দুনিয়া থমকে ছিল গত দু’বছর। শিকেয় উঠেছিল স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। সব উৎসব-অনুষ্ঠান হয় বাতিল হয়েছে, নয় হয়েছে টিমটিম করে। দু’বছর পরে ভাইরাস যখন অনেকখানি নিয়ন্ত্রণে, উৎসবগুলিও নিজেদের পুরনো চেহারা ফিরে পেতে মরিয়া। বিশ্ব জুড়ে একই ছবি। ২০২১-এ বাতিল হওয়ার পরে রিয়ো ডি জেনেইরোতে এ বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কার্নিভাল, খানিক কাটছাঁট করেই। পর পর দু’বছর বাতিল হওয়ার পরে গত জুলাইয়ে আবার ষাঁড় দৌড়েছে স্পেনের পাম্পলোনার ‘সান ফারমিন’ উৎসবে। হেমিংওয়ের প্রাণের শহর পাম্পলোনা তার সংস্কৃতির সঙ্গে খুঁজে পেয়েছে অর্থনীতির উৎসকেও। মিউনিখের বচ্ছরকার বিয়ার-উৎসব ‘অক্টোবরফেস্ট’ও বন্ধ ছিল দু’বছর। বিপন্ন হয়ে পড়েছিল বাভারিয়ার অর্থনীতি। এ বার ফের তোড়জোড়, আশা ষাট লক্ষ পর্যটকের।
উৎসব তো শুধু আনন্দ-অনুষ্ঠান বা ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় আয়োজন মাত্র নয়, বেশির ভাগ উৎসবের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকে অর্থনীতির প্রশ্নটি। বড় উৎসব অনেক ক্ষেত্রেই বহু মানুষের প্রায় সারা বছরের রোজগারের জোগান দেয়। সারা বিশ্বেই উৎসবের সময় বাড়ি সাজানো হয়, কেনা হয় পোশাক, উপহার, হস্তশিল্প, ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জিনিসপত্র। খরচ করা হয় খাওয়াদাওয়া আর বেড়ানোয়। পুষ্ট হয় অর্থনীতিও। বড় উৎসব অর্থনৈতিক জড়তা ভেঙে উত্তরণের একটা কার্যকর মাধ্যম। ভারতে উৎসবের মরসুম শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বরের শুরুতে, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নানা উৎসব চলবে আগামী কয়েক মাস।
বিপর্যয়ের সময় উৎসবেরও অভিযোজন হয়, তার নিজের মতো করে। ১৯৪২-৪৪’এর অশান্ত সময়কালে, মন্বন্তর ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতেও দুর্গাপুজোর আয়োজন হয়েছিল। ১৯৪৪-এ খাদ্যের ‘রেশনিং’-এর সময় দেবীকে নৈবেদ্য দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছিল, চাল জোগাড় করতে না পেরে অনেকে কাজ সেরেছেন ফল-ফুলে। ২০০৭-এ শুরু হওয়া বিশ্বজোড়া মন্দার সময়ও নানা উৎসব হয়েছে পৃথিবীতে, কাটছাঁট করেই।
২০২০-র কোভিডকালেও উৎসবের মরসুমে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও বিক্রি অর্থনীতিকে খানিক ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে। অনলাইন কেনাকাটার পরিমাণ বেড়েই চলেছে ক্রমশ। অতিমারিতে একদল মানুষের আর্থিক অবস্থা যে খুব একটা খারাপ হয়নি, তা জানা কথা। সময়ের সঙ্গে মানুষের কেনাকাটার চরিত্র বদলায়: সাধারণ দোকান-বাজার থেকে শপিং মল, ঝাঁ-চকচকে বিপণি, ই-কমার্স। এমনিতে গোটা পৃথিবীতেই খুচরো বিক্রেতারা সচেষ্ট হন প্রধান ছুটির সময়গুলিতে বিক্রি বাড়াতে। রাজস্বের ক্ষেত্রে এর প্রভাব হল ‘মাল্টিপ্লায়ার’ বা ‘গুণক’ হিসাবে। উৎসবের মরসুমে ব্যক্তিগত কেনাকাটার পরিমাণ নাকি ভারতের ক্ষেত্রে জিডিপি-র প্রায় আধাআধি। কিন্তু ইউক্রেন-যুদ্ধের দমকে বিহ্বল, অতিমারিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতির ছবিটা ঠিক কী রকম? উৎসব তাকে কী ভাবে এবং কতটা পুষ্ট করতে পারে?
একটা বছর বাদ দিয়ে ২০২২-এ যখন রিয়ো কার্নিভাল অনুষ্ঠিত হল, তা থেকে রোজগার কমে গেল ৬২%। কোভিডের আগে শেষ অক্টোবরফেস্ট হয় ২০১৯-এ, এসেছিলেন ৭০ লক্ষ পর্যটক। স্বাভাবিক নিয়মেই তিন বছর পরে সংখ্যাটা বাড়া উচিত আরও, কিন্তু তেমনটা হয়তো হবে না এ বার। পৃথিবী কোভিডের ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করছে এখনও। আবার এর অনেকটাই হয়তো বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও অসাম্যের ফল।
ভারতের অবস্থাটা কেমন? গত বছর দুর্গাপুজোতেও প্রতিমা, আলো বা সার্বিক আয়োজন মোটের উপর স্তিমিতই ছিল। এ বারের পুজোতে জনতার ঢল নেমেছে আবার। সদ্য একটা হিসাবে দেখা গেল, এ বছরের পুজোর ‘সৃষ্টিশীল’ অর্থনীতির পরিমাণ নাকি প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকা। কোভিডের ঠিক আগে, ২০১৯-এর পুজোর সৃষ্টিশীল অর্থনীতির তত্ত্বতালাশ করেছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল, যার পরিমাণ হিসাব করা হয়েছিল ৩২,০০০ কোটি টাকার বেশি। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, এই হিসাবগুলি অনেকটাই অসম্পূর্ণ, বৎসরব্যাপী ছড়ানো দুর্গাপুজোর অর্থনীতি আরও অনেক বড়, হয়তো কয়েক লক্ষ কোটি টাকার, যার হিসাব করা বেশ কঠিন। কঠিন অসংগঠিত ক্ষেত্রের বেচাকেনার হিসাবও। তবু, এই খণ্ডচিত্র কি আশার ইঙ্গিত? কোভিডের অভিশাপ কাটিয়ে কি পুরনো ছন্দে ফিরছে এ দেশের, এ রাজ্যের উৎসবের অর্থনীতি?
হ্যাঁ এবং না। বিষয়টা অত সরলরৈখিক নয়। ১৯৫৪-র ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি-তে একটি প্রবন্ধ ছাপা হয় দুর্গাপুজোর অর্থনীতি নিয়ে। দেশভাগের ক্ষত তখনও দগদগে, উপরন্তু সে বছর উত্তরবঙ্গে বন্যা, দক্ষিণে খরা। সেপ্টেম্বরের বেতন পাননি অনেকে, চলছে প্রতিবাদ, স্লোগান, বোনাসের দাবি। প্রবন্ধে কিন্তু পুজোর বিক্রিবাটাকেই বর্ণনা করা হয়েছে জনগণের অর্থনৈতিক অবস্থার সূচক ও ব্যবসার ব্যারোমিটার হিসাবে— এমন সহজ সূচক অর্থনীতিবিদ বা রাশিবিজ্ঞানীদের পছন্দ না হলেও।
কিন্তু কেনাকাটার সার্বিক পরিমাণই কি উৎসবের ঠিকঠাক অর্থনৈতিক সূচক হতে পারে? বিশেষ করে সমাজে অসাম্য যেখানে প্রবল এবং শতাব্দীর ভয়ঙ্করতম অতিমারি যখন সেই অসাম্যকে বাড়াবাড়ি রকমের বাড়িয়ে দিয়েছে? অর্থনৈতিক পুনরুত্থানের রাস্তাটাও এগোচ্ছে অসাম্যের জটিল পথে। তাবড় অর্থনীতিবিদরা তথ্য নিংড়ে দেখাচ্ছেন, কোভিড-উত্তর অর্থনীতির পুনরুত্থানের রূপরেখা অনেকটা ইংরেজি ‘কে’ অক্ষরের মতো— ব্যক্তির ক্ষেত্রেও, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও। ‘কে’-র একটা হাত ঊর্ধ্বমুখী, এ ক্ষেত্রে যা ধনীদের আরও সম্পদ-বৃদ্ধির নির্দেশক। ‘কে’-র নিম্নমুখী হাতখানা নির্দেশ করে এক অতল গহ্বরের দিকে, দরিদ্ররা যেখানে তলিয়ে যাচ্ছে আরও। উক্ত প্রবন্ধটি কিন্তু পরিষ্কার বলছে, আগের বছরের তুলনায় এ বছর পুজোর কেনাকাটা ভাল হলেই তা সার্বিক অর্থনৈতিক বিকাশের চিত্ররূপ নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে তা গড়পড়তা বাঙালির অর্থ উপার্জনের হিসাব-নিকাশের এক দুঃখজনক প্রতিফলন হতেই পারে।
অতিমারিতে কাজ হারিয়েছেন বহু মানুষ, উপার্জনও কমেছে অসংখ্যের। অদক্ষ কর্মীদের উপার্জন বোঝার এক কার্যকর মাধ্যম হল ‘প্রকৃত’ গ্রামীণ মজুরি। গ্রামীণ উপভোক্তা মূল্য-সূচক দিয়ে গ্রামীণ মজুরির সামঞ্জস্য সাধন করে পাওয়া সম্ভব এই ‘প্রকৃত’ গ্রামীণ মজুরি। কোভিডের ঝাপটায় যা প্রবল বিধ্বস্ত। ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি’-র তথ্য, ২০১৯-এর জানুয়ারিতে প্রকৃত গ্রামীণ মজুরির বৃদ্ধির হার ছিল ২%; এ বছর জুনে তা ঋণাত্মক, -২.১%। ফলে একটা জিনিস পরিষ্কার, দেশের অগণন দরিদ্র মানুষের এই উৎসবের মরসুমে কেনাকাটা আগের মতো হওয়া সম্ভব নয় কিছুতেই। অতিমারির দুঃস্বপ্ন ভুলে আগের মতো উৎসব উদ্যাপনের প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও।
আজ যখন অতিমারি নিয়ন্ত্রণে, আন্তর্জাতিক পণ্য-মূল্যও বাঁধনছাড়া নয়, তখন ধনীরা হাত খুলে খরচ করতেই চাইবেন উৎসবের মরসুমে। উৎসবের ভ্রমণও পাবে নতুন উদ্যম। সম্পন্নদের এই খরচ কিন্তু অর্থনীতিকে সমৃদ্ধই করবে। তাদের কেনাকাটা, রেস্তরাঁয় খাওয়া, বেড়ানো, এ সবের ফলে অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উপকৃত হবে দরিদ্রের অর্থনীতিও। এ বছরের শেষ দিকে উপভোক্তাদের আস্থা সম্পর্কিত রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সমীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেলে খানিকটা বোঝা যাবে, ‘কে’-র উপরের হাতখানা হাত-খুলে কেনাকাটা করে কী প্রভাব ফেলল উৎসব-অর্থনীতিতে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy