সান ফ্রান্সিসকোর প্রোগ্রামার স্টেফান টমাস খবরের শিরোনামে আসেন এ বছরের গোড়ায়। তাঁর সঞ্চয়ের ৭০০২টি বিটকয়েনের ‘চাবিকাঠি’ বা পাসওয়ার্ড রাখা ছিল ‘আয়রনকি’ নামের এক ইউএসবি ড্রাইভের মধ্যে। ড্রাইভটির পাসওয়ার্ড ভুলে গিয়েছেন তিনি। এবং ইতিমধ্যেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে বিটকয়েনগুলোর পাসওয়ার্ড রাখা অন্য দু’টি হার্ড ড্রাইভও; যে কাগজে পাসওয়ার্ড লেখা ছিল, হারিয়ে গিয়েছে সেটাও। এতগুলো বিটকয়েনের বর্তমান বাজার মূল্য চল্লিশ কোটি ডলারেরও বেশি। কিন্তু, বিটকয়েনের নেই কোনও সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক, নেই কোনও ‘পাসওয়ার্ড রিসেট’-এর সুযোগ। বিকেন্দ্রীভূত ক্রিপ্টোকারেন্সির নিয়ন্ত্রণহীন চরিত্রের জন্যই এই পাসওয়ার্ড পুনরুদ্ধার করা বা পুনর্নির্মাণ করা অসম্ভব।
ক্রিপ্টোকারেন্সির লেনদেনের পদ্ধতি, তার নিরাপত্তা এতটাই আঁটোসাঁটো যে, এর মাধ্যমে কোনও লেনদেন হয়েছে বোঝা গেলেও কে কাকে ক্রিপ্টোকারেন্সি পাঠাল, তার হদিস পাওয়া অসম্ভব। এই নিরাপত্তার আশ্বাসটাই ক্রিপ্টোর শক্তির জায়গা, আবার এটাই তার দুর্বলতা।
এমনিতে বিটকয়েন ‘মাইনিং’ যেন খনি খুঁড়ে হিরে খোঁজার মতো। উন্নত মানের কম্পিউটার, শক্তিশালী অ্যালগরিদম, আর প্রচুর বিদ্যুৎশক্তি দরকার এই খনন কার্যে। খনিতে হিরে রয়েছে দুই কোটি দশ লক্ষের কাছাকাছি, যার মধ্যে এক কোটি পঁচাশি লক্ষ হিরে ইতিমধ্যেই বার করে নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কেউ হিরে খুঁজে বার করতে আগ্রহী, কেউ আবার তা কিনে জমিয়ে রাখতে চায়। লেনদেনের মাধ্যম হিসাবেও এর চল রয়েছে। তবে, এ পর্যন্ত পাওয়া বিটকয়েনের এক-পঞ্চমাংশই নাকি হারিয়ে গিয়েছে চিরতরে। নিয়ন্ত্রণহীনতার জন্যই সেগুলোর পাসওয়ার্ডও ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে অর্থের লেনদেনের সঙ্গে আবার ‘হাওলা’র খুব মিল। হাওলা হল সরকারি নজরদারি এবং সিস্টেমকে এড়িয়ে টাকা লেনদেনের এক পুরনো পদ্ধতি। আরব ব্যবসায়ীদের মধ্যে হাওলার চল ছিল, দশম শতাব্দীর কিতাব আল-আঘানি-তে এর উল্লেখ রয়েছে। প্রয়োগপদ্ধতির সঙ্গে অবিশ্বাস্য মিল থাকার জন্য বিটকয়েনকে আধুনিক যুগের হাওলা বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। নিয়ন্ত্রণহীনতার অন্য বিপদও রয়েছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অর্থের জোগানের পিছনে ক্রিপ্টোর কালো ছায়া দেখা যাচ্ছে। আবার, বিশ্ব জুড়ে র্যানসামওয়্যারের হ্যাকাররা অনেক ক্ষেত্রেই অর্থ দাবি করছে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে।
ক্রিপ্টোকারেন্সির সাম্প্রতিক রমরমাকে অনেকেই তুলনা করেছেন নব্বইয়ের দশকের ডট-কম কিংবা ২০০৮ সালের গৃহঋণ-বুদ্বুদের সঙ্গে। এই সব বুদ্বুদ বাড়তে বাড়তে হঠাৎই ফেটে যায়। ক্রিপ্টোকারেন্সির গতিপ্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করা হয় ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত অর্থনৈতিক বুদ্বুদ, সতেরো শতকের হল্যান্ডের ‘টিউলিপ-ম্যানিয়া’রও। সে সময়ে হল্যান্ডের ধনী বণিক সম্প্রদায়ের স্টেটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়ায় টিউলিপ ফুল। আকাশ-ছোঁয়া দাম হয় বিশেষ বিশেষ ধরনের ফুলের। এমন উদাহরণ আছে যে, সে সময়ে একটা টিউলিপ কন্দের দাম হয়েছে এক জন দক্ষ কারিগরের বার্ষিক আয়ের ১০ গুণেরও বেশি, কিংবা একটা কন্দের জন্য দেওয়া হয়েছে ১২ একর জমি। টিউলিপকে কেন্দ্র করে হল্যান্ডে গড়ে ওঠে আর্থিক লেনদেনের এক বিশেষ ব্যবস্থা— ‘ফিউচার্স কনট্র্যাক্ট’। ‘উইন্ডহ্যান্ডেল’ নামের এই ফিউচার্স মার্কেটে কেনাবেচা হত মরসুম শেষে টিউলিপ কন্দ কেনার চুক্তি। অনেক ক্ষেত্রেই আকাশছোঁয়া দামে। একই দিনে দশ বার কোনও চুক্তি হাতবদল হয়েছে— প্রতি বার আগের চাইতে বেশি মূল্যে, এমন নজিরও রয়েছে। তবে কিনা, ফুলে ওঠা বুদ্বুদকে তো এক সময় ফাটতেই হয়। হার্লেম শহরের ১৬৩৭-এর ফেব্রুয়ারির বিউবোনিক প্লেগ ভেঙে চৌচির করে দেয় এই বুদ্বুদকে। বিটকয়েন নিয়ে সাম্প্রতিক দুনিয়ার পাগলামিকে অনেকে মনে করেন টিউলিপ-বুদ্বুদের চাইতেও ভঙ্গুর। সে সময়ে বিনিয়োগকারীর হাতে অন্তত পড়ে থাকত টিউলিপের কন্দ, তার দাম যতই কম হোক না কেন। আজকের দুনিয়ায় ক্রিপ্টোকারেন্সির বুদ্বুদ ফেটে গেলে হতাশাটুকু ছাড়া অবশিষ্ট থাকবে না কিছুই।
অবশ্য, সভ্যতারও হিসাবের খাতাতেও যে একেবারে কিছুই পড়ে থাকবে না, তেমনটা নয়। বিটকয়েন সভ্যতাকে দিয়েছে তার বলিষ্ঠ উত্তরাধিকার, ‘ব্লকচেন’— যা বহু ডিজিটাল ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তা’কে পুনর্সংজ্ঞায়িত করেছে। ফলে বিপ্লব এসেছে ব্যাঙ্কিং, ভোটিং, স্থাবর সম্পদের নথিবদ্ধকরণ ইত্যাদির ক্ষেত্রে।
টিউলিপের বুদ্বুদের সঙ্গে বিটকয়েনের যে পুরোটাই মিল, তা নয়। টিউলিপ কে চাষ করেছে, কে কিনেছে, কে চুক্তি করেছে, তা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারেই। ক্রিপ্টোকারেন্সির বিমূর্ত জগতে পরচিত্ত সম্পূর্ণই অন্ধকার— কোনও কুশীলবকেই চেনার উপায় নেই। ক্রিপ্টোকারেন্সির জগৎটা টিউলিপ-ম্যানিয়ার নবনির্মাণ, হাওলার বিসর্পিল প্রাচীন পথ ধরে। অনেক জটিল এই ক্রিপ্টোর জগৎ— কী ভাবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেই হিসাব কষতেই দুনিয়ার কেটে গেল এক দশক।
ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে কী করবে ভারত? ক’দিন আগেই জোর আলোচনা চলছিল, সরকার হয়তো যথাসাধ্য নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়ে কর বসাবে ক্রিপ্টোসম্পদ থেকে আয়ের উপরে। এর ফলে রাজকোষের উপকার হবে, তাতে সংশয় নেই। অন্য সম্ভাবনা হল, ভারত বিটকয়েনের মতো সমস্ত ‘প্রাইভেট’ ক্রিপ্টোকারেন্সি নিষিদ্ধ করার পথে হাঁটবে। এমনটাই করেছে চিন— সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের তৈরি ডিজিটাল ইউয়ান ছাড়া সমস্ত ক্রিপ্টোকারেন্সি সে দেশে নিষিদ্ধ।
এর উল্টো দিকে আছে এল সালভাডোরের মতো দেশ। মধ্য আমেরিকার এই দেশে বিটকয়েনকে ‘লিগ্যাল টেন্ডার’-এর মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তারা ঘোষণা করেছে যে, সে দেশে গড়ে তোলা হবে এক বিটকয়েন শহর। এল সালভাডোর নিঃসন্দেহে ক্রিপ্টো থেকে যতটা সম্ভব সুবিধা তুলে নিতে চায়। বেশির ভাগ দেশই অবশ্য এর মাঝামাঝি অবস্থানে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে, ব্রিটেনে, আমেরিকায় ক্রিপ্টোর ব্যবহার চলছে। কোথাও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত, কিছুটা হয়তো ধোঁয়াশায় ঢাকা। দুনিয়া সম্ভবত বুঝছে যে, এই দৈত্যকে বোতলে পোরা সাধ্যের অতীত। অনেক দেশই তাই ক্রিপ্টোসম্পদ থেকে আয়ে কর বসাচ্ছে নিজেদের নিয়মে। তাতে রাজকোষ খানিকটা স্ফীত হচ্ছে নিশ্চয়ই।
আমাদের দেশে বিটকয়েন এবং সার্বিক ভাবে ক্রিপ্টোসম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে আসছে বিল। সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে। সেই ভবিষ্যৎ আইনের রূপরেখা এখনও অনেকটাই অস্পষ্ট। তবে সেই আইন যে প্রধানত ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে হাওলা এবং সন্ত্রাসী কার্যকলাপ যতটা সম্ভব আটকাতেই, সে বিষয়ে সন্দেহ কম। যদিও বিশ্ব জুড়ে প্রভাব-ছড়ানো বিকেন্দ্রীভূত ক্রিপ্টোকারেন্সির ডানা ছাঁটা সহজ নয় নিশ্চয়ই। তবু, বোতল-মুক্ত দৈত্যকে আবার বন্দি করার মরিয়া চেষ্টা চলছে।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy