Advertisement
E-Paper

তাঁর মৃত্যু তাঁর জীবনের দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে বাধ্য করছে

আমাদের কর্তব্য হল নাজ়ারেথের জিশুর পথে ফেরত যাওয়া, তাঁর বিপ্লবী আদর্শ অনুসরণ করা।

রাজশ্রী মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২১ ০৫:০৬
Share
Save

ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে জীবনানন্দের কবিতার কয়েকটি লাইন মাথায় ঘোরাফেরা করছে, “মানুষটা ম’রে গেলে যদি তাকে ওষুধের শিশি/ কেউ দ্যায়— বিনি দামে— তবে কার লাভ—/ এই নিয়ে চারজনে ক’রে গেল ভীষণ সালিশী।” মনে হয়, এই যে সমবেত শোকপালন, বিক্ষুব্ধ অভিযোগ, রাষ্ট্রের দিকে উদ্যত অভিযোগের তর্জনী, এ সবে কী লাভ?

সরাসরি না হলেও, লাভ আছে। অনেক লাভ। ভুললে চলবে না। স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু তাঁর জীবনের দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে বাধ্য করেছে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় গ্রেফতার হওয়ার আগে অনেকেই তাঁর নাম জানতেন না। তিনি প্রচারের আলো থেকে অনেক দূরে আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়াই করে গিয়েছেন। দীর্ঘ ৪০ বছরের সহযোগী ওয়াল্টার ফার্নান্ডেজ় লিখেছেন, ফাদার স্ট্যান আদিবাসী, দলিত ও মহিলাদের অধিকার অর্জনের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বলেছিেলন, ভারতীয় সংবিধান যে ভারতবর্ষের কথা বলে সেখানে এদেরও সমান অধিকার, কিন্তু বড় পুঁজি ও মুনাফালোভীরা কখনও তা চায় না। অতএব ফাদার স্ট্যান হয়ে উঠেছিলেন তাদের চক্ষুশূল। তার দাম তাঁকে চোকাতে হল জীবন দিয়ে। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় যে ১৬ জন মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং সমাজ আন্দোলনের অংশীদারকে গ্রেফতার করে মামলায় জড়ানো হয়েছে, তাঁরা অনেকেই পরস্পরকে চেনেন না, কেউ কোনও দিন ওই জায়গায় যাননি। তাই এক সঙ্গে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা নয়— অভিযুক্তদের মধ্যে আসলে মিল অন্য জায়গায়। তাঁরা যে যাঁর মতো করে প্রান্তিক মানুষের উন্নয়ন ও বৃহত্তর সমাজে প্রান্তিক মানুষের অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করছিলেন।

ফাদার স্ট্যানের পুরো জীবনটাই হল দীন থেকে দীনতর মানুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের অধিকারের দাবিতে সরব হওয়ার আলেখ্য। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কৃষিক্ষেত্রের বেগার মজদুরদের স্বাধীনতা ও অধিকারের জন্য লড়েছেন বেঙ্গালুরুতে। ১৯৭৮ সাল থেকে লড়েছেন ভিল্লুপুরম এবং তাঞ্জোরের দলিতদের জন্য। খ্রিস্টান চার্চও সব সময় তাঁর এই জড়িয়ে পড়াকে ভাল চোখে দেখেনি। সুতরাং, তাঁকে অনেক সময় চার্চের ভিতরেও লড়তে হয়েছে বিরোধী শিবিরের সঙ্গে। কিন্তু তিনি অহিংসার পথ ধরে গরিব মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি ও আত্মপরিচয়ের লড়াইতে অটল থেকেছেন।

ফাদার স্ট্যান দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপৃত ছিলেন ঝাড়খণ্ড ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলের আদিবাসীদের আন্দোলনে। আদিবাসীরা যে জঙ্গল-টিলায় বাস করে, তার বড় অংশ হল কয়লা, খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। তাই এই অঞ্চলে কয়লা মাফিয়া থেকে শুরু করে কর্পোরেট বাণিজ্যের নজর। তারা জঙ্গল সাফ করে ডিনামাইট দিয়ে টিলার পাথর উড়িয়ে জমির দখল চেয়েছে। এবং আদিবাসীদের ব্যবহার করতে চেয়েছে সস্তার শ্রমিক হিসেবে। আদিবাসীরা স্বাভাবিক ভাবেই প্রতিবাদ করেছে। জল-জঙ্গল-জমির অধিকার ছেড়ে নিজভূমে পরবাসী হতে চায়নি। ফাদার স্ট্যান হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন ‘প্রিভেনশন অব ট্রাইবাল ল্যান্ড এলিয়েনেশন’ প্রয়োগ করার দাবিতে ও পঞ্চায়েতের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে। একই সঙ্গে, তিন হাজার আদিবাসী যুবার জেল থেকে মুক্তির দাবিতেও তিনি আদালতে যান। সেই মামলার শুনানির কয়েক দিন আগেই তাঁকে জামিন-অযোগ্য ইউএপিএ-র আওতায় গ্রেফতার করা হয়। দুর্ভাগ্য, দু’টি শুনানির একটিও তাঁর শুনে যাওয়া হল না।

খ্রিস্টান পাদরিদের কর্মকাণ্ডের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে শিক্ষা ও সমাজসেবা। তাঁদের কেউ গ্রেফতার করে না, মাওবাদী যোগ আছে বলে আঙুলও তোলে না। কেন চুরাশি বছরের ভগ্নস্বাস্থ্য ফাদার স্ট্যান আর পাঁচ জন পাদরি থেকে পৃথক, সেটা বুঝতে গেলে তাঁর চিন্তনবিশ্বের শিকড় খোঁজা দরকার। ২০১৯ সালের বড়দিনের ভাষণে ফাদার স্ট্যান দুই জন আলাদা জিশুর কথা বলেছেন। এক জন নাজ়ারেথের জিশু, যিনি দরিদ্র ছুতোর পরিবারে জন্মেছিলেন, দারিদ্রের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন, হতদরিদ্র মানুষদের কাছে টেনে নিয়েছেন শিষ্য হিসেবে। তিনি নির্যাতিত ও নিপীড়িতদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য তাঁকে রাজদ্রোহী ঘোষণা করে শাস্তিস্বরূপ ক্রুশবিদ্ধ করা হয়। নাজ়ারেথের জিশুর জীবন ছিল এক বিপ্লবীর জীবন। দ্বিতীয় জিশু হলেন ধনী খ্রিস্টানদের জিশু। তিনি বিপুল বিত্ত ও ক্ষমতার দ্বারা কলুষিত। শাসকশ্রেণি এই জিশুর উপাসক। তাঁর ধর্মপ্রচারকারী যাজকরা মুখে দরিদ্রসেবার কথা বলে ভোগবিলাসের জীবন কাটান। এঁরা জিশুকে সাধারণ মানুষের থেকে সরিয়ে গির্জার চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি করে রাখেন। সুতরাং, আমাদের কর্তব্য হল নাজ়ারেথের জিশুর পথে ফেরত যাওয়া, তাঁর বিপ্লবী আদর্শ অনুসরণ করা। ধনী ও দরিদ্র, সবল ও দুর্বল, অত্যাচারী ও নিপীড়িতের মধ্যে যে ক্রমাগত বাড়তে থাকা বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব, তাকে প্রতিহত করা, দৃঢ় ভাবে দুর্বল ও নির্যাতিতের পক্ষ নেওয়া। এর জন্য যে কোনও মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকা।

ফাদার স্ট্যানের এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার, তিনি এক ধরনের সাম্যবাদের কথা বলছেন গরিবের জিশুর মাধ্যমে। তিনি শোষণমুক্তি এবং বণ্টনের ন্যায়ের কথা বলছেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার লিবারেশন থিয়োলজি বা ধর্মীয় মুক্তিতত্ত্বের প্রচুর মিল রয়েছে। পেরুর পাদরি গুস্তাভো গুটিয়েরেজ, ব্রাজিলের পাদরি লিয়োনার্দো বফ্‌, উরুগুয়ের জেসুইট হুয়ান লুই সেগুন্ডো হলেন ধর্মীয় মুক্তিতত্ত্বের প্রধান প্রবক্তা। এই তত্ত্ব নির্যাতিতের মুক্তির কথা বলে। ক্ষেত্রবিশেষে তা হল, আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি, কিংবা বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিপ্রথার ভয়ানক সামাজিক ব্যাধি থেকে মুক্তি। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে এই সাম্যবাদের ভাবনা। কৃষ্ণাঙ্গদের ধর্মতত্ত্ব রূপে প্রসারিত হয় উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্যালেস্তাইনের মুক্তিযুদ্ধ, দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক শাসন বিরোধী লড়াই, এমনকি ভারতের দলিত আন্দোলনে এর প্রভাব পড়ে। দলিত লিবারেশন থিয়োলজি ১৯৮০’র দশক থেকে জনপ্রিয় হয়। তার ভিত্তি, লিউক ৪-এর নাজ়ারেথ ম্যানিফেস্টো, যেখানে জিশু বলছেন দরিদ্র, বন্দি— সব রকম নির্যাতিতের মুক্তির কথা।

ভারতীয় প্রেক্ষিতে প্রান্তিকতা শুধুমাত্র শ্রেণি দিয়ে বোঝা যাবে না। শ্রম, লিঙ্গ, বর্ণকে যোগ করতে হবে তার নৈতিক-রাজনৈতিক পরিসরে। ভারতের মাটিতে গৌতম বুদ্ধ সম্ভবত প্রথম ধর্মীয় মুক্তিতাত্ত্বিক, যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করে জাতিবর্ণ-নির্বিশেষে সবার মুক্তির কথা বলেছিলেন। বৌদ্ধধর্মে শূদ্র, নারী, সবার স্থান স্বীকৃত। পরবর্তী কালে চৈতন্যদেবের বাণীতেও একই সুর শোনা যায়। আধুনিক যুগে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী সহজানন্দ সরস্বতী এবং স্বামী অগ্নিবেশের ভাবনা ও কাজেও সংস্কার সাধনার ধারা লক্ষ করা যায়। বিবেকানন্দের সেই অমোঘ বাণী, “হে ভারত, ভুলিও না— নীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর, তোমার রক্ত, তোমার ভাই। ...সদর্পে বল... চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই”। আজকের দিনে জন্মালে শ্রীচৈতন্য, স্বামী বিবেকানন্দকে তাঁদের কাজের জন্য নানা রকম রাষ্ট্রীয় হেনস্থার সম্মুখীন হতে হত।

স্বাধীন ভারতবর্ষে ষাট-সত্তরের দশক থেকে প্রান্তিক মানুষের আত্মসম্মান অধিকারের লড়াইয়ে অনেকগুলি মাইলফলক চোখে পড়ে। ষাট-সত্তর দশকের অ্যাকশন গ্রুপের আন্দোলন, জয়প্রকাশ নারায়ণের কৃষক আন্দোলন, সুন্দরলাল বহুগুণার চিপকো আন্দোলন, ও শঙ্কর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে লোহাখনি শ্রমিক, নদী-বাঁধ বিরোধী ও জঙ্গলের অধিকার নিয়ে আন্দোলন এর উজ্জ্বল উদাহরণ। ফাদার স্ট্যানের ঝাড়খণ্ডের আদিবাসীদের অধিকার-সংক্রান্ত কাজকে এই সব আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দেখতে হবে। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সংস্কার সাধকদের ভাবনাবিশ্বের অংশীদার। ধর্মচর্চার ক্ষুদ্র পরিসর ছেড়ে যাঁরা যাঁরা সমাজে সাম্য স্থাপনের চেষ্টা করেছেন, পিছিয়ে পড়া মানুষের সামাজিক অন্তর্ভুক্তির জন্য সরব হয়েছেন, স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে অজস্র প্রশ্ন তুলেছেন, তাঁদেরকেই রাষ্ট্রীয় রোষের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ব্রাজিলের আর্চবিশপ জন হেল্ডার কামারা-র কথায়, “আমি যখন গরিবদের খাওয়াই, তারা আমাকে সাধু বলে, কিন্তু যখন আমি প্রশ্ন তুলি, কেন গরিবেরা ক্ষুধার্ত, তারা আমাকে কমিউনিস্ট বলে।”

ফাদার স্ট্যানের জীবন ও মৃত্যুকে আমাদের এই আলোতেই দেখতে হবে।

Narendra Modi Death Stan Swamy

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।