীদের স্বভাবে এই ব্যাপারে সহজাত প্রতিরোধক থাকে, কারণ তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করলে প্রজাতিক্ষয়ের প্রবল সম্ভাবনা। বরং হরিণ বা পায়রার মতো নিরীহ বলে পরিচিত প্রাণীদের মধ্যে প্রতিরোধক দুর্বল। মানুষের নখ-দাঁত তেমন নেই, কিন্তু তার মস্তিষ্ক সেই অভাব পুষিয়ে দিয়েছে। ভয়ঙ্কর সব মারণাস্ত্র সে বানিয়ে ফেলেছে। আর এমনকি স্বপ্রজাতির উপরেও তাদের প্রয়োগে মানুষের খুব দ্বিধা নেই (দ্রষ্টব্য, কনরাড লোরেনজ়, কিং সলোমন’স রিং)।

অথচ এই মস্তিষ্কই মানুষকে সমমর্মিতা সহমর্মিতা অর্জনে সাহায্য করতে পারে। আমরা স্বার্থসর্বস্ব সুখ-সাফল্যের সন্ধানে, উৎসবের মাতনে মজে থেকে মস্তিষ্কের যথোচিত মানবিক ব্যবহার করিনি। অন্য প্রাণীদের মঙ্গলকে উপেক্ষা তো করেছি বটেই, নিজেদের জৈবিক মঙ্গলকেও সংস্কৃতির পিঠে চাপিয়ে লাগামহীন ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। নৃশংসতম প্রাণী হিসাবে এই গ্রহের বুকে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছি। নামানুষ প্রাণীদের প্রতি এবং মানুষের প্রতি মানুষের হিংসার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ধরা পড়েছে জীববিজ্ঞানী, দার্শনিক, সাহিত্যিকদের চিন্তাভাবনায়।

দেওয়ালির সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরাসরি নৃশংসতার চেয়ে আমাদের উদাসীনতা অন্য প্রাণীদের যন্ত্রণার কারণ হয়। আমরা তাদের ‘উমভেল্ট’ বুঝতে চাই না। ‘উমভেল্ট’ একটি জার্মান শব্দ, যার অর্থ এক-একটি প্রজাতির ইন্দ্রিয়শক্তির সমাহার যে ভাবে তাদের কাছে জগৎটাকে প্রতিভাত করে (আমাদের চেনা পঞ্চেন্দ্রিয় তো বটেই, কোনও কোনও প্রাণীর ক্ষেত্রে অন্যতর ইন্দ্রিয়ও, যেমন ‘ইলেক্ট্রোলোকেশন’ বা ‘ম্যাগনেটোলোকেশন’-এর ক্ষমতা)। উমভেল্ট-ই সব প্রাণীর বাঁচার জৈবিক ভিত্তি। আর প্রাণীদের মধ্যে একমাত্র মানুষই অন্য প্রাণীদের উমভেল্ট বোঝার মতো মস্তিষ্কশক্তি ধরে। এড ইয়োং-এর অ্যান ইমেন্স ওয়ার্ল্ড পড়ে দেখবেন, না-ই বা নামানুষদের থাকল মানুষের মতো অনন্যসাধারণ মস্তিষ্ক, জীবপালিনী প্রকৃতি তাদের সুষ্ঠু ভাবে বাঁচার মতো উমভেল্ট দু’হাত ভরে দিয়েছে। অনেক প্রাণীরই দৃষ্টি, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ও স্পর্শের ইন্দ্রিয় মানুষের তুলনায় অনেক তীব্র ও সূক্ষ্ম। যেমন, শ্রবণের ক্ষেত্রে আমরা বুঝি না, হাতিরা কেমন পারস্পরিক আদান-প্রদানের জন্য মানুষের শ্রবণ-বহির্ভূত ইনফ্রাসাউন্ড ব্যবহার করে। তেমনই আবার অনেক প্রাণীর আছে আল্ট্রাসাউন্ড। বহু প্রাণীর কানেই শব্দের কম্পাঙ্ক ও পরিমাণ (যথাক্রমে হার্টজ় আর ডেসিবেল দিয়ে মাপা হয়) আমাদের থেকে তীব্রতর ও প্রবলতর। কুকুরের শব্দের কাঁপন ধরার ক্ষমতা মানুষের প্রায় দ্বিগুণ। আমাদের তুলনায় প্রায় চার গুণ বেশি দূরত্বের আওয়াজ তারা শুনতে পায়।

মানুষ এ সব বোঝার চেষ্টামাত্র না করে নামানুষ প্রাণীদের বাঁচার পথ ক্রমশ বন্ধ করে দিচ্ছে। পরিবেশকে আমরা নির্বিকারে ভরে দিয়েছি বিকট শব্দে, উৎকট আলোয়। স্থলে জলে অন্তরিক্ষে আমাদের কাণ্ডকারখানা নামানুষ প্রাণীদের কোণঠাসা করে বিনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্য প্রাণীর উমভেল্টের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে আমরা মহানন্দে জৈবিক ধ্বংসলীলা চালাচ্ছি। হইহুল্লোড় করে সংরক্ষিত অরণ্যে পর্যটনে যেতে পারলে তবেই আমাদের প্রকৃতি আর প্রাণের প্রতি সংবেদনশীলতা জাগে, দৈনন্দিন জীবনে তার স্থান নেই। এর ফলটা কিন্তু আমাদের পক্ষেও ভাল হচ্ছে না। জীববৈচিত্রের লোপ, বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি প্রবল উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। নিজেদের ‘সেন্সরি বাবল’-এর মধ্যে থেকে আমরা যে কী খোয়াচ্ছি তা বুঝতে পারছি না। তথাকথিত হোমো স্যাপিয়েন্স তথা ‘জ্ঞানী মানুষ’ কি তার অজ্ঞানতা, অবিবেচনা, অ-সংবেদনা দিয়ে আর সবাইকে ধ্বংস করে নিজে ধ্বংস হবে?

আমরা কি একটু মানবিক আর দায়িত্বশীল হতে পারি না— নামানুষ প্রাণীদের জন্য, মানুষের জন্য? মানবপ্রকৃতি, মানবসংস্কৃতি নিয়ে যে সব বিজ্ঞানী কারবার করেন তাঁরা বলেন, তার প্রচুর সম্ভাবনাও কিন্তু আমাদের মধ্যে রয়েছে। তার অসংখ্য প্রমাণও আছে মানবসভ্যতায়। এই মুহূর্তে বাংলায় যে ‘দ্রোহ’ চলছে সেখানেও মানুষের সদর্থক সম্ভাবনার প্রকাশ। এখনও যদি এই সম্ভাবনাকে সযত্নে লালন করায় মন না দিই, বড় দেরি হয়ে যাবে। এর জন্য প্রয়োজন শুধু দ্রোহ নয়, ব্যক্তি থেকে সামাজিক স্তরে ব্যাপ্ত বহুমুখী গঠনমূলক আন্দোলন— জীবনের নানা ক্ষেত্রে সংবেদনশীলতা, সংযম ও সংস্কারের আবাহনের ভিত্তিতে। দেওয়ালিতে শব্দবাজির ‘রাত দখল’ রোখার রব ওঠানো সেই অভিমুখে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Diwali
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE