কৃষকরা আমাদের ভগবান, তাঁদের সেবাই ভগবানের সেবা: বলেছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান, সম্প্রতি কৃষকদের একটি সভায়। তাঁর সুললিত ভাষায়, কৃষি ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ড, কৃষকরাই অর্থনীতির জীবনীশক্তি, কৃষকরা যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পান, তা নিশ্চিত করতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে (এমএসপি) সরকার ফসল সংগ্রহ করছে।
প্রশ্ন ওঠে, তা হলে এর পরও ‘ভগবান’-রা আন্দোলন করছেন কেন? কেননা সরকার যে এমএসপি নির্ধারণ করছে আর চাষি যা চাইছেন, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। কমিশন ফর এগ্রিকালচারাল কস্টস অ্যান্ড প্রাইসেস-এর হিসাব অনুযায়ী বীজ, সার, জ্বালানি এবং সেচ ইত্যাদিতে যে খরচ, তার যোগফলের সঙ্গে পারিবারিক শ্রম (মজুরি) যোগ করে চাষের উৎপাদন ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। তার উপর আরও ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে সরকার ফসলের এমএসপি নির্ধারণ করছে। কিন্তু চাষিদের দাবি, ‘ন্যাশনাল ফার্মার্স কমিশন’-এর সুপারিশ অনুযায়ী চাষের মোট খরচের সঙ্গে ধরতে হবে কৃষি জমির ভাড়া এবং কৃষি মূলধনের সুদ। তার উপর ৫০ শতাংশ যুক্ত করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা হোক। ২০২৪-২৫ রবি মরসুমে সরকার গমের এমএসপি ঘোষণা করেছে ২২৭৫ টাকা কুইন্টাল, ‘ন্যাশনাল কমিশন অন ফার্মার্স’-এর সুপারিশ অনুসারে এমএসপি দাঁড়াত ২৪৭৮ টাকা। চাষিদের অভযোগ, সরকার হিসেবের মারপ্যাঁচ ঘটিয়ে নিজের ‘ভগবান’কেই ঠকাচ্ছে।
সরকার যে প্রাকৃতিক চাষকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বোঝাতে কৃষিমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২৪৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ন্যাশনাল মিশন অন ন্যাচারাল ফার্মিং’ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী দু’বছরের মধ্যে দেশের এক কোটি চাষি এবং প্রায় সাড়ে সাত লাখ হেক্টর জমিকে প্রাকৃতিক চাষের আওতায় আনা হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। প্রাকৃতিক চাষ পরিবেশ-বান্ধব এবং সুস্থায়ী, কিন্তু জমির উৎপাদনশীলতা রাসায়নিক চাষের তুলনায় কম। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ও অন্যান্য সংস্থা উত্তরাখণ্ডের পন্তনগর, পঞ্জাবের লুধিয়ানা, হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র এবং উত্তরপ্রদেশের মোদীপুরমে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, প্রাকৃতিক চাষে বাসমতী চাল ও গমের উৎপাদনশীলতা রাসায়নিক চাষের তুলনায় যথাক্রমে ৩২ শতাংশ এবং ৫৮ শতাংশ কম। ফলে প্রাকৃতিক চাষে খাদ্য নিরাপত্তা ও চাষির আয়ে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। ‘ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস’ প্রাকৃতিক চাষে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপত্তি জানিয়েছে। এই কৃষি-পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক। ভারতীয় জনগণের ক্ষুধা, অপুষ্টি এবং রক্তাল্পতা দূর করতে এই মুহূর্তে এটি কার্যকর নয়।
কৃষি বিপণনকে শক্তিশালী করতে জমি থেকে ভোক্তাদের কাছে সরাসরি কৃষিপণ্য বিক্রির উপরে কৃষিমন্ত্রী জোর দেন। মধ্যস্থতাকারী বাদ গেলে চাষির লাভ বাড়বে। কৃষি বিপণন ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে সরকার কিছু ব্যবস্থা করতে চায়। যেমন, ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে চাষিদের ক্রেতা, পাইকারি বিক্রেতা এবং খুচরো বিক্রেতাদের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে। কিন্তু চাষিদের মধ্যে ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, ডিজিটাল পরিকাঠামোর দুর্বলতা, সাইবার নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ রয়েই যাচ্ছে। এ ছাড়া কৃষিপণ্যের বাজার এবং সরবরাহের পরিকাঠামো সংস্কার, চাষিদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়াতে ফার্মার-প্রডিউসার্স অর্গানাইজ়েশনগুলিকে শক্তিশালী করা, পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করতে এবং ভোক্তাদের আস্থা অর্জনের জন্য কৃষিপণ্যের গ্রেডিং এবং নির্দিষ্ট মান নির্ধারণের ব্যবস্থা করা হবে। সংস্কারের লক্ষ্য কৃষকদের ক্ষমতায়ন ঘটানো। তবে সমালোচকদের যুক্তি, প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলি অত্যধিক জটিল। অনেকেই মনে করছেন, সরকার কৃষি বিপণন সংস্কারের নামে বাতিল হওয়া কৃষি বিলকে ঘুরপথে ফিরিয়ে আনছে। ভারতীয় কৃষির বাজারের রাশ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে।
কৃষিমন্ত্রী চাষিদের সঠিক মূল্য পাওয়ার আশ্বাস দিলেও, বীজ, সার এবং কীটনাশকের মতো কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে চাষের খরচ অনেকগুণ বেড়েছে। মধ্যস্থতাকারীদের উপর নির্ভরতা চাষিদের লাভ কমাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে অনিশ্চিত বর্ষা, আকস্মিক বন্যা এবং খরায় ফসল নষ্ট ও উৎপাদন হ্রাস। এর ফলে চাষি যে কৃষিঋণ নেন, প্রায়ই তা শোধ দিতে পারেন না। ঋণ শোধ করতে না পেরে ভারতে প্রতি বছর ১২ হাজারেরও বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেন, যা দেশের মোট আত্মহত্যার প্রায় ১০ শতাংশ।
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, মোদী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হল কৃষকের কল্যাণ। কিন্তু কৃষকদের আয় বাড়িয়ে তাঁদের কৃষিঋণের জাল থেকে মুক্ত করার কোনও প্রচেষ্টা সরকারের নেই। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা কীটনাশকের আক্রমণে ফসল নষ্ট হলে নিয়মানুযায়ী দু’মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার থেকে ক্ষতিপূরণ চাষির অ্যাকাউন্টে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। ২০২৩-২৪ সালে মহারাষ্ট্রে এই বিমা প্রকল্পের প্রিমিয়াম সংগৃহীত হয়েছিল দশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। চাষিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় মাত্র সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো। এই খামতি দেশের সর্বত্র। কৃষিমন্ত্রী যখন কৃষকদের ‘ভগবান’ বলে সম্বোধন করছেন, ঠিক তখনই অভাবের তাড়নায় কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। সরকার সেই আত্মহত্যা ঠেকাতে ব্যর্থ। আশঙ্কা হয়, কৃষির উন্নয়ন ও কৃষক কল্যাণ-সংক্রান্ত সরকারি ঘোষণার বেশির ভাগটাই চমক।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)