আয়ের ভিতটা আসলে তেমন মজবুত নয়, কিন্তু উপরে-উপরে ঠাটবাট বজায় রাখতেই হবে। বাড়ির মর্টগেজ, গাড়ি বা দু’চাকার কিস্তি-শোধ, ছেলেমেয়ের ইংরেজি ইস্কুলের মাইনে, বৌয়ের জন্মদিন, সপ্তাহে এক দিন বাইরে খাওয়া। তা ছাড়া বছরে অন্তত এক বার দূরে কোথাও গেলে ভাল হয়, নিদেনপক্ষে পুরী-দিঘা। এই সব মিলিয়েই মধ্যবিত্ত। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, নড়বড়ে, করুণ। অর্থনীতির পণ্ডিতরা গরিবদের নিয়ে যত মাথা ঘামান, তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভগ্নাংশও মধ্যবিত্তদের নিয়ে ঘামান না। অথচ, মধ্যবিত্ত না থাকলে কে জিনিসপত্র কিনত? যে চাহিদার ভরসায় কল-কারখানার চাকা ঘুরছে, কে জোগাত সেই চাহিদা?
আগে তবু ভাল-মন্দ মিশিয়ে এক রকম চলছিল, কোভিড-১৯ অতিমারি এসে মধ্যবিত্তের জীবনকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। কারও চাকরি চলে গিয়েছে, অর্ধেক হয়ে গিয়েছে কারও বেতন, আর যাঁদের এখনও সে সব হয়নি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আসন্ন সর্বনাশের সম্ভাবনায় সিঁটিয়ে রয়েছেন। মধ্যবিত্তদের একটা সামান্য অংশ অবশ্য আছেন, যাঁদের চাকরি চলে যাওয়ার বা মাইনে কমার ভয় নেই। তাঁদের সিংহভাগই সরকারি চাকুরে। কিন্তু সরকারি চাকরির লটারি ক’জনের কপালে জোটে? যাঁদের জোটেনি, তাঁদের অনেকেই এখন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে নেমে গিয়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণিভুক্ত। ধাক্কাটা ভারতীয় মধ্যবিত্তদের উপর যতটা পড়েছে, অন্য কোনও দেশে ততটা পড়েনি।
আমেরিকার চিন্তন-ভান্ডার পিউ রিসার্চ সেন্টার গত মার্চ মাসে প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছে, ২০২০ সালে কোভিড অতিমারির প্রকোপে তিন কোটি কুড়ি লক্ষ ভারতীয় মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের শ্রেণিতে নেমে গিয়েছেন। বস্তুত, অতিমারির ফলে সারা পৃথিবীতে যত মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের ৬০ শতাংশই ভারতীয়। চিনে এই সংখ্যাটা এক কোটি, অর্থাৎ ভারতের এক-তৃতীয়াংশেরও কম। হিসাবটা তুলনীয়, কারণ জনসংখ্যার নিরিখে দুটো দেশ কাছাকাছি; এবং যে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে এক জন ভারতীয় নাগরিককে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র বলা হচ্ছে, চিন বা অন্য দেশের নাগরিকদের শ্রেণি-নির্ধারণ করার সময় সেই একই মাপকাঠি ব্যবহার করা হচ্ছে।
মাপকাঠিটা এই রকম— ভারতীয় বা অন্যান্য দেশের নাগরিকদের, তাঁদের দৈনিক খরচ অনুযায়ী, পাঁচটা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যাঁদের মাথাপিছু দৈনিক ব্যয় দুই আমেরিকান ডলারের সমান বা কম, তাঁদের বলা হচ্ছে দরিদ্র; দৈনিক ব্যয় ২ ডলার থেকে ১০ ডলার হলে নিম্নবিত্ত; ১০ থেকে ২০ ডলার হলে মধ্যবিত্ত; ২০ থেকে ৫০ ডলার হলে উচ্চ মধ্যবিত্ত; আর ৫০ ডলারের বেশি হলে উচ্চবিত্ত। এই শ্রেণিবিভাগ করার সময় ডলারের সঙ্গে টাকার প্রাতিষ্ঠানিক বিনিময় মূল্য ব্যবহার না করে পার্চেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা ক্রয়ক্ষমতা-ভিত্তিক বিনিময় মূল্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তার আগে প্রশ্ন, অর্থনৈতিক শ্রেণিবিভাগের সীমাগুলো কী ভাবে ঠিক হল?
মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে উদাহরণ হিসাবে নেওয়া যাক। প্রথমে আহার, বাসস্থান, পরিবহণ, বাচ্চাদের ইস্কুল, পরিবারের আমোদ-প্রমোদ সব মিলিয়ে একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতে গেলে কত টাকার দরকার, সে বিষয়ে মোটামুটি ধারণা করে নেওয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক দাম অনুযায়ী মাথাপিছু দৈনিক ১০ থেকে ২০ ডলার খরচ করলে এই জীবনযাপন সম্ভব। দেশের বর্তমান মূল্যমান অনুযায়ী দেশের ভিতরে এ বাবদ খরচ করতে হচ্ছে মাথাপিছু দৈনিক ২২০ থেকে ৪৪০ টাকা। অর্থাৎ, ১ ডলারের ক্রয়ক্ষমতা-ভিত্তিক বিনিময় মূল্য দাঁড়াচ্ছে ২২ টাকা। যদি ধরে নিই যে, গড়ে একটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার, তা হলে এই হিসাব অনুযায়ী যে সব পরিবার মাসে ২৬,৪০০ টাকা থেকে ৫২,৮০০ টাকা ব্যয় করছে, তারা মধ্যবিত্ত বলে চিহ্নিত হচ্ছে। একই ভাবে চিহ্নিত হচ্ছে অন্য শ্রেণিগুলো। যেমন, যে সব পরিবারের মাসিক ব্যয় ৫২,৮০০ থেকে ১,৩২,০০০ টাকা, তাদের উচ্চ মধ্যবিত্ত বলা হচ্ছে। পিউ-এর অনুমান, কোভিডের ফলে ৬০ লক্ষ উচ্চ মধ্যবিত্ত নিম্নতর শ্রেণিতে নেমে গিয়েছে।
আমরা মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তর কথা বলছি মানে এই নয় যে, কোভিড-১৯ নিম্নবিত্তদের স্পর্শ করেনি। পিউ-এর হিসাব অনুযায়ী, অতিমারির প্রকোপে সাড়ে তিন কোটি নিম্নবিত্ত মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে নেমে গিয়েছেন। অর্থাৎ, সংখ্যার দিক থেকে দেখলে আর্থিক অবনমন নিম্নবিত্তের মধ্যেই সর্বাধিক। তবু আমরা আলাদা করে মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তদের কথা বলছি, কারণ দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নতিতে তাঁদের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। কী ভূমিকা, সেটা বলি।
স্কেল বা আয়তন আধুনিক উৎপাদনের অন্যতম প্রধান শর্ত। শিল্পবিপ্লবের পর যখন যান্ত্রিক উৎপাদন শুরু হল, তখন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল উৎপাদনের পরিমাণ। আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রথমেই কারখানা এবং যন্ত্রপাতির পিছনে একটা থোক টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। বিনিয়োগের খরচটা বিপুল এবং উৎপাদনের পরিমাণ যথেষ্ট না হলে খরচটা উঠবে না। কারখানা থেকে যথেষ্ট পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হয়ে বাজারে বিক্রি হলে তবেই প্রাথমিক বিনিয়োগটা লাভজনক হবে; এবং, একটা বিনিয়োগ লাভজনক হলে তবেই আসবে আরও বিনিয়োগ, আর্থিক বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান।
অর্থাৎ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গেলে প্রাথমিক ভাবে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ প্রয়োজন, এবং বড় বিনিয়োগ লাভজনক হতে গেলে একটা বড় বাজার দরকার। ভারতে উচ্চবিত্তরা যে হেতু তুলনায় অল্প— উপরে উল্লিখিত শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার ০.২১%— শুধুমাত্র তাঁরা ক্রেতা হলে বেশির ভাগ বিনিয়োগই লাভজনক হবে না। তা ছাড়া উচ্চবিত্তরা বহু ক্ষেত্রেই দেশি পণ্যের তুলনায় বিদেশি পণ্য পছন্দ করেন। উল্টো দিকে নিম্নবিত্তরা আহার-বাসস্থানের সংস্থান করতেই আয়ের সিংহভাগ খরচ করে ফেলেন। আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি জিনিসপত্র কেনার সামর্থ্য তাঁদের কম। তা হলে পড়ে রইল মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত। কোভিডের ঠিক আগে সম্মিলিত ভাবে তাঁদের সংখ্যা ছিল ১২ কোটির উপর— দেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৭%। এঁরাই ছিলেন দেশের মূল ক্রেতা, দেশে উৎপাদিত আধুনিক পণ্যের বাজারটাকে এঁরাই ধরে রেখেছিলেন।
পিউ-এর অনুমান, কোভিড-১৯’এর প্রকোপে সম্মিলিত ভাবে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্তের সংখ্যা প্রায় চার কোটি কমে গিয়েছে। ১২ কোটির থেকে চার কোটি কমে যাওয়া মানে ৩৩% হ্রাস। এর ফলে বাজারের আয়তনও যদি ৩৩ শতাংশ কমে, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ফের মাথা তুলে দাঁড়াবে কী করে?
কোভিড অতিমারি এমন একটা অঘটন, যার উপর আমাদের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দুঃসময়ে কেন্দ্রীয় সরকার কি দেশের মধ্যবিত্তদের সুরক্ষার জন্য আদৌ কিছু করছে? করছে না তো বটেই, বরং বেশ কিছু সাম্প্রতিক কেন্দ্রীয় নীতি মধ্যবিত্তদের আরও বিপাকে ফেলেছে। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই পেট্রোপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির কথা উল্লেখ করতে হয়। এর ফলে জ্বালানির খরচ ভয়ঙ্কর রকম বেড়ে গিয়েছে। যাঁরা কোভিডের হাত থেকে বাঁচার জন্যে চার বা দু’চাকার বাহন কিনবেন ভাবছিলেন, তাঁরা আবার ভেবে দেখছেন। রান্নার গ্যাসের অভূতপূর্ব মূল্যবৃদ্ধির ফলে মধ্যবিত্তের পকেটে রীতিমতো টান পড়েছে। তা ছাড়া পরিবহণ মহার্ঘ হওয়ার কারণে সব জিনিসেরই দাম বাড়ছে।
মধ্যবিত্তের উপর দ্বিতীয় কোপ ক্রমশ সুদের হার কমে যাওয়া। সুদের হার কমে গেলে মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হন মধ্যবিত্ত-উচ্চ মধ্যবিত্তেরা। নিম্নবিত্ত বা দরিদ্রদের সঞ্চয় অতি সামান্য, তাই সুদের হার কমে গেলেও তাঁদের ততটা যায়-আসে না। অপর পক্ষে, উচ্চবিত্তদের একটা বড় অংশ বড় বা মাঝারি ব্যবসায়ী। ব্যবসা চালানোর জন্যে তাঁদের বাজার থেকে ধার করতে হয়। সুদের হার কমলে অধমর্ণ হিসাবে তাঁরা যে সুবিধাটা পান, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের উপর সুদের হার কমে যাওয়ার জন্যে যে ক্ষতি, তার চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়া সুদ কমলে শেয়ার বাজার চাঙ্গা হয়। এর ফলেও কিন্তু সবচেয়ে লাভ বড় ব্যবসায়ীদের, যাঁরা বেশির ভাগ শেয়ারের মালিক। মধ্যবিত্ত শেয়ার বাজারে টাকা খাটাতে ভয় পান। তাঁর ভরসা সেই সনাতন ব্যাঙ্ক। ফলে, সুদের হার কমে যাওয়ার কোপটা তাঁদের উপরেই পড়ে। সম্প্রতি প্রভিডেন্ট ফান্ডের সুদের উপরেও আয়কর বসেছে।
সরকার মধ্যবিত্তদের ব্যাপারে এখনই না ভাবলে অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy